Logo
×

Follow Us

প্রচ্ছদ প্রতিবেদন

ঢাকাই মসলিন

অতীতের সুতায় ভবিষ্যৎ বয়ন

Icon

মনিরা তাবাস্সুম

প্রকাশ: ২১ আগস্ট ২০২৫, ১২:৪১

অতীতের সুতায় ভবিষ্যৎ বয়ন

‘হাতেতে লইলে শাড়ি মুইষ্ঠেতে মিলায়

মিরতিকাতে থুইলে শাড়ি পিঁপড়ায় লইয়া যায়।’

ময়মনসিংহের এই লোকগীতির বর্ণনা কল্পনাপ্রসূত নয়। ঐতিহ্য আর ইতিহাসের মিলমিশে তৈরি অপূর্ব এক সৃষ্টি মসলিন। পৃথিবীর সর্বোৎকৃষ্ট মানের সুতিবস্ত্র। নদী বিধৌত বাংলাদেশের ঢাকার খ্যাতির অন্যতম উৎস ছিল ঢাকাই মসলিন, যা তৈরি হতো শুধু ঢাকায়ই। আকাশের মতো নির্মল, স্ফটিকের মতো স্বচ্ছ আর পাখির পালকের মতো হালকা মসলিনকে বলা হতো ‘বোনা বাতাস’ (woven wind)। যার আরেক নাম ছিল ‘হাওয়ার ইন্দ্রজাল’ (Web of woven wind)। কিংবদন্তি রয়েছে, এক পুরো শাড়ি আঙুলের আঙটিতে গুঁজে রাখা যেত। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলে বাজার দখল আর কারিগরদের নিপীড়নের ফলে এই কাপড় প্রায় বিলুপ্ত হয়ে যায়। কিন্তু শত বছরেরও বেশি সময় পর, একদল গবেষক ও তাঁতশিল্পীর নিরলস প্রচেষ্টায় সেই হারানো ঐতিহ্য আজ ফিরে এসেছে।

হারিয়ে যাওয়া সূক্ষ্মতার গল্প

ঢাকাই মসলিন শুধু একটি কাপড় নয়, এটি ছিল একটি ঐতিহ্য। মসলিন বোনার আসল কৃতিত্ব ছিল এর বুননের সূক্ষ্মতায়। মিহি মসলিন শাড়ির জন্য সুতাও হওয়া লাগত মিহি। এই সুতা তৈরি করতে পারতেন শুধু সেই সব মেয়ে, যাদের আঙুল ছিল অত্যন্ত স্পর্শকাতর। যেকোনো রকম মানসিক অস্থিরতা কিংবা দুশ্চিন্তার মধ্যে সুতা কাটা যেত না বলে জনশ্রুতি আছে। সুতা কাটার জন্যও আবহাওয়া হতে হতো শিশির ভেজা। তাই ভোরে অথবা সন্ধ্যার সময়টিকে বেছে নেওয়া হতো। অথবা একটি পাত্রে পানি রেখে 

কৃত্রিম আর্দ্রতা তৈরি করা হতো। তার ওপরই কাটা হতো সুতা। বিশেষ ফুটি কার্পাসের তুলা থেকে তৈরি সে সুতা এতটাই নাজুক ছিল যে প্রখর সূর্যের তাপেও ছিঁড়ে যেত, সেই সুতা। 

তাঁতের বুননে কাপড় কতটা মোলায়েম আর টেকসই হবে তা নির্ভর করে বুননের থ্রেড কাউন্টের ওপর। অর্থাৎ প্রতি বর্গ ইঞ্চি কাপড়ে লম্বালম্বি এবং আড়াআড়ি কতগুলো সুতা ব্যবহৃত হয়েছে। সেটিকেই বলা হয় থ্রেড কাউন্ট। ৮০ থ্রেড কাউন্ট অর্থাৎ এক বর্গ ইঞ্চি কাপড়ে লম্বায় এবং আড়াআড়ি আঁশিটি সুতার বুনন থাকত।

ঢাকাই মসলিনের যে উত্তরসূরি জামদানি তাতে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই থ্রেড কাউন্ট থাকে ৪০ থেকে ৮০ বা ১০০ এর মধ্যে। কিন্তু সে যুগের ঢাকাই মসলিনে এই থ্রেড কাউন্ট হতো ৮০০ থেকে ১২০০-এর মধ্যে। আর এত বেশি থ্রেড কাউন্ট মানে হলো সেই কাপড় হতো অত্যন্ত নরম ও টেকসই।

ডোরাকাটা, মসৃণ, ছককাটা, রঙিন রং আর বুনন প্রণালি অনুযায়ী মসলিনকে ভাগ করা হতো। সূক্ষ্ম, ব্যাবহারিক আর বিন্যাসের পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন নাম ছিল মসলিনের। মলমল, আব-ই-রাওয়ান, শবনম, শরবন্দ, তনজেব, নয়নসুখ, বদনখাসৃ আরো কত কি! বেশির ভাগ নামই ফার্সি আর আরবি শব্দ থেকে উদ্ভূত। 

যদিও আমরা যে ঢাকাই মসলিনের কথা বলছি তা এক শতাব্দীরও বেশি আগে বিলুপ্ত হয়ে গেছে, কিন্তু অনেক দেশের জাদুঘরে পুরোনো মসলিনের শাড়ি, ওড়না বা অন্যান্য পোশাক দেখা যায়।

মসলিনের বিলুপ্তি

১৭১৮ শতকে মসলিন ছিল বাংলার প্রধান রপ্তানি পণ্য। লন্ডন, প্যারিস, রোমসহ সবখানে ঢাকার কাপড় ছিল আভিজাত্যের প্রতীক। তখনকার দিনে এক গজ ঢাকাই মসলিনের দাম ছিল ৫০ থেকে ৪০০ পাউন্ড পর্যন্ত। আজকের মূল্যমানে সাত হাজার থেকে ৫৬ হাজার পাউন্ড। সেই যুগের সবচেয়ে ভালো সিল্কের চাইতেও এই মসলিন ছিল ২৬ গুণ বেশি দামি।

কিন্তু ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের পর মসলিন শিল্পের পতন শুরু হয়। আঠারো শতকের শেষ থেকেই অন্ধকারাচ্ছন্ন হতে থাকে ঢাকাই মসলিনের স্বর্ণযুগ। ইতিহাসে মসলিন তাঁতিদের আঙুল কেটে দেওয়ার গল্প প্রচলিত থাকলেও আধুনিক গবেষকরা বলছেন, প্রকৃত কারণ ছিল করের চাপ, তুলা চাষের অপ্রতুলতা এবং ব্রিটিশ মিল-শিল্পের একচেটিয়া নীতি। উনিশ শতকের মাঝামাঝি এসে প্রায় পুরোপুরি বিলুপ্ত হয় মসলিন উৎপাদন।

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মতো ঔপনিবেশিক প্রতিষ্ঠানগুলো যেসব শিল্পের ওপর নির্ভর করত, তার সব খুঁটিনাটি তারা নথিভুক্ত করত। মসলিন তৈরির প্রতিটি ধাপের প্রক্রিয়ার বিস্তারিত বিবরণও লিখে রেখেছিল তারা।

ইউরোপে যখন বিলাসবহুল এই কাপড়ের চাহিদা বাড়ল তখন অপেক্ষাকৃত সস্তা সংস্করণ উৎপাদন করার তাগিদ তৈরি হলো। 

উত্তর-পশ্চিম ইংল্যান্ডের ল্যাংকাশায়ারের কাপড় ব্যবসায়ী স্যামুয়েল ওল্ডনো ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অর্জিত জ্ঞান আর নতুন প্রযুক্তির সমন্বয়ে উন্নত তাঁত দিয়ে লন্ডনের ক্রেতাদের জন্য বিপুল পরিমাণে কাপড় বানাতে শুরু করলেন। ১৭৮৪ সাল নাগাদ তার কারখানায় কাজ করত এক হাজার তাঁতি। তবে ব্রিটিশদের তৈরি মসলিন মানের দিক থেকে ঢাকাই মসলিনের ধারেকাছেও ছিল না।

এই মসলিন বানানো হতো সাধারণ তুলা দিয়ে। এর থ্রেড কাউন্টও ছিল অনেক কম। কিন্তু এর ফলে হঠাৎ করেই ঢাকাই মসলিনের চাহিদা কমে গেল, তার সঙ্গে ছিল দশকের পর দশকের অত্যাচার। দুয়ে মিলে ডেকে আনল ঢাকাই মসলিনশিল্পের মৃত্যু।

হারানো ঐতিহ্যের খোঁজে

বিলুপ্তির দেড় শতাব্দী পর ২০১৪ সালে বাংলাদেশ হ্যান্ডলুম বোর্ড ও বস্ত্র প্রকৌশলীরা মসলিন পুনরুদ্ধারের প্রকল্প হাতে নেন। প্রথম ধাপেই বড় চ্যালেঞ্জ ছিল ফুটি কার্পাস গাছের সন্ধান পাওয়া। ফুটি কার্পাসের বীজ সংগ্রহ, তুলা চাষ ও প্রাচীন বুনন কৌশল নিয়ে গবেষণা শুরু হয়। দীর্ঘ ছয় বছরের গবেষণায় তাঁতশিল্পীরা জামদানি বুননের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে শিখে নিলেন মসলিনের কৌশল। অবশেষে ২০২০ সালের শেষ দিকে ৫০০ কাউন্টের মসলিন শাড়ি তৈরি সম্ভব হয়। ২০২০ সালের ডিসেম্বরে এটি ‘Geographical Indication (GI)’ স্বীকৃতি পায়, যা এই ঐতিহ্যকে আন্তর্জাতিকভাবে সুরক্ষিত করে।

২০২০ সালে লন্ডনের ভিক্টোরিয়া অ্যান্ড অ্যালবার্ট মিউজিয়ামে বাংলাদেশের নতুন মসলিন প্রদর্শিত হয়, যা আন্তর্জাতিক মহলে ব্যাপক প্রশংসা পায়।

বাণিজ্যিকীকরণ ও নতুন দিগন্ত

২০২২ সালে সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে ঢাকাই মসলিনের পুনর্জন্ম ঘোষণা করে এবং নারায়ণগঞ্জের তারাবোতে শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে ‘Dhakai Muslin House'’ প্রতিষ্ঠা করে। এখানেই শুরু হয় দ্বিতীয় ধাপ। বাণিজ্যিক উৎপাদন ও বাজারজাতকরণ। লক্ষ্য ছিল কেবল ঐতিহ্য সংরক্ষণ নয়, বরং এটিকে অর্থনৈতিক শক্তিতে পরিণত করা।

এখন মসলিন উৎপাদনে যুক্ত হয়েছেন ৬০ জনেরও বেশি প্রশিক্ষিত কারিগর, কয়েক ধাপে যাচাই-বাছাইয়ের মাধ্যমে তাদের নির্বাচন করা হয়, যাদের অনেকে পূর্বে জামদানি বা অন্যান্য তাঁতের কাজে দক্ষ ছিলেন। আন্তর্জাতিক বাজারে প্রবেশের পরিকল্পনাও চলছে, যাতে ঢাকাই মসলিন আবার বিশ্ব ফ্যাশন জগতে জায়গা করে নিতে পারে।

অতীত থেকে ভবিষ্যতের বয়ন

ঢাকাই মসলিনের গল্প একদিকে যেমন হারানোর কষ্টের, অন্যদিকে তেমনি ফিরে পাওয়ার আনন্দের। এটি শুধু একটি কাপড়ের পুনর্জন্ম নয়, এটি বাংলার অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি, নদীভিত্তিক কৃষি ও শিল্পকৌশলের প্রতীক। সেই সূক্ষ্ম সুতায় আজ বাঁধা পড়েছে অতীতের গর্ব, বর্তমানের সাফল্য আর ভবিষ্যতের সম্ভাবনা।

আজ এটি তরুণ ডিজাইনারদের কাছে অনুপ্রেরণা এবং বাংলাদেশের কারুশিল্পের পুনর্জাগরণের কেন্দ্রবিন্দু। ঢাকাই মসলিনের গল্প এক অর্থে আমাদের শিল্প-অর্থনীতির উত্থান, পতন ও পুনর্জাগরণের গল্প।

ঢাকাই মসলিনের পুনর্জাগরণ কেবল একটি হারানো শিল্প ফিরিয়ে আনা নয়, এটি ইতিহাসের কাছে দায় মেটানোরও প্রচেষ্টা। যে সুতা একদিন বাংলার নদীর বাতাসে নেচে ইতিহাস লিখেছিল, আজ তা আবার নতুন করে বোনা হচ্ছে।

বাংলাদেশের হাতে তৈরি সেই কিংবদন্তি কাপড় হয়তো আবারও বিশ্বমঞ্চে নিজের জায়গা ফিরে পাবে শুধু ঐতিহ্য নয়, গৌরবের প্রতীক হয়ে।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫