
এভাবেই নদীর বুকে বিলীন হয়ে যায় ঘর-বাড়ি, ফসলি জমি
এ কূল ভাঙে ও কূল গড়ে, এই তো নদীর খেলা ... জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের গানের এই কথাগুলো বাংলাদেশের নদীতীরবর্তী মানুষের জীবনের সাথে যেন ওতপ্রোতভাবে জড়িত। নদীমাতৃক বাংলাদেশে নদীভাঙন একটি দীর্ঘস্থায়ী এবং ক্রমবর্ধমান সমস্যা। প্রতি বছর হাজার হাজার মানুষকে বাস্তুচ্যুত করার পাশাপাশি অর্থনৈতিকভাবে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত করছে। বাংলাদেশের প্রধান নদী যেমন পদ্মা, মেঘনা, যমুনা ও ব্রহ্মপুত্র-এগুলোই সবচেয়ে বেশি ভাঙনের শিকার। দেশের মধ্যে সবচেয়ে ভাঙনপ্রবণ নদী হচ্ছে যমুনা। এ ছাড়া তিস্তা, ধরলা, আত্রাই, কুশিয়ারা, খোয়াই, সুরমা, সাঙ্গু, গোমতী, মাতামুহুরী, মধুমতী, বিষখালী ইত্যাদি নদী ভাঙনপ্রবণ।
বাংলাদেশের মোট আয়তনের শতকরা প্রায় ৮০ ভাগই প্রধান তিনটি নদ-নদী অববাহিকার অন্তর্ভুক্ত। প্রধান তিন নদী পদ্মা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা ছাড়াও বাংলাদেশের ছোট-বড় নদ-নদীর সংখ্যা প্রায় ৩০০টি। এসব নদ-নদীর তটরেখার দৈর্ঘ্য হচ্ছে প্রায় ২৪ হাজার ১৪ কিলোমিটার। এর মধ্যে কমপক্ষে প্রায় ১২ হাজার কিলোমিটার তটরেখা নদীভাঙনপ্রবণ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত। তাই এ দেশের নদীভাঙন একটি অতি প্রাচীন ও ভয়াবহ সমস্যা। পুরো বর্ষাকালেই চলতে থাকে ভাঙনের তাণ্ডবলীলা। বর্ষা শেষে ভাঙনের প্রকোপ কিছুটা কমলেও বছরজুড়ে তা কমবেশি মাত্রায় চলতে থাকে।
কেন হচ্ছে নদীভাঙন ?
চোখের সামনে প্রতিনিয়ত তীরবর্তী মানুষের ঘর-বাড়ি, শখের বাগান, স্কুল, মসজিদঘর নদীগর্ভে বিলিন হচ্ছে। আর একবার ভাঙন শুরু হলে, তার ব্যাপকতা কেবল বাড়তে থাকে, অসহায় মানুষের প্রতিরোধের কোনো উপায় থাকে না। তবে নদীভাঙন প্রাকৃতিক বিষয় হলেও মানবসৃষ্ট অনেক কারণও এর জন্য দায়ী। দেখে নেওয়া যাক, কেন এই নদী ভাঙন।
প্রাকৃতিক কারণ : বাংলাদেশের নদীগুলো পললভূমি দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় এদের গতিপথ প্রায়শই পরিবর্তিত হয়। বর্ষাকালে পানির প্রবাহ বৃদ্ধির সাথে সাথে নদী তার পুরনো গতিপথ ছেড়ে নতুন পথে প্রবাহিত হতে শুরু করে, যা তীরবর্তী অঞ্চলে ভাঙনের প্রধান কারণ। পদ্মাকে পৃথিবীর দ্বিতীয় গতিশীল নদী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে, যা এর ভাঙন প্রবণতাকে আরও বাড়িয়ে তোলে।
বাংলাদেশের বেশিরভাগ নদীর তীরবর্তী মাটি বেলে বা পলিযুক্ত হওয়ায় সহজেই ক্ষয় হয়। এই ধরনের মাটি নদীর স্রোতের কারণে দ্রুত ভেঙে যায়। ভূমিকম্প ও টেকটোনিক কার্যকলাপ যদিও সরাসরি সম্পৃক্ত নয়, তবে অনেক গবেষক মনে করেন, ভূতাত্ত্বিক কার্যকলাপের কারণে নদীর ভূগর্ভস্থ কাঠামো দুর্বল হতে পারে, যা ভাঙনকে ত্বরান্বিত করে।
এছাড়া বন্যার সময় নদীর পানি উপচে পড়ে এবং নদীর তীরবর্তী এলাকা প্লাবিত হয়। বন্যার পানি সরে যাওয়ার সময় মাটির উপরিভাগ দুর্বল হয়ে পড়ে এবং ভাঙনের শিকার হয়। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে অকালবৃষ্টি, আকস্মিক বন্যা এবং বৃষ্টিপাতের ধরনে পরিবর্তন আসছে। ফলে নদীর পানির প্রবাহ ও বেগ বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা ভাঙনের প্রবণতাকে বাড়িয়ে তুলছে।
মানবসৃষ্ট কারণ: অপরিকল্পিতভাবে নির্মিত বাঁধ, স্লুইস গেট বা অন্যান্য অবকাঠামো নদীর স্বাভাবিক প্রবাহকে বাধাগ্রস্ত করে, যা একদিকে ভাঙন সৃষ্টি করে এবং অন্যদিকে পলি জমার কারণ হয়। নদী থেকে অপরিকল্পিত ও অবৈজ্ঞানিকভাবে বালু উত্তোলনের ফলে নদীর তলদেশের ভারসাম্য নষ্ট হয়, যা নদীর তীরকে দুর্বল করে তোলে এবং ভাঙনের ঝুঁকি বাড়ায়।
নদ-নদীগুলোর নাব্য সংকট বৃদ্ধি পাওয়ায় অল্প বৃষ্টিপাতেও অতিরিক্ত পানি ধারণ ক্ষমতা কমে যায় এবং তা ভাঙনের সৃষ্টি করে। অপরিকল্পিত নদী শাসনও ভাঙনের একটি অন্যতম কারণ। নদীর তীরবর্তী বনাঞ্চল ধ্বংস করার ফলে মাটির ক্ষয়রোধ ক্ষমতা কমে যায়। গাছের শিকড় মাটিকে ধরে রাখতে সাহায্য করে, যা ভাঙন প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
নদীভাঙনের বর্তমান চিত্র
প্রতি বছর দেশে প্রায় ৩ হাজার ২০০ হেক্টরের বেশি জমি নদীগর্ভে বিলীন হচ্ছে, যার ফলে গড়ে ২৫ হাজার মানুষ বাস্তুচ্যুত হচ্ছে। পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের ন্যাশনাল অ্যাডাপ্টেশন প্ল্যান অব বাংলাদেশ (২০২৩-২০৫০) এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১৯৭৩ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত পদ্মা-যমুনার ভাঙনে ১ লাখ ৫৭ হাজার ৮৫০ হেক্টর জমি বিলীন হয়েছে। এর মধ্যে যমুনায় ৯৩ হাজার ৯৬৫ হেক্টর এবং পদ্মায় ৬৩ হাজার ৫৫৮ হেক্টর জমি বিলীন হয়েছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যমতে, ২০১৪ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত ৬ বছরে নদী ও উপকূলের ভাঙনে প্রায় ২৬ হাজার ৮৭০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। ‘বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট পার্টনারশিপ সেন্টারের’ (বিডিপিসি) এক জরিপে বলা হয়েছে, নদীভাঙনে প্রতি বছর উদ্বাস্তু-গৃহহীন ভাসমান মানুষের সংখ্যা ২ লাখ ৫০ হাজার করে বাড়ছে। এ বিপুল মানুষের গন্তব্য শহরের বস্তি।
বাংলাদেশের ৬৪টি জেলার মধ্যে ৫১টি জেলাতেই কমবেশি নদীভাঙন দেখা দেয়। তথ্যমতে, গত পাঁচ বছরে নদীভাঙনের ফলে ভূমি বিলীন হয়েছে প্রায় সাত লাখ একর। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে প্রায় ১ কোটি ২০ লাখ মানুষ। এ সময়ে অর্থনৈতিকভাবে দেশের ক্ষতি হয়েছে প্রায় সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকা।
পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের এক তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশে ৮৫টি শহর ও বন্দরসহ মোট ২৮৩টি স্থানে প্রতি বছর নদীভাঙন দেখা দেয়।
শহরের ওপর চাপ বাড়ছে
নদীভাঙনের সবচেয়ে মারাত্মক সামাজিক প্রভাব হলো মানুষের বাস্তুচ্যুতি এবং শহরমুখী অভিবাসন। গ্রামের বাড়িঘর, জমিজমা হারিয়ে অসংখ্য মানুষ তাদের শেষ আশ্রয় হিসেবে ঢাকাসহ দেশের বড় বড় শহরগুলোর বস্তি বা ফুটপাতকে বেছে নিচ্ছেন। আইডিএমসি-র বৈশ্বিক রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০২০ সালে বিশ্বব্যাপী ৪ কোটি ৫ লাখ অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তুর মধ্যে ৪৪ লাখ ৪৩ হাজার ২৩০ জনই বাংলাদেশের। এই তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান তৃতীয়।
জনসংখ্যার ঘনত্ব ও চাপ বৃদ্ধি শহরের জনসংখ্যা অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে, যা আবাসন, স্বাস্থ্য, শিক্ষা এবং খাদ্য নিরাপত্তার মতো মৌলিক চাহিদাগুলোর উপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করছে। কর্মসংস্থানের অভাব নদীভাঙনের শিকার মানুষ গ্রামে কৃষিকাজ বা অন্যান্য গ্রামীণ পেশায় জড়িত থাকলেও শহরে এসে তারা প্রায়শই অদক্ষ শ্রমিক হিসেবে বিবেচিত হয়। ফলে তারা পর্যাপ্ত কর্মসংস্থান খুঁজে পায় না এবং দিনমজুরি বা রিকশা চালানোর মতো অনিশ্চিত পেশায় জড়িত হতে বাধ্য হয়।
বস্তি বা ফুটপাতে বসবাসের কারণে এসব মানুষ অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর ও নিরাপত্তাহীন পরিবেশে জীবনযাপন করে। এতে স্বাস্থ্যঝুঁকি, অপুষ্টি, শিশুশ্রম, নারী নির্যাতন এবং অন্যান্য সামাজিক অপরাধ বৃদ্ধি পায়। নদীভাঙনের শিকার অনেক পরিবারে বিবাহবিচ্ছেদ এবং পারিবারিক সম্পর্ক শিথিল হওয়ার ঘটনাও ঘটে।
বাস্তুচ্যুত শিশুরা শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয় এবং শহরের স্কুলগুলোতে অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি হয়। স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রেও পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা না থাকায় তারা রোগব্যাধিতে আক্রান্ত হয়।
প্রতিরোধ ও প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা
নদীভাঙন একটি জটিল সমস্যা হলেও এর প্রতিকার সম্ভব। এর জন্য সমন্বিত, দীর্ঘমেয়াদী এবং বিজ্ঞানভিত্তিক পরিকল্পনা প্রয়োজন। নদীর গভীরতা বজায় রাখতে এবং পলির জমারোধ করতে নিয়মিত ড্রেজিং অপরিহার্য। এটি নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ নিশ্চিত করে এবং ভাঙন কমায়।
ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় শক্তিশালী ও টেকসই তীর সংরক্ষণ বাঁধ নির্মাণ করা প্রয়োজন। নদীর তীরবর্তী এলাকায় বৃক্ষরোপণ ও বনায়ন ভাঙন প্রতিরোধে অত্যন্ত কার্যকর। গাছের শিকড় মাটিকে ধরে রেখে ক্ষয়রোধ করে। এছাড়া নদীর গতিপথে বা তীরবর্তী এলাকায় অপরিকল্পিত স্থাপনা নির্মাণ বন্ধ করতে হবে। নদী থেকে অবৈজ্ঞানিক ও অতিরিক্ত বালু উত্তোলন কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
নদীভাঙনের শিকার মানুষের জন্য টেকসই পুনর্বাসন কর্মসূচি গ্রহণ করা উচিত। তাদের জন্য আবাসন, জীবিকা এবং শিক্ষার ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। জলবায়ু উদ্বাস্তুদের জন্য জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে আলাদা তহবিলের মাধ্যমে কার্যক্রম পরিচালনা করা জরুরি।
আন্তঃসীমান্ত নদীগুলোর ক্ষেত্রে উজানের দেশগুলোর সাথে সমন্বিত নদী ব্যবস্থাপনা এবং পানি বণ্টনের বিষয়ে সহযোগিতা প্রয়োজন। স্যাটেলাইট চিত্র, জিআইএস এবং রিমোট সেন্সিং প্রযুক্তির সাহায্যে নদীভাঙনের নিয়মিত পর্যবেক্ষণ এবং এ বিষয়ে গবেষণা চালিয়ে যেতে হবে, যাতে নতুন তথ্য ও কৌশল উদ্ভাবন করা যায়। নদীভাঙন এবং এর প্রতিকার সম্পর্কে স্থানীয় জনগণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করা জরুরি।
নদীভাঙনের এই চিরন্তন সমস্যা সমস্যা সমাধানের জন্য একটি সমন্বিত, দীর্ঘমেয়াদী এবং বিজ্ঞানভিত্তিক পরিকল্পনা প্রয়োজন। শুধু অবকাঠামো নির্মাণ নয়, পরিবেশগত ভারসাম্য বজায় রাখা, জনসচেতনতা বৃদ্ধি এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতার মাধ্যমে আমরা এই ভয়াবহ দুর্যোগের মোকাবিলা করতে পারি। নদীমাতৃক বাংলাদেশে টেকসই নদী ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে নদীভাঙন প্রতিরোধ করে একটি স্থিতিশীল ও সমৃদ্ধ ভবিষ্যৎ গড়ে তোলা সম্ভব।