Logo
×

Follow Us

প্রচ্ছদ প্রতিবেদন

প্রযুক্তির ছায়ায় ঐতিহ্য ম্লান

Icon

মনিরা তাবাস্‌সুম

প্রকাশ: ১৬ আগস্ট ২০২৫, ১১:৫৩

প্রযুক্তির ছায়ায় ঐতিহ্য ম্লান

হারিকেন থেকে পালকি, রিকাবি থেকে মুচির দোকান কালের স্রোতে হারিয়ে যাওয়া সেসব পেশা ও মানুষ; যাদের হাতে ছিল জীবনের ঘ্রাণ আর শিল্পের ছোঁয়া। একসময় ছিল, যখন বিদ্যুৎ ছিল না। বাতাসে কেরোসিনের গন্ধ মিশে থাকত, যাতায়াতের বাহন ছিল পালকি, আর খাবার পরিবেশন হতো কাঁসার রিকাবিতে। বাড়ির আঙিনায় কুপি বাতি জ্বালিয়ে সুর করে পুঁথি পড়ে শোনাতেন বাড়ির বয়স্ক ব্যক্তিটি। এগুলো ছিল আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অংশ, ছিল চেনা সমাজের পরিচিত চিত্র। কিন্তু সময় বদলে গেছে। প্রযুক্তি আর আধুনিক পণ্যের স্রোতে পাল্টে গেছে সমাজব্যবস্থা। মানুষের প্রয়োজন আর রুচিও বদলে গেছে নিঃশব্দে। আর সেই বদলের ছায়া সবচেয়ে বেশি পড়েছে এমন কিছু পেশার ওপর, যার কোনো লিখিত ইতিহাস নেই; যেগুলোর অস্তিত্ব শুধু হাতের কাজে, স্মৃতির পাতায়।

পালকির বিলুপ্ত যাত্রা

এককালে বাঙালির আভিজাত্যের প্রতীক ছিল পালকি। নববধূর শ্বশুরবাড়ি যাত্রা হোক কিংবা জমিদারের বাইরে বের হওয়া-সবখানেই পালকির জৌলুস ছিল চোখে পড়ার মতো। সে পালকির কাঠামো বানাতেন যারা, তারা ছিলেন শিল্পী-কারিগর। বাঁশ, কাঠ, কাপড় আর রঙে তাদের হাতে তৈরি হতো চলমান এক রাজকীয় আসন। বাঁশ বাঁকিয়ে কাঠামো, গামছায় মোড়া আবরণ, আর রঙে আঁকা ফুল-লতায় তৈরি হতো এক একটি পালকি । বিয়ের মৌসুমে এক পা-ও বিশ্রাম মিলত না কারিগরদের। কিন্তু রিকশা আর মোটরযানের যুগ এসে পাল্টে গেল চিত্রপট। রাস্তা থেকে হারিয়ে গেল পালকির শব্দ, আর কারিগরেরা হারিয়ে গেলেন কোলাহলের আড়ালে। কেউ হলেন রাজমিস্ত্রি, কেউ শুরু করলেন কৃষিকাজ। আজ পালকির অস্তিত্ব শুধু জাদুঘরে।

রিকাবির নিঃশব্দ বিদায়

বিয়েবাড়িতে খাবার পরিবেশনের পাত্র হিসেবে কাঁসার থালা ও রিকাবির ব্যবহার ছিল চোখে পড়ার মতো। সেই ছোট্ট পাত্রে থাকত দই, মিষ্টি, পান, সুপারি। শুধু পাত্র নয়, এটি ছিল রুচির প্রতীক। চাঁপাইনবাবগঞ্জ, যশোর, পাবনা এমন অনেক অঞ্চলে ছিল রিকাবি বানানোর ছোট ছোট গ্রাম। কাঁসা-পিতল মিশিয়ে কারিগরের হাতুড়ির ঘায়ে তৈরি হতো নিখুঁত একেকটি পাত্র। প্রতিটি পাত্রেই থাকত হৃদয়ের ছাপ। কিন্তু সময় একে ঠেলে দিল কোনায়। স্টিল আর প্লাস্টিক ঢুকে পড়ল ঘরে ঘরে। কারিগরের ঠং ঠং শব্দ থেমে গেল। সবচেয়ে বড় ক্ষতিটা হলো উত্তরসূরি হারিয়ে যাওয়া। এখন আর কেউ এই পেশায় আসতে চায় না। আজ রিকাবি পড়ে থাকে শোকেসে কিংবা বারান্দার ধুলোর নিচে। 

হারিকেন ও কুপি বাতির স্মৃতি 

একটা সময় সন্ধ্যা নামলেই বাড়ির কোনায় হারিকেন জ্বালানো হতো। টিনের সেই হারিকেনে সলতে পরানো, কেরোসিন ঢালা, ঝকঝকে চিমনির ভেতরে ধিকধিক জ্বলতে থাকা আগুনÑএই দৃশ্য এখন আর চোখে পড়ে না। গ্রামে আগের রান্নাঘরে চুলার পাশে জ্বলতে দেখা যেত কেরোসিনের কুপি বাতি। পিতলের তৈরি সেসব বাতির নকশা আর আকৃতি ছিল ভিন্ন ও নজরকাড়া। এনার্জি বাল্ব আর বিদ্যুতের আলো এসে হারিকেন, কুপি বাতি ও স্টোভকে সরিয়ে দিয়েছে। আজ এগুলো কেবল সিনেমার দৃশ্য অথবা সংগ্রহশালার শোভা।

আধুনিকতার ছায়ায় হারিয়ে যাওয়া সুর

ঢাক-সানাই বাজনা ছাড়া বাঙালির বিয়ে আর উৎসবগুলো ভাবাই যেত না। সুর, তাল, লয় আর সুরের মূর্ছনার সঙ্গে জড়িয়ে থাকত উৎসবের আনন্দ। ঢাকিরা ছিল এক বিশেষ শ্রেণির মানুষ, যাদের হাতে বাজনার ছন্দের সঙ্গে ছিল সমাজের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও 

সংস্কৃতির রেশ। তারা শুধু বাদ্যযন্ত্রী ছিলেন না, বরং জীবনের নানা প্রহর-ঘটনায় আনন্দ-বেদনার সঙ্গীও ছিলেন। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলে গেছে ছবি। বিয়ে বাড়িতে ডিজে, সাউন্ড সিস্টেমের আধিপত্য বেড়েছে। ঢাক-সানাইয়ের কদর কমেছে, সংকীর্ণ হয়ে এসেছে ঢাকিদের কাজ। এতে অনেকে কাজ হারিয়েছেন, চলে গেছেন ভিন্ন পেশায়। নতুন প্রজন্ম এই শিল্পের প্রতি আগ্রহ হারাচ্ছে। কেউ কেউ পরিবারে নিজেদের ঐতিহ্য ধরে রাখতে চাইলেও সে সুযোগ সীমিত। দুর্গাপূজাতেই কেবল ডাক পড়ে ঢাকিদের। শৌখিন কোনো বিত্তবানের বিয়ের আসরে কালেভদ্রে দেখা যায় সানাই বাদকদের। এই দুই বাদ্যযন্ত্রীই এখন নিভৃত এক জীবনে, যেখানে তাদের শিল্প কেবল স্মৃতির মধ্যে বেঁচে আছে। 

তালপাতার পুঁথির বিস্মৃত অধ্যায়

যখন ছাপাখানা ছিল না, তালপাতায় লেখা হতো জ্ঞানের ধারাপাত। বাঁশের কলমে কাঠ-কয়লা ও কর্পূরের কালি মেখে লেখক সাজাতেন পাতার পর পাতা। অথচ তারা আজ ইতিহাসের পাতায়ও নেই। পাতার ওপর চলত সূক্ষ্ম লেখনী, এই পুঁথি লেখা ছিল বছরের পর বছর একনিষ্ঠ পরিশ্রমের ফল। তালগাছের পাতা সংগ্রহ করে রোদে শুকিয়ে, সমান করে কেটে, ছিদ্র করে তাতে সুতা বাঁধা হতো। লেখার আগে পাতায় প্রলেপ দেওয়া হতো, যাতে তা যুগের পর যুগ টিকে থাকে। তাতে লেখা হতো পুরাণ, দর্শন, কবিগান, লোককথা কিংবা মন্দিরের নিয়মাবলি। প্রতিটি পুঁথির পাড়ে থাকত সূক্ষ্ম অলংকরণ। যাত্রাপালা থেকে ধর্মীয় ব্যাখ্যা সব কিছুই এই পুঁথির শরীরে বন্দি থাকত। ছাপাখানার আগমনে তালপাতার পুঁথির প্রয়োজন ফুরোল। হাতের লেখা পাতার আবেদন হারিয়ে গেল পাঠকের চোখে। আজকের প্রজন্ম জানেই না, কালি দিয়ে তালপাতায় কীভাবে লেখা হতো। এই পেশার মানুষের কথা খুব বেশি লেখা হয়নি। পাঠ্যবইয়ে তারা নেই, পুরস্কার বা সংবর্ধনায়ও তাদের নাম ওঠে না। অথচ তারাই লিখে গেছেন ‘শ্রীশ্রীচৈতন্য চরিতাবলী’, ‘ব্রজবিলাস’ বা ‘ধর্মমঙ্গল’-এর মতো অমূল্য সাহিত্য। আজ যে কয়টি পুঁথি অবশিষ্ট আছে, এগুলো জাদুঘরে বা কোনো পুরোনো বাক্সে পোকায় কাটা অবস্থায় পড়ে থাকে। তালপাতার পুঁথির পৃষ্ঠাগুলো তাই আজ শুধু কালের নীরব সাক্ষী, আর সেই লেখকরা সমাজের এক বিস্মৃত অধ্যায়।

প্রযুক্তির বিকাশ অনিবার্য, কিন্তু তার ছায়ায় ম্লান হয়ে যাচ্ছে বহু পেশা ও শিল্প, যা আমাদের সাংস্কৃতিক শিকড়ের অংশ। যদি সংরক্ষণের চেষ্টা না হয়, আগামী প্রজন্ম জানবে না, কখনো এই হাতেই গড়া হয়েছিল পালকি, ঢাক, তালপাতার পুঁথি কিংবা কাঁসার রিকাবি।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫