Logo
×

Follow Us

প্রচ্ছদ প্রতিবেদন

মাইক্রোগ্রিন

পুষ্টিকর খাবারের স্মার্ট সমাধান

Icon

এহতেশাম শোভন

প্রকাশ: ১২ জুলাই ২০২৫, ১৪:১৭

পুষ্টিকর খাবারের   স্মার্ট সমাধান

সম্প্রতি পুষ্টি সচেতন মহলে মাইক্রোগ্রিন একটি পরিচিত নাম। পুষ্টির চাহিদা মেটাতে এবং দৈনন্দিন জীবনে সবুজ খাবারের অভাব পূরণ করতে মাইক্রোগ্রিন এক দারুণ সমাধান। ছোট পরিসরে, সহজ পদ্ধতিতে ও কম সময়ে ফসল উৎপন্ন হওয়ায় এটি শহুরে কৃষির এক অনন্য উদাহরণ হয়ে উঠেছে। স্বাদে অতুলনীয় ও স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত উপকারী হওয়ায় শহুরে জীবনে এর ব্যাপক চাহিদা তৈরি হয়েছে। পরিবারের জন্য পুষ্টিকর সবজি পেতে বা বাণিজ্যিক উদ্দেশ্য-উভয় ক্ষেত্রেই মাইক্রোগ্রিন চাষের অপার সম্ভাবনা রয়েছে।

মাইক্রোগ্রিন কী

মাইক্রোগ্রিন হলো উদ্ভিজ্জ চারা, যা বীজ থেকে গজানোর পর এবং এর মূল পাতার (কটিলিডন) বিকাশের পরপরই কেটে নেওয়া হয়। এগুলো আকারে ছোট হলেও পুষ্টিগুণে ভরপুর এবং খাবারে স্বাদ যোগ করতে ব্যবহৃত হয়। প্রচলিত শাক-সবজির তুলনায় আকারে অনেক ছোট হলেও পুষ্টিগুণে অতুলনীয়। সাধারণত ৭ থেকে ১৪ দিনের মধ্যেই এটি খাওয়ার উপযোগী হয়ে ওঠে। এসব গাছের পাতা ও কাণ্ড যখন অঙ্কুরিত হয়ে দুই থেকে তিন ইঞ্চি লম্বা হয়, তখনই সেগুলো সংগ্রহ করা হয়। পালং শাক, সরিষা, মুলা, মেথি, ছোলা, গম, ভুট্টা, ব্রকোলি, কেল, বাঁধাকপি, লেটুস, লাল শাক, গাজর, বিট, সিলান্ট্রো, বেসিল, সূর্যমুখী এবং বিভিন্ন ধরনের লেগুম জাতীয় শস্য থেকে মাইক্রোগ্রিন তৈরি করা যায়। 

পুষ্টিগুণ

মাইক্রোগ্রিন পুষ্টিতে ভরপুর। সাধারণ সবজিতে যে পরিমাণ পুষ্টি পাওয়া যায়, মাইক্রোগ্রিনে তার চেয়ে কয়েক গুণ বেশি পাওয়া যায়। কারো কারো মতে, এ পুষ্টির পরিমাণ চার গুণ বেশি! ছোট্ট এই চারাগুলো ভিটামিন, খনিজ, অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট ও এনজাইমের এক অসাধারণ উৎস। গবেষণায় দেখা গেছে, পূর্ণাঙ্গ উদ্ভিদের তুলনায় মাইক্রোগ্রিনে অনেক বেশি পুষ্টি উপাদান কেন্দ্রীভূত থাকে। উদাহরণস্বরূপ, লাল বাঁধাকপির মাইক্রোগ্রিনে পূর্ণাঙ্গ বাঁধাকপির চেয়ে ছয় গুণ বেশি ভিটামিন সি এবং ৪৪ গুণ বেশি ভিটামিন ই থাকতে পারে। অন্যান্য মাইক্রোগ্রিনেও 

অ্যান্টি-অক্সিডেন্টের মাত্রা অনেক বেশি থাকে, যা শরীরের কোষের ক্ষতি প্রতিরোধে সাহায্য করে। ফ্ল্যাভোনয়েড, ক্যারোটিনয়েড ও পলিফেনলের মতো ফাইটোকেমিক্যালগুলো মাইক্রোগ্রিনে প্রচুর পরিমাণে থাকে, যা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় এবং দীর্ঘস্থায়ী রোগ থেকে রক্ষা করতে পারে। এটি হজমে সহায়তা করে, রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে এবং হৃদরোগের ঝুঁকি কমাতেও ভূমিকা রাখে।

মাইক্রোগ্রিনে সাধারণত ফাইবার, ভিটামিন সি, ই, কে, বিটা ক্যারোটিন, অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট, পটাশিয়াম, লৌহ ও ম্যাগনেশিয়ামের পরিমাণ বেশি থাকে। ফলে এটি হৃদরোগ, ডায়াবেটিস ও ক্যানসারের মতো রোগ প্রতিরোধে সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারে।

মাইক্রোগ্রিন চাষের সুবিধা

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে মাইক্রোগ্রিন চাষ নতুন হলেও ক্রমেই তা কৃষি ও খাদ্যচর্চায় গুরুত্বপূর্ণ স্থান করে নিচ্ছে। মাইক্রোগ্রিন চাষের সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো এর জন্য বড় জায়গার প্রয়োজন হয় না। ফ্ল্যাটের বারান্দা, রান্নাঘরের জানালা বা ছোট ছাদ, যেকোনো জায়গাতেই এটি ফলানো যায়। এটি কম সময়ে ফলন দেয়, ফলে দ্রুত ফসল তোলা যায় এবং নতুন করে আবার চাষ করা যায়। এ ছাড়া আবহাওয়ার ওপর তেমন নির্ভরশীল না হওয়ায় সারা বছর ধরেই চাষ করা সম্ভব। 

মাইক্রোগ্রিন চাষে জটিল যন্ত্রপাতির প্রয়োজন হয় না; কয়েকটি ট্রে, বীজ, মাটি বা কোকোপিট ও পানিই যথেষ্ট। কীটনাশক বা রাসায়নিক সারের ব্যবহার ছাড়াই স্বাস্থ্যকর মাইক্রোগ্রিন উৎপাদন করা যায়। যারা শহুরে জীবনযাত্রার ব্যস্ততার মধ্যে থেকেও স্বাস্থ্য সচেতন এবং কৃষির প্রতি আগ্রহী, তারা এটি ঘরে বসেই শুরু করতে পারে। 

চাষপদ্ধতি

মাইক্রোগ্রিন চাষের পদ্ধতি অত্যন্ত সহজ এবং বীজ নির্বাচন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অর্গানিক বা কেমিক্যালমুক্ত বীজ ব্যবহার করাই সবচেয়ে নিরাপদ। চাষের জন্য মূলত প্রয়োজন হয় একটি প্লাস্টিক ট্রে, কোকোপিট বা বালু-মাটির মিশ্রণ, পানি ছিটানোর বোতল ও আলো। প্রথমেই প্রস্তুত করতে হবে এর ট্রে। সাধারণত অগভীর ট্রে ব্যবহার করা হয়, যার নিচে আটকে থাকা পানি নিষ্কাশনের জন্য ছিদ্র থাকে। ট্রেতে ভালো মানের মাটি, কোকোপিট বা হাইড্রোপনিক মিডিয়া দিতে হবে। এরপর বীজ ট্রেতে সমানভাবে ছড়িয়ে দিতে হবে। বীজ ছড়ানোর পর হালকাভাবে মাটির একটি স্তর দিয়ে ঢেকে দিতে পারেন, তবে কিছু মাইক্রোগ্রিনের ক্ষেত্রে বীজ খোলা রাখাই ভালো। এরপর হালকাভাবে পানি ছিটিয়ে দিতে হবে, যাতে মাটি আর্দ্র থাকে। যেহেতু সূর্যের আলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, তাই ছাদ বা জানালার পাশে অথবা এলইডি গ্রো লাইট ব্যবহার করেও এই চাষ সম্ভব। তবে সরাসরি প্রখর সূর্যালোকে না রাখাই ভালো। 

প্রথম কয়েক দিন বীজ অঙ্কুরিত হওয়ার জন্য অন্ধকার জায়গায় রাখলে ভালো ফলাফল পাওয়া যায়। নিয়মিত পানি দিয়ে মাটিতে আর্দ্রতা নিশ্চিত করতে হবে। চারা যথেষ্ট বড় হয়ে গেলে এবং তাদের প্রথম মূল পাতা দেখা দিলে (সাধারণত ৭ থেকে ১৪ দিনের মধ্যে) কাঁচি দিয়ে মাটি থেকে একটু ওপরে কেটে সংগ্রহ করতে পারেন।

মাইক্রোগ্রিনের যত্নে কিছু টিপস

মাইক্রোগ্রিন চাষে কিছু বিষয় লক্ষ রাখা জরুরি। অতিরিক্ত পানি দেওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে, কারণ এতে বীজে পচন ধরতে পারে। আবার মাটি শুকিয়ে গেলেও চারা মারা যেতে পারে। সঠিক আলো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। পর্যাপ্ত আলো না পেলে চারা লম্বা ও দুর্বল হয়ে যেতে পারে। তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণও জরুরি। অতিরিক্ত গরম বা ঠান্ডা উভয়ই চারার বৃদ্ধিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। পর্যাপ্ত বাতাস চলাচল নিশ্চিত করতে হবে।

বাণিজ্যিক সম্ভাবনা

মাইক্রোগ্রিন চাষের একটি বিশাল বাণিজ্যিক সম্ভাবনাও রয়েছে। শহরাঞ্চলে টাটকা ও পুষ্টিকর খাদ্যের চাহিদা বাড়ছে। রেস্তোরাঁ, হোটেল ও স্বাস্থ্য সচেতন গ্রাহকরা উচ্চমানের মাইক্রোগ্রিনের জন্য ভালো দাম দিতে প্রস্তুত। যেহেতু এর জন্য জায়গা ও সময় কম লাগে, তাই ছোট আকারের কৃষি উদ্যোগের জন্য এটি একটি আদর্শ ফসল। অল্প বিনিয়োগে ভালো লাভ করা সম্ভব, যা বেকার যুবকদের জন্য একটি নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে পারে। স্থানীয় বাজার ও অনলাইন প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে সরাসরি গ্রাহকদের কাছে মাইক্রোগ্রিন বিক্রি করা যায়, যা মধ্যস্বত্বভোগীদের এড়িয়ে লাভজনক ব্যবসা প্রতিষ্ঠা করতে সাহায্য করে।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫