Logo
×

Follow Us

প্রচ্ছদ প্রতিবেদন

নিষিদ্ধের ২৩ বছর পরও সদর্পে পলিথিন

Icon

আবুল বাসার সাজ্জাদ

প্রকাশ: ২৮ আগস্ট ২০২৫, ১০:১৬

নিষিদ্ধের ২৩ বছর পরও সদর্পে পলিথিন

প্রতীকী ছবি

২০০২ সালের ১ জানুয়ারি দেশে আইন করে পলিথিন ব্যাগ নিষিদ্ধ হয়। কিন্তু ২৩ বছর পর আজও বহাল তবিয়তে বাজারে টিকে রয়েছে পলিথিন ব্যাগ। এই দীর্ঘ সময়ের মধ্যে বিএনপি, সেনানিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক আর আওয়ামী লীগের তিনটি সরকার রাষ্ট্রক্ষমতায় ছিল, কিন্তু এর উৎপাদন ও বিক্রি তারা ঠেকাতে পারেনি। সেই ধারাবাহিকতায় অন্তর্বর্তী সরকারও এখন পর্যন্ত ব্যর্থই বলা যায়। পরিবেশ রক্ষায় জোর দিয়ে প্রায় এক বছর আগে পলিথিন ব্যাগ উৎপাদন ও বিক্রি নিষিদ্ধে তোড়জোড় শুরু করে। বছর ঘুরলেও এ বিষয়ে উল্লেখযোগ্য কোনো অগ্রগতি দৃশ্যমান নয়।  

পলিথিন ব্যাগের ক্ষতিকর দিক নিয়ে লেখালেখি, সভা-সেমিনার কম হয়নি, কিন্তু মানুষ বাজার করার ক্ষেত্রে বিকল্প ব্যাগ ব্যবহারে তেমন উৎসাহ দেখাচ্ছে না। পাটের ব্যাগের দাম তুলনামূলক বেশি এবং বহনের জটিলতার কারণেই মানুষ মূলত এটি ব্যবহারের আগ্রহ পাচ্ছেন না। ফলে পলিথিনের বিকল্পের জায়গায় শূন্যতা তৈরি হয়েছে। 

শুধু সুপারশপগুলোতে এই ব্যাগের ব্যবহার বন্ধ করা গেছে, কারণ দোকানগুলো নিয়ন্ত্রণ করা সহজ বা উদ্যোক্তারা আইন মেনে ব্যবসা করার ক্ষেত্রে তুলনামূলক সচেতন।

২০০২ সালে পলিথিন ব্যাগ উৎপাদন, বাজারজাতকরণ ও ব্যবহার নিষিদ্ধ ঘোষণা করার পর এই নিষেধাজ্ঞা বাস্তবায়নে পরিবেশ অধিদপ্তর মাঝেমধ্যে ভ্রাম্যমাণ আদালত অভিযান চালালেও সেটি কার্যকর হয়নি। অভিযোগ আছে, পলিথিনের উৎপাদকরা সরকারি চাকরিজীবীদের মাসোহারা দিয়ে থাকে; এই ভাগ ক্ষমতাসীন দলগুলোর নেতাকর্মীরাও পেয়ে আসছে।

২৩ বছরে বহুবার পাটের পরিবেশবান্ধব পলিথিন ব্যাগ বাজারে আনার কথা হয়েছে। একজন উদ্ভাবক পরীক্ষামূলকভাবে উৎপাদন করে সরকারি সংস্থার কাছে হস্তান্তরও করেছিলেন। মন্ত্রীরা নানা সময় সেই ব্যাগ নিয়ে ফটোসেশনও করেছেন, কিন্তু বাণিজ্যিকভাবে সেই ব্যাগ আর আসেনি।

অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্বে আসার পর পরিবেশের সুরক্ষায় ২০২৪ সালের ১ অক্টোবর থেকে সুপারশপে এবং ১ নভেম্বর থেকে কাঁচাবাজারে পলিথিন ব্যাগ নিষিদ্ধ করে। পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের বক্তব্যের অর্থ করলে দাঁড়ায়, আগে যা হয়েছে হয়েছে, এবার পলিথিন নিষিদ্ধ হবেই। তবে রাজধানীর সব বাজারে আগের মতোই পলিথিনে ভরে ক্রেতাদের কাছে পণ্য বিক্রি করতে দেখা যাচ্ছে।

কারওয়ান বাজারের সবজি বিক্রেতা মঞ্জু বলেন, ‘কাস্টমারই পলিথিন খোঁজে। একটা দিলে আবার আরেকটা চায়।’

কার্যকর বিকল্প যে নেই, সেটি এই বিক্রেতার কথাতেই উঠে এলো। তিনি বলেন, ‘পলিথিন না দিয়া উপায় আছেনি? এরা অফিস-আদালত শ্যাষ কইরা বাজারে আহে। লগে কি ব্যাগ লইয়া ঘুরে কেউ?’

কারওয়ান বাজারে মুরগি কিনছিলেন সেলিম আহমেদ। বলেন, ‘মুরগি বাসায় নিতে পলিথিন ছাড়া আর কী আছে বলুন তো? মাছ-মাংস নিতে পলিথিন লাগবেই। না হয় গন্ধ ছড়াবে, পানি ও রক্ত ঝরবে।’

তবে অন্তর্বর্তী সরকারের ঘোষণার পর পলিথিন অনেকটা গোপনে বিক্রি হচ্ছে এবং দাম বেড়েছে। কারওয়ান বাজারে ইসুবগুল, তোকমা বিক্রেতা মনির হোসেন বললেন, ‘মানুষ পলিথিন ছাড়া নিবে? আমার কাছে কিন্তু কাগজের ঠোঙাও আছে। কিন্তু মানুষ তো নিবে না। ছিদ্র হলে অথবা ভিজে গেলে জিনিস পড়ে যাবে, নষ্ট হবে।’

সচেতন মানুষের দেখাও মেলে

বাজারে কোনো কোনো ক্রেতাকে বাসা থেকে বড় ব্যাগ আনতে দেখা গেছে। তাদের কেউ কেউ শুকনো পণ্য পলিথিনে না নিয়ে সরাসরি ব্যাগেই নিচ্ছেন।

মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেটে আসা আমিনুর বিশ্বাস বলেন, ‘পরিবেশের ব্যাপক ক্ষতি করে প্লাস্টিক জাতীয় জিনিস। তাই যত কম প্লাস্টিক ইউজ করা যায় ততই মঙ্গল।’

বিকল্প ব্যাগের উচ্চমূল্য

টাউন হল বাজারের সবজি বিক্রেতা মো. মুনছুর বলেন, ‘কেজিতে ৮০ টাকার মতো দাম বাড়াইছে। আগে ২০০ টাকা দিয়া এক-দেড় কেজির সাইজের পলিথিন কিনতাম। এখন হয়ে গেছে ২৮০ টাকা।’

মুনছুরকে পলিথিন ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞার কথা বললে তিনি বলেন, ‘পলিথিনে না দিলে দিমু কিসে? সরকার যেসবের কথা বলে সেসবের দাম বেশি।’

এই বাজারের মাছ বিক্রেতা শহিদুল ইসলামও মুনছুরের মতো একই কথা জানালেন। তিনি বললেন, ‘একবার টিস্যু ব্যাগ বাইর করছিল। কিন্তু সেটার যে দাম, পোষায় না। একেকটা চার-পাঁচ টাকা কইরা। মামলা খাইলে খামু, তবুও এত দাম দিয়া কিনতে রাজি না। মাছ বেইচা যা লাভ করমু, ব্যাগ কিনা তা খরচ করলে ব্যবসা চাঙ্গা উঠব।’

পরিবর্তন সুপারশপে

কাঁচাবাজারগুলোতে পরিবর্তন না থাকলেও সুপারশপগুলোতে পলিথিন ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞার পর পরিবর্তন চোখে পড়েছে।

পলিথিনের বদলে এখন সেখানে কাগজের ঠোঙায় পণ্য দেওয়া হচ্ছে; বিক্রি হচ্ছে কাপড় বা পাটের ব্যাগ। ক্রেতারা বাধ্য হয়ে সেসব ব্যাগ কিনছেন, আবার অনেককে বাসা থেকে ব্যাগ আনতেও দেখা গেছে।

কাঁঠালবাগান এলাকার বক্স কালভার্ট রোডে অবস্থিত স্বপ্ন সুপারশপের ব্রাঞ্চের ইনচার্জ মো. ইলিয়াস শাহ সাম্প্রতিক দেশকালকে বলেন, ‘গত বছরের অক্টোবর থেকেই মূলত আমরা পলিথিনের বিকল্প চিন্তা করি। ক্রেতাদের ব্যাগ আনতে উৎসাহিত করি, পাশাপাশি ক্রেতারা চাইলে আমাদের কাছ থেকে পাটের ব্যাগ কিনতে পারবে সেই সুযোগও আছে।’

স্বপ্ন সুপারশপে জালি ব্যাগ, কাগজের ঠোঙা, সুতির ব্যাগ ও পাটের ব্যাগ রয়েছে। এর মধ্যে কাগজের ঠোঙা ও জালি ব্যাগ ক্রেতাদের ফ্রিতে দেওয়া হয়। আর সুতির ব্যাগ ৮ থেকে ১০ টাকা ও পাটের ব্যাগ ১৮ থেকে ২০ টাকায় কিনতে পারছেন ক্রেতারা।

নিস্ফল অভিযান

পলিথিনের ব্যবহার রোধে সরকারের চেষ্টার অংশ হিসেবে ২৩ আগস্ট সকালে মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেট পরিদর্শন করেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা। এ সময় বাজার করতে আসা ক্রেতাদের পলিথিনের বদলে পাটের ব্যাগ ব্যবহারের তাগিদ দেন তিনি। 

সারা দেশেই পলিথিনবিরোধী অভিযান পরিচালনা করছে পরিবেশ অধিদপ্তর, স্থানীয় প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী। নারায়ণগঞ্জ, রাজবাড়ী ও শরীয়তপুর জেলায় তিনটি ভ্রাম্যমাণ আদালত অভিযান পরিচালনা করে পলিথিন উৎপাদন, বিক্রয়, সরবরাহ ও বাজারজাতকরণের দায়ে ১১ মামলায় ছয় লাখ ২০ হাজার ২০০ টাকা জরিমানা আদায় করেছে পরিবেশ অধিদপ্তর।

তবে এমন অভিযান প্রায় দুই যুগ ধরেই চলছে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। 

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) নির্বাহী কমিটির সদস্য ইকবাল হাবিব সাম্প্রতিক দেশকালকে বলেন, ‘আসলে খুচরা ব্যবসায়ী, ব্যবহারকারী বা পলিথিন বিক্রেতাদের ধরে পলিথিন ব্যবহার বন্ধ সম্ভব নয়। পলিথিন তৈরিতে যেসব জিনিস আমদানি করা হয়, সেখানে বড় সিন্ডিকেট আছে। তাদের শনাক্ত করে আমদানি বন্ধ করতে হবে।’ 

লেখক : প্রতিবেদক, দেশকাল নিউজ

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫