এনবিআরকে অনুমাননির্ভর রাজস্ব আহরণ লক্ষ্যমাত্রা আর কতকাল?

নজরুল ইসলাম
প্রকাশ: ০৫ অক্টোবর ২০২৫, ১৮:১৫

জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)।
প্রতি বছরের ঘোষিত বাজেটে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)-কে যে অর্থ আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা বেঁধে দেওয়া হয়, তা কখনও আদায় করতে পারেনি সংস্থাটি।
এর কারণ হিসেবে সংস্থাটির কর্মীরা অনুমাননির্ভর লক্ষ্যমাত্রা বেঁধে দেওয়ার কথা বলছেন। তারা বলছেন, আসলে কোন খাত থেকে কত আদায় করা যাবে, সে বিষয়ে সরকারের কোনো সংস্থার কোনো গবেষণা নেই।
চলতি অর্থবছরেরও এনবিআরকে ৪ লাখ ৯৯ হাজার কোটি টাকা আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা বেঁধে দেওয়া হয়েছে, যদিও আগের বছর আদায় হয়েছে ৩ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকা।
সেই অর্থবছরে ঘোষিত বাজেটে আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা শুরুতে ছিল ৪ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা। সরকার পতন আন্দোলনে সংঘাত-সহিংসতায় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের গতি কমে যাওয়ার পর সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রা দেওয়া হয় ৪ লাখ ৬৩ হাজার কোটি টাকা। পরে তা আবার কমিয়ে ৪ লাখ ৩০ হাজার ও শেষ পর্যন্ত ৪ লাখ ১০ হাজার কোটি টাকা করা হয়। সেখান থেকেও ৪২ হাজার কোটি টাকা কম আদায় হয়েছে।
এই পরিস্থিতিতে এনবিআর কোন জাদুবলে গতবারের চেয়ে এক লাখ ৩১ হাজার কোটি টাকা বেশি রাজস্ব আদায় করবে— সেই বিষয়টি কর্মকর্তারা বুঝতে পারছেন না।
২০২২-২৩ অর্থবছরে ৩ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকার লক্ষ্যমাত্রা দেওয়া হয়েছিল। পরে সেটি আর সংশোধন করা হয়নি। এ লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে এনবিআর ৩ লাখ ২৮ হাজার ৮৮৫ কোটি ৮৯ লাখ টাকার রাজস্ব আহরণ করেছে। যা মোট লক্ষ্যমাত্রার ৮৮.৮৯ শতাংশ।
২০২০-২১ অর্থবছরে ৩ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আহরণ লক্ষ্যমাত্রা দেওয়া হয়। পরে সংশোধন করে ৩ লাখ ১ হাজার কোটি টাকার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। এ লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে এনবিআর ২ লাখ ৬১ হাজার ৬৮৯ কোটি ২০ লাখ টাকার রাজস্ব আহরণ করে। যা মোট লক্ষ্যমাত্রার ৭৯.৩০ শতাংশ।
এনবিআরের সাবেক কর্মকর্তারাও বলছেন, এভাবে অনুমাননির্ভর রাজস্ব আহরণ লক্ষ্যমাত্রা চাপিয়ে দেওয়া বাস্তবভিত্তিক নয়।
তারা বলছেন, এনবিআরকে লক্ষ্যমাত্রা দেয়ার আগে ‘রাজস্ব পূর্বানুমান’ করা দরকার। অর্থাৎ, রাজস্ব আহরণে নিয়োজিত জনবল, কর খাত ও ব্যবসা-বাণিজ্যের পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা। ইউরোপের দেশগুলোসহ উন্নত বিশ্বে এ পদ্ধতিতেই লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়।
এনবিআর সংস্কার পরামর্শক কমিটিও সুপারিশ করেছে, গঠিত হতে যাওয়া রাজস্ব নীতি বিভাগ রাজস্ব আহরণ লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করবে।
এনবিআরের সাবেক সদস্য (আয়কর) রঞ্জন কুমার ভৌমিক সাম্প্রতিক দেশকালকে বলেন, “লক্ষ্যমাত্রা কোনো বছরই পূরণ হয় না। সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রাও পূরণ হয় না। সবসময় বাড়তি লক্ষ্যমাত্রা দেওয়া হয়। এতে রাজস্ব আহরণে ঘাটতি থেকে যায়।”
প্রতি বছর এই সমস্যার কারণ হিসেবে তিনি বলেন, “লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণে মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের মত নেওয়া হয় না। এটি এনবিআরের নীতি বিভাগ ও অর্থ বিভাগ মিলে নির্ধারণ করে, এ জন্যই এমনটা হয়।”
এনবিআরের সাবেক সদস্য (কাস্টমস ও ভ্যাট) ফরিদ উদ্দিন বলেন, “সরকার আগে ব্যয় ঠিক করে, তারপর আয়ের খাত নির্ধারণ করে। তারপর এনবিআরকে একটা লক্ষ্যমাত্রা ধরিয়ে দেয়। অর্থমন্ত্রী, অর্থ সচিব, ইআরডি সচিব ও এনবিআর চেয়ারম্যান মিলে রিসোর্স কমিটি এটা ঠিক করে দেয়।”
তিনি বলেন, “সারা বিশ্বে রাজস্ব পূর্বানুমান করে রাজস্ব আহরণ লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। তারা রাজস্বের ঐতিহাসিক ধারা বিশ্লেষণ করে। অথচ এনবিআরের গবেষণা ও পরিসংখ্যান বিভাগকে কম জনবল দিয়ে দুর্বল করে রাখা হয়েছে। আমরা এনবিআর সংস্কার পরামর্শক কমিটি থেকে সুপারিশ করেছি, রাজস্ব নীতি বিভাগ রাজস্ব আহরণ লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করবে।”
এনবিআরের সাবেক সদস্য (কাস্টমস ও ভ্যাট) রেজাউল হাসান বলেন, “নিয়মটা হওয়া উচিত এনবিআর গত অর্থবছর কত আদায় করলে, পরবর্তী বছর এ আদায়ের উপর যেসব মানদণ্ড বিবেচনা করলে যে পরিমাণ কর আদায় নিশ্চিত হবে, সে পরিমাণ বৃদ্ধি করা। অথচ লক্ষ্যমাত্রা আসে অর্থবিভাগ থেকে, এনবিআর কিছুই জানে না।”
“এবার মুদ্রাস্ফীতি ধরা হয়েছে ৬.৫ শতাংশ। তাহলে কত শতাংশ বৃদ্ধি ধরবেন? ডলারের দর বাজারমূল্য করার ফলে এটি কী পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে, এর প্রেক্ষাপটে আমাদেরকে একটি চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে আসতে হবে যে রাজস্ব আহরণ কত হবে”, বলেন তিনি।
তবে এনবিআরের সাবেক সদস্য (আয়কর) আলমগীর হোসেন বলেন, “এনবিআরের সঙ্গে মোটামুটি আলোচনা করেই লক্ষ্যমাত্রা দেওয়া হয়। তারপর বাস্তবতা বিবেচনা করে সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রাও নির্ধারণ করা হয়।”
বাড়তি লক্ষ্যমাত্রা বিবেচনা করেই শুল্ক, মূল্য সংযোজন কর বা মূসক ও আয়কর বৃদ্ধি করা হয় জানিয়ে তিনি বলেন, “একটি অগ্রিম হিসাব করা হয়।”
তবে এনবিআরকে লক্ষ্যমাত্রা দেয়ার আগে রাজস্ব পূর্বানুমান করা দরকার বলে মত দিয়েছেন তিনিও। তিনি বলেন, “অর্থাৎ, রাজস্ব আহরণে নিয়োজিত জনবল, কর খাত ও ব্যবসা-বাণিজ্যের পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা।”