Logo
×

Follow Us

প্রচ্ছদ প্রতিবেদন

বাংলাদেশি খোঁজার হিন্দুত্ববাদী চোখ

Icon

শাহেরীন আরাফাত

প্রকাশ: ১৪ আগস্ট ২০২৫, ১১:২১

বাংলাদেশি খোঁজার হিন্দুত্ববাদী চোখ

কলকাতায় বিজেপি-শাসিত রাজ্যে বাংলাভাষী অভিবাসীদের হয়রানির প্রতিবাদে ২ আগস্ট এক বিক্ষোভে অংশ নেওয়া আন্দোলনকারীরাছবি : পিটিআই

বরাবরের মতোই মানুষকে আলাদা ও বিভক্ত করার রাজনীতি চালিয়ে যাচ্ছে ভারতের ক্ষমতাসীন দল ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি)। এতে পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেস সুযোগ পাচ্ছে নিজেকে বাংলা ভাষা ও বাঙালি জাতিসত্তার রক্ষাকর্তা হিসেবে তুলে ধরার।

বাংলা ভাষাকে ‘বাংলাদেশি ভাষা’ বলা সম্ভবত এক অজ্ঞ পুলিশ সদস্যের ভুল; যিনি বিজেপির প্রচারিত অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের হাত থেকে পশ্চিমবঙ্গকে ‘শুদ্ধ’ করার আবেগী প্রচারণায় বুঁদ ছিলেন। কিন্তু এই মন্তব্যই আগুনে ঘি ঢেলেছে, মায়ের ভাষাকে অপমান করার অভিযোগে পশ্চিমবঙ্গের ঘুমন্ত বাঙালি জাতীয়তাবাদ জেগে উঠেছে।

ভুলটিকে আরো বাড়িয়ে দিয়েছেন বিজেপি নেতা ও মিডিয়া প্রচারক অমিত মালব্য। তিনি মনগড়া যুক্তি দেখিয়ে বলেছেন, ‘বাংলা বলে কোনো ভাষা নেই।’ এই বক্তব্য কার্যত বাংলার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা, যা পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ‘ভাষা আন্দোলন’-কেন্দ্রিক রাজনৈতিক সংগঠনের সুযোগ এনে দিয়েছে। এমন সময়ে এই ইস্যু তাকে রাজনৈতিকভাবে বাঁচিয়ে দিয়েছে, যখন জনপ্রিয়তা থাকা সত্ত্বেও তার সরকার ও তৃণমূল কংগ্রেস নিয়ে অসন্তোষ বাড়ছিল।

বাংলাভাষীরা বিজেপি নেতৃত্বের ভাষাসংক্রান্ত অজ্ঞতায় ক্ষুব্ধ-বিশেষ করে বাংলা লিপি ও প্রমিত বাংলা ভাষা এবং উপভাষার পার্থক্য না বোঝায়। ভাটির পশ্চিমে পশ্চিমবঙ্গ আর পূর্বে পূর্ববঙ্গ-ভাষা এক হলেও উপভাষায় স্পষ্ট আঞ্চলিক ভিন্নতা রয়েছে। এখন এমন জনমত গড়ে উঠেছে যে, বিজেপি বাংলাভাষীদের প্রতিনিধি হতে পারে না। ‘বাংলাদেশি ভাষা’ মন্তব্যে বিজেপি রাজনৈতিকভাবে এতটাই বিচ্ছিন্ন হয়েছে যে তৃণমূল কংগ্রেস ও বামফ্রন্ট (যার নেতৃত্বে সিপিআইএম) অস্বস্তিকর রাজনৈতিক সঙ্গী হয়ে দাঁড়িয়েছে।

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক সুপ্রিয়া চৌধুরীর ভাষায়, ‘বিভিন্ন জেলায় বিভিন্নভাবে বলা বাংলা আসলে বাংলার উপভাষা-মানে বাংলা একটাই ভাষা, তার বহু আঞ্চলিক রূপ আছে। ঐতিহাসিকভাবে শান্তিপুর উপভাষা কলকাতায় গড়ে উঠে মান ভাষা হয়েছে। আমার নিজেরও এই বিতর্কে আবেগী সংযোগ আছে-আমি পূর্ববঙ্গীয় পরিবার থেকে এসেছি, যেখানে বাড়িতে বিক্রমপুরের উপভাষায় কথা বলা হতো। বিক্রমপুর অবস্থিত ঢাকার উপকণ্ঠে।’

প্রশ্ন উঠছে তাহলে কি পাঞ্জাবি ও উর্দু পাকিস্তানি ভাষা? যদি বিজেপির রাজনৈতিক উন্মাদনায় বাংলা হয়ে যায় ‘বাংলাদেশি’, তবে পাঞ্জাবিও ‘পাকিস্তানি’। এই বিভাজন ছোট ভাষাগোষ্ঠীর জন্যও সমস্যা তৈরি করে, যেমন-সিন্ধি বা মুলতানি ভাষাভাষীরা। সিন্ধু ও মুলতান পাকিস্তানে; তাহলে কি তাদের ভাষাও পাকিস্তানি?

আসাম, মেঘালয়, অরুণাচল প্রদেশ ও ত্রিপুরার অনেক মানুষ বাংলা বলেন; তাদের উচ্চারণ ও শব্দচয়ন থেকেই বোঝা যায় তারা কোথাকার। যেমন-বিজেপির পশ্চিমবঙ্গের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর বাংলা ও বিজেপির সাবেক ত্রিপুরা মুখ্যমন্ত্রী বিপ্লব দেবের বাংলায় পার্থক্য স্পষ্ট। এই পার্থক্য লক্ষ্য করলে সহজেই বোঝা যায় যে, বিজেপি হয়তো না বুঝে ভাষাযুদ্ধে নামেনি। তবে বাংলাভাষীদের বিরুদ্ধে এ লড়াই খুব সহজ হবে বলে মনে হচ্ছে না। এর আগে হিন্দি চাপিয়ে দেওয়ার বিরুদ্ধে তামিল জাগরণের উদাহরণও রয়েছে ভারতে।

হিন্দি প্রসঙ্গ

প্রকৃত অর্থে হিন্দি ব্রিটিশ আমলে তৈরি এক মান ভাষা। কলকাতার ফোর্ট উইলিয়ামে জন বার্থউইক গিলক্রিস্ট সেনাবাহিনীর নানা উপভাষার বিশৃঙ্খলা সামাল দিতে একটি মান রূপ গড়ে তোলেন। ভারতের ২০০১ সালের জনগণনা অনুযায়ী, হিন্দির আওতায় ৪৯টি ভাষা-উপভাষা আছে। জি এন দেবীর ‘পিপলস ল্যাঙ্গুয়েজ সার্ভে অব ইন্ডিয়া’ আরো বহু ভাষাকে হিন্দির অন্তর্ভুক্ত দেখিয়েছে। ভাষা ব্যবহারের ধারায় উপভাষা কখনো কখনো সরকারিভাবে স্বীকৃত ভাষায় পরিণত হয়, যেমন-গোয়া রাজ্য হওয়ার পর কোকনি মারাঠির উপভাষা থেকে আলাদা ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পায়। তাই যদি বাংলা ভাষা না হয়; তবে হিন্দি, গুজরাটি, মারাঠিও নয়; কারণ সেগুলোরও অসংখ্য আঞ্চলিক রূপ আছে।

বাংলার বিবর্তন ও বহিরাগত রাজনীতি

সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়ের ‘দ্য অরিজিন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অব দ্য বেঙ্গলি ল্যাংগুয়েজ’ বাংলার ইতিহাস ও বিবর্তনের এক অনন্য দলিল, যেখানে দেখা যায় আরবি, তুর্কি, ফারসি, ইংরেজি প্রভৃতি ভাষা থেকে শব্দ গ্রহণ করেছে বাংলা এবং আজও হিন্দি ও ইংরেজি থেকে নতুন শব্দ নিচ্ছে।

যাদের পূর্বজরা পূর্ববঙ্গ থেকে পশ্চিমবঙ্গে গেছেন, তাদের উপভাষা নিয়ে গর্ব প্রবল। ১৯৪৭ সালের আগে বা পরে হিন্দু, বৌদ্ধ, মুসলিম নির্বিশেষে, পূর্ববঙ্গ থেকে আসা মানুষ তাদের স্থানীয় উপভাষা সঙ্গে এনেছেন। তিন প্রজন্ম পরও তরুণেরা বাড়িতে মা-বাবা ও দাদা-দাদির সঙ্গে সেই ভাষায় কথা বলেন এবং তা বাঁচিয়ে রাখতে চান। কিন্তু হিন্দুত্ববাদীরা ইচ্ছাকৃতভাবে এই আবেগ উসকে দিয়েছেন, যার ভেতরে রয়েছে বাংলাদেশি-বিদ্বেষ, মুসলিম-বিদ্বেষ ও ইসলামোফোবিয়া।

‘বাংলা বলে কোনো ভাষা নেই’-এই দাবি প্রমাণ করেছে, বিজেপি পশ্চিমবঙ্গে এক বহিরাগত দল, যা ভাষা, পরিচয়, স্মৃতি ও ইতিহাসের সাংস্কৃতিক যোগসূত্র বোঝে না এবং বোঝার চেষ্টাও করে না।

শব্দ-ভিন্নতা, মুসলিম-বিদ্বেষ ও ভোটাধিকার সংকট

‘জল’-এর বদলে ‘পানি’-এর মতো পার্থক্যকে হাতিয়ার করে বিজেপির ‘শুদ্ধীকরণ’ এজেন্ডা আসলে মুসলিম-বিদ্বেষে ভর করে মোগল আমলের প্রভাব মুছে ফেলার প্রয়াস। ফলে বিভাজন গভীর হয় এবং জনমতকে শাসননীতির জবাবদিহি থেকে সরিয়ে আনা যায়।

এ ছাড়া লক্ষণীয়, ভাষা-অনুপ্রবেশ-অবৈধ নাগরিক ইস্যুতে সোশ্যাল মিডিয়া ও টেলিভিশনের চাঞ্চল্য ঢেকে দিয়েছে আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়-নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা। বিহারে ভোটার তালিকার ‘স্পেশ্যাল ইনটেনসিভ রিভিশন’ প্রক্রিয়া সন্দেহের ভিত্তিতে মানুষকে ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত করার হাতিয়ার হয়ে উঠেছে। এতে প্রমাণের দায় ভোটারের ওপর চাপানো হয়েছে, যা আইনের মূলনীতির উল্টো; যেখানে প্রমাণের দায়িত্ব কমিশনের। ফলে ইসির এই প্রক্রিয়া কার্যত নাগরিকত্ব নির্ধারণের অস্ত্রে পরিণত হয়েছে। আর এসবের মূলে রয়েছে ভারতের রাজনীতিতে বিদ্যমান বাংলাদেশ-বিদ্বেষ, মুসলিম-বিদ্বেষ ও ইসলামোফোবিয়া; যা বাংলাদেশের চব্বিশের জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর ভারতীয় মিডিয়ার প্রপাগান্ডা মেশিন ও রাজনৈতিক দলগুলোর কর্মকাণ্ডে খুবই স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫