Logo
×

Follow Us

প্রচ্ছদ প্রতিবেদন

রবিউল আউয়ালের বার্তা

Icon

মাওলানা লিয়াকত আলী

প্রকাশ: ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১১:৪৫

রবিউল আউয়ালের বার্তা

মিলাদুন্নবী (সা.) উপলক্ষে আয়েজিত জশনে জুলুস

হিজরি বর্ষপঞ্জীর তৃতীয় মাস রবিউল আউয়াল। রবিউল আউয়াল শব্দের অর্থ প্রথম বসন্ত বা বসন্তের সূচনা। বসন্তের আগমন পৃথিবীতে নবজাগরণের সৃষ্টি করে। প্রকৃতির পরতে পরতে সজীবতার নতুন স্পন্দন তৈরি হয়। গাছেদের পত্রপল্লবে আসে নয়া সাজ। আন্দোলিত হয় গাছগাছালির সঙ্গে পাখপাখালির হৃদয় জগৎ। তার প্রভাব পড়ে মনুষ্য সমাজে। 

দেড় হাজার বছর আগে মানুষের মনুষ্যত্ব যখন পশুত্বে রূপ নিয়ে আশরাফুল মাখলুকাতের সুউচ্চ অবস্থান থেক অধোগতির টানে নেমে গিয়েছিল নিকৃষ্টতার নিম্নতম স্তরে, তখন মানবতা প্রহর গুনছিল নতুন এক বসন্তের আগমনের। ঠিক সেই সময় ৫৭০ খিষ্টাব্দে মরু আরবের এক জীর্ণ কুটিরে মা আমিনার কোল উজালা করে পৃথিবীর মাটিতে শুভাগমন ঘটল মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের। ৪০ বছর বয়সে স্রষ্টার প্রেরিত ও বিশেষ দায়িত্বপ্রাপ্ত হিসেবে ঘোষণা করা হলো তাঁকে। নবুওয়াত ও রিসালাতের মহান দানে ভূষিত করা হলো। দায়িত্ব অর্পণ করা হলো নিজ গোত্র ও সমাজের মানুুষের কাছে জগৎপ্রভুর একত্বের বাণী প্রচারের। শিরক ও কুফর থেকে অন্তরজগৎকে শুদ্ধ করতে মানবজাতিকে আহ্বান জানাতে আদেশ করা হলো তাঁকে। বিপত্তি ঘটল এখানেই। অনুপম চরিত্র ও নিষ্কলুষ নৈতিকতায় যিনি এতদিন প্রশ্নাতীত ছিলেন, যার সততা ও সাধুতার স্বীকৃতি দিতে কারো সামান্যতম কুণ্ঠা ছিল না, জগৎপ্রভুর তাওহিদে বিশ্বাসের আহ্বান জানানোর কারণে তাঁর শত্রু হয়ে দাঁড়াল সেই মানুষেরা।

নবীর দাওয়াতে যারা সাড়া দিয়েছেন, পৌত্তলিকতা ও প্রকৃতিপূজার পঙ্কিলতা থেকে যারা নিজেদের পরিশুদ্ধ করেছেন, সেই মুসলমানদের ওপর নিপীড়নের মাত্রা বেড়ে গেল দুঃসহনীয়ভাবে। স্বয়ং মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপরেও আঘাত হানতে এতটুকু দ্বিধা করল না অবিশ্বাসীরা। তাই এক পর্যায়ে ইয়াছরিব পল্লীর বাসিন্দাদের প্রস্তাবে তিনি স্বয়ং সেখানে হিজরত করলেন। মক্কার আবাসভূমি ছেড়ে তাঁর সাথি হলেন প্রায় সব অনুুসারী। ইয়াছরিব পল্লীর নাম বদলে হয়ে গেল মদিনাতুন নবী বা সংক্ষেপে মদিনা। ইসলামের প্রতিষ্ঠা ও প্রসারের অনুকূল পরিবেশ মিলল। অচিরেই মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুসলমানদের নিয়ে স্থানীয় ইহুদি জনগোষ্ঠীর সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের সনদ প্রণয়ন করলেন এবং বিশ্ববাসীকে উপহার দিলেন ইতিহাসের প্রথম লিখিত শাসনতন্ত্র। মদিনার সনদ নামে আখ্যায়িত এই দলিল মানব সভ্যতার ইতিহাসে অনন্য সংযোজন।

আল্লাহর নবী ও তাঁর অনুসারীরা মদিনায়ও নির্বিঘ্নে বসবাস করার সুযোগ পেলেন না। মক্কার কুরাইশরা নিজেদের ভাগ্য সুপ্রসন্ন করার সুযোগকে সদ্ব্যবহার না করে প্রথম থেকে যে আচরণ করে আসছিল, তার কোনো পরিবর্তন আনল না। বরং নবী ও তাঁর অনুসারীদের সঙ্গে তাদের দুশমনি সশস্ত্র আক্রমণের পথে অগ্রসর হলো। তাই সামরিক উপায়ে তাদের মোকাবেলা করার অনুমতি দেওয়া হলো মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর সহচরদের। মানবজাতির জন্য চূড়ান্ত জীবন নির্দেশিকা আল কোরআনুল কারীমের সূরা হজের ৩৯ ও ৪০ নম্বর আয়াত নাজিল হলো এই অনুমতির বিধান নিয়ে। ইরশাদ হলো ‘যাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা হচ্ছে, তার অনুমতি দেওয়া হলো। কেননা তারা অত্যাচারিত হয়েছে। আর আল্লাহ তাদের সাহায্য করতে নিশ্চয়ই সক্ষম। যাদের নিজেদের বাড়ি থেকে শুধু এ জন্য অন্যায়ভাবে বের করে দেওয়া হয়েছে যে, তারা বলে আমাদের প্রভু আল্লাহ।’

মহান প্রভুর পক্ষ থেকে অনুমতি লাভের পর অবিশ্বাসীদের সঙ্গে মুসলমানদের প্রথম সশস্ত্র সামরিক মোকাবিলা হয় বদর প্রান্তরে। একেবারেই অসম ছিল সেই যুদ্ধ। একদিকে সুসজ্জিত সহস্র সৈন্য বাহিনী, অন্যদিকে এই বাহিনীর এক-তৃতীয়াংশের চেয়েও কম মাত্র ৩১৩ জন প্রায় নিরস্ত্র ও সরঞ্জামহীন মুজাহিদের নেতৃত্বে আল্লাহর নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। যুদ্ধাস্ত্র ও যুদ্ধ সামগ্রির দিক দিয়ে অসহায় হলেও তাদের প্রধান সম্বল ও পুঁজি ছিল মহান রাব্বুল আলামীনের প্রতি ঈমান ও তাওয়াক্কুল। এই সম্বলই বেশি কার্যকর ও ফলপ্রসূ প্রমাণিত হলো। অবিশ্বাসীদের দর্প ও দম্ভ চুরমার হয়ে গেল অল্পক্ষণের মধ্যে। তাদের প্রায় সব নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিই নিহত হলেন। তাদের নিহতের সংখ্যা দাঁড়াল ৭০, বন্দি হলো আরো ৭০ জন। অন্যদিকে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথিদের মধ্যে মাত্র ১৪ জন শাহাদাতের অমিয় সুধা পান করলেন। মানব সভ্যতার ইতিহাসে অনন্য অধ্যায়ের সংযোজন হলো। খোদায়ি মদদের সামনে পার্থিব সামগ্রী ও উপকরণাদির অকার্যকারিতা আবারও প্রমাণিত হলো পৃথিবীবাসীর সামনে।

বদরের পর উহুদ, খন্দক, খায়বর ইত্যাদি যুদ্ধেও আল্লাহর নবীর প্রচারিত দ্বিনের সত্যতা প্রমাণিত হলো। এতদিন বিরোধিতা করে আসা মক্কার কুরাইশরা বাধ্য হলো আল্লাহর নবী ও মুসলমানদের সঙ্গে শান্তিচুক্তি সম্পাদনে। হুদায়বিয়ার সন্ধি নামে পরিচিত এই চুক্তির সুবাদে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অবকাশ পেলেন সমকালীন বিশ্বের পরাশক্তিগুলোর উদ্দেশে দাওয়াতি পত্র প্রেরণের। পারস্য-রোমান-মিশর-হাবশার সম্রাটদের আহ্বান জানানো হলো পার্থিব ও পরকালীন জীবনের শান্তি ও সুখের নিশ্চয়তার স্বার্থে ইসলামের ছায়ায় আগমনের। এভাবে শেষ নবী নিজের বিশ্ব জনীনতার প্রমাণ দিলেন।

কিন্তু মক্কার কুরাইশরা হুদায়বিয়ার সন্ধি লঙ্ঘন করল। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রতিকার দাবি করলেন। কুরাইশরা তাতে আন্তরিকতার পরিচয় দিতে ব্যর্থ হলো। ফলে মক্কায় অভিযান চালানো অনিবার্য হয়ে পড়ল।  প্রায় বিনা রক্তপাতে মক্কার পবিত্র ভূমিতে ইসলামের পতাকা স্থাপিত হলো। রচিত হলো মানব সভ্যতার ইতিহাসে নবতর অধ্যায়। বিজিতদের সঙ্গে বিজয়ীদের আচরণের অনুপম আদর্শ স্থাপন করলেন আল্লাহর নবী। কুরাইশদের ওপরে মহানবীর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার অপেক্ষায় প্রহর গুনছিল আরবের অন্যান্য জাতি গোষ্ঠী। মক্কা বিজয়ের মাধ্যমে তাদের ইসলাম গ্রহণের সব প্রতিবন্ধকতা দূর হলো।  নগর-পল্লীর প্রতিটি বাসস্থানে পৌঁছে গেল ইসলামের বাণী ও বার্তা। গোটা আরব ভূমিতে ইসলামের বিজয় ও প্রতিষ্ঠা সম্পন্ন হওয়ার পর হিজরতের দশম বছরে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্বয়ং গেলেন হজ পালনে। লক্ষাধিক মুসলমানকে নিয়ে তিনি যখন জিলহজ মাসের ৯ তারিখে আরাফা ময়দানে অবস্থান করছিলেন, তখন নাজিল হলো কোরআন মাজিদের সুরা মায়েদার তিন নম্বর আয়াত। তাতে ঘোষণা করা হলো মানবজাতির প্রতি নির্দেশিকা প্রেরণের খোদায়ি প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন, বনি আদমের জন্য প্রেরিত বিধানের পূর্ণাঙ্গতা দানের এবং দ্বিন হিসেবে ইসলামের অদ্বিতীয়তার বার্তা। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উপস্থিত মানুষের আল্লাহ তা’আলার এই বাণী শোনানোর পাশাপাশি ঘোষণা করলেন মানবাধিকারের মৌলিক ধারাগুলো। মানবজাতির ইতিহাসে প্রথমবারের মতো শুনতে পায় মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণা। ভৌগোলিক, আদর্শিক ও প্রশাসনিক সীমারেখায় বিভক্ত হয়ে পড়া আদম সন্তানদের যদি আবার ঐক্যবদ্ধ করতে হয়, আদম-হাওয়ার সন্তান হিসেবে আবার একটি পরিবারের সদস্যদের মতো হয়ে শান্তিপূর্ণ ও সুষম ব্যবস্থাপনার আওতায় আনতে হয়, তাহলে বিশ্ববাসীর সামনে এই একটিই মূলনীতি ও সূত্র বিদ্যমান। এ সত্য স্বীকার ও পালনে বিশ্ব সমাজ যত দ্রুত অগ্রসর ও প্রস্তুত হবে, ভূপৃষ্ঠে তত তাড়াতাড়ি প্রবাহিত হবে শান্তি ও স্বস্তির সুবাতাস।

হজ পালনের পর মদিনায় ফিরে অল্পকালের মধ্যে আল্লাহর শেষ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অসুস্থ হলেন। রাব্বুল আলামীনের অমোঘ বিধান অনুযায়ী তাঁর পৃথিবীর জীবনকাল সমাপ্ত হলো। প্রভুর আহ্বানে সাড়া দিয়ে তিনি চলে গেলেন। এটাও ঘটল রবিউল আউয়াল মাসে। তাই রবিউল আউয়াল একই সঙ্গে দুনিয়ায় মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শুভ আগমন ও দুনিয়া থেকে তিরোধানের মাস। তাই এ মাস যেমন নিছক আনন্দ-উৎসবের নয়, তেমনি শোক পালনেরও নয়। বরং শেষ নবীর রেখে যাওয়া শরিয়ত পরিপালনে যত্নবান হওয়া এবং নবীর সুন্নাহ অনুযায়ী জীবনের সব ক্ষেত্র ও স্তরকে সাজানোর প্রতিজ্ঞার মাস।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫