
এশিয়ার মাত্র কয়েকটি দেশের বনে-জঙ্গলে বাঘের বসবাস। বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে সাগরঘেঁষা নোনা জলাভূমির বাদাবন-সুন্দরবন হচ্ছে বাঘের প্রধান বিচরণস্থল। এই বাঘকে বলা হয় বেঙ্গল টাইগার। বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলে যেসব বাঘ পাওয়া যায়, বেঙ্গল টাইগার সেগুলো থেকে একেবারে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যময়। বনের এই দাপুটে প্রাণীটি একসময় বিশ্ব থেকে প্রায় নাই হতে চলেছিল, তখন বাঘ রক্ষায় তোড়জোড় শুরু হয়। ২০১০ সালে রাশিয়ার সেন্ট পিটাসবার্গ শহরে বাঘ আছে এমন দেশগুলোকে নিয়ে শীর্ষ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সেখান থেকেই বাঘ নিয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে ২৯ জুলাইকে বিশ্ব বাঘ দিবস পালনের ঘোষণা দেওয়া হয়। এর পর থেকেই আমাদের দেশেও দিনটি সাড়ম্বরে পালিত হয়।
সম্মেলনে আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তা হচ্ছে ২০২২ সালের মধ্যে বিশ্বে বাঘের সংখ্যা দ্বিগুণে পরিণত করতে হবে। সেই অনুযায়ী আমাদের দেশেরও বাঘ সুরক্ষা ও এর সংখ্যা বৃদ্ধিতে গুরুত্বারোপ করা হয়। বাঘের শুমারি অনুষ্ঠিত হয়। জানার চেষ্টা করা হয়, প্রকৃতপক্ষে বাঘের সংখ্যা কত? বাঘ জনপদে চলেও যাতে মানুষের হাতে মারা না পড়ে সেই লক্ষ্যে বনসংলগ্ন মানুষের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করার কার্যক্রম শুরু হয়। বন বিভাগের মতে, সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা আগের চেয়ে বেড়েছে। বলা হচ্ছিল, আগে বাঘের সংখ্যা ছিল ১১৪টি। এখন তা হয়েছে ১২৫টি, অর্থাৎ আগের তুলনায় ১১টি বাঘ বেড়েছে। গত বছরের (২০২৪) ৮ অক্টোবর বন বিভাগের পক্ষ থেকে সুন্দরবনে বাঘের এই সংখ্যা ঘোষণা করা হয়।
একসময় পৃথিবীতে বাঘের ৯টি উপপ্রজাতি ছিল। কিন্তু শতাধিক বছর আগে এর তিনটি প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে যায়। বর্তমানে টিকে আছে ছয়টি উপপ্রজাতির বাঘ। তবে আকৃতি এবং সৌন্দর্যে সুন্দরবনের বাঘ, অর্থাৎ বেঙ্গল টাইগার অন্যতম। ডোরাকাটা দাগ এর অনন্য বৈশিষ্ট্য। প্রতিটি বাঘের গায়ের এই ডোরাকাটা দাগ স্বতন্ত্র। মানুষের যেমন আঙুলের ছাপ (ফিঙ্গার প্রিন্ট) স্বতন্ত্র, তেমনি বাঘের ডোরাকাটা দাগও স্বতন্ত্র। যে কারণে ছবি তুলে এই ডোরাকাটা দাগ বিশ্লেষণ করে বাঘের সংখ্যা নিরূপণ করা হয়। এখনো বাঘ গণনার এটাই বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সাবেক অধ্যাপক আনোয়ারুল ইসলামের মতে, ‘সারা পৃথিবীতে বাঘের যত উপপ্রজাতি রয়েছে, সব উপপ্রজাতির চেয়ে সুন্দরবনের বাঘ শুধু ছোট, তাই নয়; এর ওজনও কম। সুন্দরবনের মেয়ে বাঘের গড় ওজন ৭৫ থেকে ৮০ কিলোগ্রাম (কেজি)। অন্যান্য অঞ্চলে পাওয়া মেয়ে বাঘের গড় ওজন ১৩৫ থেকে ১৪০ কেজি পর্যন্ত হয়ে থাকে।’
বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলের বাঘ মূলত গরু, মহিষ ও সাম্বার হরিণের মতো বড় প্রাণী খাবার হিসেবে গ্রহণ করে। কিন্তু সুন্দরবনের বাঘ চিত্রল হরিণ, শূকর ও বানরের মতো ছোট প্রাণী খায়। এর গায়ের রং হলুদ থেকে হালকা কমলা রঙের। গাঢ় খয়েরি থেকে কালো রঙের ডোরার রং। এই বাঘের পেটের রং সাদা। লেজ হলো কালো কালো আংটিযুক্ত সাদা রঙের। সুন্দরবনের বাঘ ভালো সাঁতার কাটতে পারে। সাধারণভাবে তারা খাবারের সন্ধানে নদী সাঁতরে পার হয়।
বাঘশুমারি
বাংলাদেশে সর্বপ্রথম বাঘশুমারি হয় ২০০৪ সালে। তখন বন বিভাগ ও ইউএনডিপির যৌথ উদ্যোগে সুন্দরবনে বাঘের পায়ের ছাপ গুনে একটি জরিপ পরিচালনা করে। সেই জরিপে বাঘের সংখ্যা বলা হয়েছিল ৪৪০টি। পরবর্তী সময়ে ২০১৫ সালে সর্বপ্রথম ক্যামেরা ট্র্যাপিংয়ের (ফাঁদ) মাধ্যমে বাঘ গণনা করা হয়। সেই জরিপে বলা হয়, সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা ১০৬টি। ২০১৮ সালের আরেকটি জরিপে বলা হয়, বাঘের সংখ্যা ১১৪টি। সর্বশেষ জরিপটি শুরু হয় ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে সুন্দরবনের পশ্চিম বন বিভাগে অর্থাৎ সাতক্ষীরা এবং খুলনা রেঞ্জে। পরে পূর্ব সুন্দরবনের চাঁদপাই ও শরণখোলা রেঞ্জের ছবি সংগ্রহ করা হয়।
সুন্দরবনের দুই হাজার ২৪০ বর্গকিলোমিটার এলাকায় জরিপটি পরিচালনা করা হয়। যেখানে মোট ৬৫৭টি ক্যামেরার ফাঁদ বসানো হয়। বাঘ বা যেকোনো প্রাণী ওই ক্যামেরার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় স্বয়ংক্রিয়ভাবে তার ছবি ওঠে। এভাবে ক্যামেরায় বাঘের ছবি ছিল সাত হাজার ২৯৭টি। এ ছাড়া সুন্দরবনের এক হাজার ৩০৬ কিলোমিটার খালপারে সরেজমিন জরিপে বাঘের পায়ের ছাপ গুনে বাঘের সংখ্যা ও ঘনত্ব পরিমাপ করা হয়। জরিপে প্রতি ১০০ বর্গকিলোমিটার এলাকায় ২.৬২টি বাঘের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। ক্যামেরায় মোট ৮৪টি বাঘের ছবি এবং বাকি ৪১টি বাঘ খাল জরিপের মাধ্যমে পাওয়া যায়।
জরিপের তথ্য অনুযায়ী, পশ্চিম সুন্দরবনে (খুলনা ও সাতক্ষীরা রেঞ্জ) বাঘের নারী-পুরুষের সংখ্যার ক্ষেত্রে বেশ পার্থক্য দেখা গেছে। ক্যামেরায় ধরা পড়া ৮৪টি বাঘের মধ্যে ২১টি নারী ও ৬২টি পুরুষ বাঘ। আর একটি বাঘ নারী না পুরুষ, তা নির্ধারণ করা যায়নি। খুলনা রেঞ্জে একটি পুরুষ বাঘের বিপরীতে ১২টি নারী বাঘ দেখা গেছে। অর্থাৎ ওই এলাকায় একটি বাঘ মারা গেলে পুরো এলাকা পুরুষ বাঘশূন্য হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। ফলে দীর্ঘ মেয়াদে সেখানে বাঘের সংখ্যা দ্রুত কমে যেতে পারে। অন্যদিকে সাতক্ষীরা রেঞ্জে বাঘের সংখ্যা কম। চোরা শিকারিদের কারণে এই অবস্থা হয়েছে বলে মনে করা হয়। শিকারিরা বাঘের বাচ্চা ও অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পাচার করে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন। সর্বশেষ জরিপে ২১টি শিশু বাঘের উপস্থিতি ধরা পড়েছে, যা আগের দুটি জরিপে (২০১৮ ও ২০১৫) ছিল মাত্র পাঁচটি। অবশ্য শিশু বাঘ গণনায় হিসাব করা হয় না।
বাঘ জরিপের জন্য সাধারণত সুন্দরবনে গাছের সঙ্গে মাটি থেকে ৫০ সেন্টিমিটার ওপরে ক্যামেরা বসানো হয়। ক্যামেরার সামনে দিয়ে বাঘ বা অন্য যেকোনো প্রাণী গেলে ক্যামেরা স্বয়ংক্রিয়ভাবে সেটির ছবি ও ১০ সেকেন্ডের ভিডিও ধারণ করে। এরপর প্রাপ্ত ছবি বন অধিদপ্তরের রিসোর্স ইনফরমেশন ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম ইউনিটে বিশ্লেষণ করে বাঘের সংখ্যা নির্ধারণ করা হয়। এ ছাড়া সুন্দরবনের খালে সাধারণত সব বাঘ পানি খেতে আসে। এতে খালের পারে বাঘের পায়ের ছাপ পড়ে। বাঘের আকৃতি ও ওজনের ওপর নির্ভর করে এর পায়ের ছাপ। এভাবে প্রতিটি পায়ের ছাপ বিশ্লেষণ করেও এর সংখ্যা নির্ধারণ করা হয়। তবে এই পদ্ধতিটি ত্রুটিমুক্ত নয় বলে মনে করা হয়। সুন্দরবনে ১৯৯৬-৯৭ সালে এবং ২০০৪ সালের এই পদ্ধতিতে জরিপ করা হয়, তাতে বাঘের সংখ্যা ৪০০ থেকে ৪৪০ বলা হয়েছিল। ২০১৫ সালের জরিপকে বলা হয় সর্বাধুনিক ও বিজ্ঞানসম্মত। ওই জরিপে সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশে বাঘের সংখ্যা পাওয়া যায় ১০৬টি। সংরক্ষণের কৌশলেই বাঘের ওই সংখ্যা বেড়ে এখন ১২৫-এ দাঁড়িয়েছে।
হরিণের সংখ্যা বেড়েছে
সুন্দরবনে হরিণের সংখ্যা বেড়েছে। বন বিভাগের পক্ষ থেকে সম্প্রতি এক জরিপে হরিণের সংখ্যা বেড়েছে বলে দাবি করা হচ্ছে। সাধারণভাবে বলা হতো, সুন্দরবনে ৮০ হাজার হরিণ আছে। বন বিভাগের একটি সূত্র মতে, সর্বশেষ জরিপে হরিণের সংখ্যা লক্ষাধিক বলা হচ্ছে।