Logo
×

Follow Us

প্রচ্ছদ প্রতিবেদন

গঠনের রাজনীতি বনাম ক্ষমতার রাজনীতি

Icon

ফ্লোরা সরকার

প্রকাশ: ০৯ আগস্ট ২০২৫, ১৩:০৩

গঠনের রাজনীতি বনাম ক্ষমতার রাজনীতি

আমরা ক্ষমতার রাজনীতি কিছুটা বুঝলেও গঠনের রাজনীতি একেবারেই বুঝি না। রাষ্ট্র বলতে আমাদের মাথায় চেপে বসে থাকে একদল শাসন করবে এবং আরেকদল শোষিত হবে। এই বিষয়টিকে আমরা খুব স্বাভাবিকভাবে মেনে নিয়েছি। যেন এমনই হওয়ার কথা। বিষয়টিকে কখনো তলিয়ে দেখি না। আমরা আরো মনে করি, ‘ক্ষমতা’ মানেই একটা সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে একদল মানুষ শাসকের ক্ষমতায় বসবে এবং শাসনের নামে কখনো কখনো শোষণ করবে বা করতেও পারে। আমরা আরো ম নে করি, দেশে ‘সংবিধান’ নামের একটি সর্বোচ্চ আইনের বই থাকবে, যে আইনের বই দ্বারা নির্বাচিত সংসদ সদস্যরা রাষ্ট্র পরিচালনা করবেন। আইন মানুষই তৈরি করে, যাকে আমরা পজিটিভ ল বলি। মানুষের এই আইন বলপ্রয়োগের দ্বারা বলবৎযোগ্য। মিশেল ফুকোর ভাষায় এই যে আদেশ বা আইন দিয়ে বেঁধে ফেলা এটা এক ধরনেরর Anti Energy বা এক ধরনের প্রতিশক্তি, যার আসলে গঠন করার কোনো ক্ষমতাই নেই। 

অন্যদিকে আইন এবং ক্ষমতার সম্পর্ক অবিচ্ছিন্ন-এটা ওয়াল্টার বেঞ্জামিন অনেক আগেই বলে গেছেন। অন্যদিকে প্রকৃতিগত বা স্বাভাবিক নীতি-নৈতিকতা, সামাজিক বিধান বা ধর্মীয় বিধান কোনো ক্ষমতাশালীর আদেশ বা স্বাভাবিক আইন হিসেবে সব সময় জারি থাকে। যাকে প্রাকৃতিক আইন বলতে পারি। কাজেই পজিটিভ ল বা মানুষের তৈরি আইন এবং প্রাকৃতিক আইনের মধ্যে পার্থক্যটা মনে রাখা দরকার। এখান থেকে বলতে পারি, পজিটিভ ল এবং প্রাকৃতিক আইনের সমন্বয়ে কিভাবে একটা রাষ্ট্রে আইন গঠিত হতে পারে, সেদিকে আমাদের চিন্তা করার দরকার আছে। এখানেই গঠনের প্রশ্নটা উঠে আসে। আমরা মনে করি, শাসকরা যেভাবে আমাদের আইন দিয়ে গঠন করবে, আমরা সেভাবে গঠিত হব। তার মানে আমরা ধরেই নেই, আমাদের নিজেদের নিজেরা গঠিত হওয়ার কোনো ক্ষমতা বা সামর্থ্য নেই। এখান থেকেই গঠনের রাজনীতি শুরু হয়। গঠনের রাজনীতি এবং ক্ষমতার রাজনীতি আসে  সার্বভৌমত্বের হাত ধরে। প্রশ্ন হলো সার্বভৌমত্ব কী?

সার্বভৌমত্ব হলো আদেশ দেওয়ার সর্বোচ্চ বা সর্বময় ক্ষমতা, যা ওপর থেকে আসে। সার্বভৌমত্বের ধারণা প্রথম আসে ইউরোপ বা পশ্চিম থেকে, ফরাসি আইনবিদ জিন বোদিনের (১৫৩০-১৫৯৬) হাত ধরে, তার বিখ্যাত লেখা One Sovereiginty থেকে। যে সার্বভৌমত্বের ধারণা নিয়ে পরবর্তী সময়ে আধুনিক রাষ্ট্রগুলো গড়ে উঠেছে। যেহেতু বোদিনের সময়ে রাজতন্ত্র ছিল, তাই তার মতে রাজাই সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। রাজা আইন প্রণয়ন করেন, কিন্তু তিনি নিজে থাকেন আইনের ঊর্ধ্বে। বোদিনের আগে এই ক্ষমতা ছিল গির্জার হাতে, যার এক লম্বা ইতিহাস আছে। সেদিকে যাওয়ার দরকার নেই। বোদিনের পরে এই সার্বভৌম ক্ষমতা চলে যায় জনগণ তথা রাষ্ট্রের হাতে। জনগণের নামে রাষ্ট্র অর্থাৎ রাষ্ট্রের কর্তাব্যক্তিরাই সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হয়ে উঠল। মাঝখান থেকে জনগণ গেল হারিয়ে। অনেকটা পুরোনো মদ নতুন বোতলে ঢালার মতো ব্যাপার। 

ইংরেজ ইতিহাসবিদ লর্ড অ্যাকটনের (১৮৩৪-১৯০২) ক্ষমতা নিয়ে বিখ্যাত একটা উক্তি আছে, ‘Power tends  to corrupt and absolute power corrupts absolutely’। ঠিক যে বিষয়টি ১৫ বা ১৬ বছর ধরে গত হাসিনা শাহি সরকারের সময় থেকে দেখে এসেছি।

দীর্ঘদিন একটা দেশে এভাবে ক্ষমতার অপব্যবহার চলতে থাকলে একটা সময় আসে যখন জনগণের দিক থেকে প্রতিবাদ-প্রতিরোধ গড়ে উঠতে থাকে। গড়ে ওঠার এই সময়টাই গঠনের রাজনৈতিক প্রক্রিয়া। জনগণ নিজে থেকেই বুঝতে পারে শোষণের কতগুলো মুখ। গঠনের এই রাজনৈতিক প্রতিফলন দেখেছি গত বছর ৫ আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে। সেদিন জনগণ বুঝেছিল, সার্বভৌম ক্ষমতা শুধু রাষ্ট্রের হাতে থাকে না, জনগণের হাতেও থাকে। জনগণ ইচ্ছা করলেই এই ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারে। কিন্তু ক্ষমতার প্রয়োগ মানে এই না যে, রাষ্ট্র শাসনে বসে যাওয়া। গণ-অভ্যুত্থানও শেষ কথা নয়। 

গণ-অভ্যুত্থান হলো জনগণের গাঠনিক ক্ষমতার একটি মুহূর্ত মাত্র। কিন্তু সেই মুহূর্তকে ধরে রাখা জনগণের কাজ। আধুনিক রাষ্ট্রের সার্বভৌম ক্ষমতার ধারণার বিপরীতে গড়ে উঠেছে গঠন বা গাঠনিক ক্ষমতার ধারণা। আধুনিক রাষ্ট্রের এই সার্বভৌম ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ করে জনগণের গাঠনিক ক্ষমতা এবং এই কারণেই বলা হয়ে থাকে গণতন্ত্র এবং জনগণের গাঠনিক ক্ষমতা সমার্থক। 

এই বিষয় নিয়ে লেখক ও ভাবুক ফরহাদ মজহার তার ‘গণ-অভ্যুত্থান ও গঠন’ বইয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিছু কথা লিখেছেন, “গণসার্বভৌমত্ব নিছকই রাজা-বাদশার কবজা থেকে জনগণের কাছে সার্বভৌম ক্ষমতা হস্তান্তর নয়। পাশ্চাত্যে সার্বভৌম ক্ষমতার যে বিবর্তন ঘটেছে সেই রূপান্তরকে নিছক ক্ষমতার হস্তান্তর হিসেবে বিবেচনা করা যায় না এবং করা উচিত নয়। পাশ্চাত্যের রাজনৈতিক ও দার্শনিক ইতিহাস পর্যালোচনা করলে সার্বভৌম ক্ষমতার দুটি আলাদা অর্থ পাশাপাশি বেড়ে উঠেছে দেখা যায়। একদিকে রাষ্ট্রের সার্বভৌম ক্ষমতা বলতে আদেশ, নির্দেশ, শৃঙ্খলার ধারণা তো আছেই আর তার পাশাপাশি রয়েছে জনগণের সার্বভৌম ক্ষমতার ধারণা, যা রাষ্ট্রের সার্বভৌম ধারণা থেকে আলাদা। জনগণের সার্বভৌম ক্ষমতা সব সময়ই গাঠনিক ক্ষমতা হিসাবে হাজির হয়েছে, সে কারণে গঠন ও গাঠনিক ক্ষমতা ইত্যাদি সার্বভৌমত্বের সম্পূর্ণ ভিন্ন তাৎপর্য হাজির করে। এই ভিন্নতা বিচারের মধ্য দিয়ে গণতন্ত্রকে আমরা নতুনভাবে হয়তো আবিষ্কার করতে পারি।”

উদ্ধৃতিটা একটু বড় হলো এই কারণে, যাতে করে জনগণের গাঠনিক ক্ষমতাকে আরো ভালোভাবে বুঝতে পারি। এই কারণে রাজনৈতিক তাত্ত্বিক অন্দ্রে ক্যালিবাস (১৯৬৭-) তার Political concepts, A crritical lexicon নিবন্ধে লিখেছেন, ‘Over the long histtory of modern political thought in the western world, sovereignty as constituent power was systematically overshadowed by the competing doctrine of sovereignty as highest power of command’, অর্থাৎ ‘পশ্চিমা জগতের আধুনিক রাষ্ট্রের যে ধারণা এবং তার যে দীর্ঘ  ইতিহাস, সেখানে গাঠনিক আকারে সার্বভৌমত্বের মডেলকে ধারাবাহিকভাবে বা সুকৌশলে ধামাচাপা দিয়ে রাখা হয়েছে।’ 

তাহলে দেখতে পেলাম, জনগণের গাঠনিক রাজনীতি অনেক শক্তিশালী হতে পারে। এই শক্তি শুধু ৫ আগস্টেই শেষ হয়ে যায় না বা যাবে না। ৫ আগস্ট হলো তার সূচনাবিন্দু। বাংলাদেশে এর আগে বেশ কয়েকটা 

গণ-অভ্যুত্থান হয়েছিল। কিন্তু সেসব অভ্যুত্থানে মানুষের গাঠনিক ক্ষমতা তৈরি করতে পারেনি। এই কারণে সেসব অভ্যুত্থান উত্থিত হয়েই বিলীন হয়ে গিয়েছিল। এর পেছনে প্রধান কারণ হিসেবে আবার ফরহাদ মজহারের শরণাপন্ন হতে হচ্ছে, ওই একই বইয়ে, যে বইটি ২০২৩ সালের আগস্টে প্রকাশিত হয়েছিল এবং সেখানে তিনি অত্যন্ত দূরদর্শিতার সঙ্গে গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে করণীয় সম্পর্কে লিখেছেন এবং লিখতে গিয়ে উনি ধরেই নিয়েছিলেন, সেই অন্তর্বর্তী সরকার হবে বিপ্লবী সরকার। সেটা বাস্তবে না পেলেও কথাগুলো খুব গুরুত্বপূর্ণ। তিনি লিখেছেন, ‘অন্তর্বর্তীকালীন বিপ্লবী সরকার বিদ্যমান সংবিধান কিংবা বাংলাদেশের বাস্তবতায় বিদ্যমান ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রব্যবস্থার সংবিধান মেনে ‘বিজয়’ লাভ করে না। ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রব্যবস্থার উৎখাত মানে বিদ্যমান ফ্যাসিস্ট সংবিধানেরও উৎখাত। জনগণের ‘বিজয়’ লাভের পর পুরোনো ফ্যাসিস্ট সংবিধান জনগণের ওপর চাপিয়ে দেওয়া এবং সেই সংবিধানের কিছু সংস্কার করে নির্বাচন দাবি চরম আত্মঘাতী দাবি।”  

কিছু অবুঝ জনগণ আছে যারা মনে করে এবং এখনো করে যাচ্ছেন, হাসিনা নেই তো কোনো সমস্যা নাই। কাজেই একটা নির্বাচন দিয়ে ক্ষমতা বদলের পালা শুরু হয়ে যাক। কিন্তু তারা একবারও বোঝেন না, বুঝতে চান নাÑহাসিনা নেই মানে এই না যে ভবিষ্যতে আর কোনো হাসিনার আগমন ঘটবে না। ‘হাসিনা’ শব্দবন্ধের ভেতরে স্বৈরতন্ত্রের পাশাপাশি ক্ষমতার রাজনীতি আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে। যদি এখনো ক্ষমতার রাজনীতির সঙ্গে গঠনের রাজনীতির সম্পর্ক বা পার্থক্য না বুঝি, তাহলে ভবিষ্যতে আবার একই স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের ভেতরে ঘুরপাক খেতে হবে। এখান থেকে আমরা আর উদ্ধার পাব না। 

৫ আগস্ট, শুধু একটা সামান্য তারিখ না। ৫ আগস্ট বাংলাদেশের জন্য একটা মাইলফলকের তারিখ। তাই সময় থাকতেই আমাদের অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে চলতে হবে একটা সুস্থ, সুন্দর, মর্যাদাপূর্ণ ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ গড়ার জন্য।


লেখক : শিক্ষক ও অভিনেত্রী

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫