Logo
×

Follow Us

প্রচ্ছদ প্রতিবেদন

রূপপুরে ‘৫ বিলিয়ন ডলার আত্মসাৎ’: থমকে গেছে দুদকের অনুসন্ধান

Icon

নজরুল ইসলাম

প্রকাশ: ০৯ অক্টোবর ২০২৫, ১৬:৪৫

রূপপুরে ‘৫ বিলিয়ন ডলার আত্মসাৎ’: থমকে গেছে দুদকের অনুসন্ধান

রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র।

আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে পাবনার রূপপুরে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ ব্যয়ের ৫ বিলিয়ন ডলার আত্মসাতের অভিযোগ নিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন—দুদক যে অনুসন্ধান শুরু করেছিল, তার অগ্রগতি নেই ১০ মাসেও।

দুর্নীতি নির্মূলে কাজ করা সংস্থাটি বলছে, এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা বিভাগ—বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)—এ তিনবার চিঠি পাঠিয়েও কোনো তথ্য মেলেনি।

২০২৪ সালের ২৯ ডিসেম্বর, ৯ মার্চ ও ১২ মে—এই তিন দফায় বিএফআইইউর কাছে চিঠিগুলো পাঠানো হয়। কিন্তু কোনো জবাব আসেনি।

বাংলাদেশ ও রাশিয়ার সরকারের মধ্যে ২০১১ সালে রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের জন্য দ্বিপক্ষীয় চুক্তি হয়। সাড়ে ১২ বিলিয়ন ডলারের এই প্রকল্পটি বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় প্রকল্প। এটি বাস্তবায়ন করছে রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় কোম্পানি রোসাটম।

পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলার রূপপুরে প্রতিটি এক হাজার মেগাওয়াট ক্ষমতার দুটি ইউনিটের মাধ্যমে মোট দুই হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হবে। ২০১৫ সালে রাশিয়া ও বাংলাদেশ সরকারের মধ্যে চূড়ান্ত চুক্তি হয়। তাতে বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রতি ইউনিটে এক হাজার ২০০ মেগাওয়াট করে দুই হাজার ৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের কথা বলা হয়।

প্রকল্পটির খরচের ৯০ শতাংশ ঋণের জোগান দিচ্ছে রাশিয়া। তবে কোনো অর্থ সরাসরি দেশে আসেনি—ঋণ হিসেবে যন্ত্রপাতি ও বিশেষজ্ঞ পাঠানো হচ্ছে, সেসবের খরচই দিচ্ছে দেশটি।

এ বছর বিদ্যুৎকেন্দ্রটি উৎপাদনে আসার কথা থাকলেও তা এক বছর পিছিয়েছে। এ পর্যন্ত বিদ্যুৎকেন্দ্রের ৯৫ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে।

২০২৪ সালের ১৭ আগস্ট গ্লোবাল ডিফেন্স কর্প নামের একটি ওয়েবসাইটে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, রূপপুর প্রকল্প থেকে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়, ভাগ্নি টিউলিপ সিদ্দিকসহ পাঁচজন মিলে ৫ বিলিয়ন ডলার আত্মসাৎ করেছেন।

প্রকল্প বাস্তবায়নকারী রোসাটম মালয়েশিয়ার একটি ব্যাংকের মাধ্যমে অভিযোগ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা অর্থ আত্মসাতের সুযোগ পেয়েছেন বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।

এই অভিযোগ সামনে আসার পর ডিসেম্বরে অভিযোগ অনুসন্ধানে কর্মকর্তা নিয়োগ করে দুদক।

অভিযোগ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশে পরিচালিত প্রচ্ছায়া লিমিটেড ও যুক্তরাষ্ট্রে পরিচালিত জুমানা ইনভেস্টমেন্ট নামের কোম্পানির মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন দেশের অফশোর হিসাবে বিপুল অর্থ পাচারের অভিযোগ ছিল। তাদের বিরুদ্ধে যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে অর্থ পাচারের অভিযোগও রয়েছে।

সেজন্য তাদের স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি, কোম্পানি ও প্রতিষ্ঠানের নামে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, রাশিয়া, মালয়েশিয়া, কানাডা, হংকং, সিঙ্গাপুর, ভারত, সংযুক্ত আরব আমিরাত, অস্ট্রেলিয়াসহ অন্যান্য দেশের ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট থেকে ব্যাংক হিসাব, আর্থিক লেনদেন ও অন্যান্য স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির তথ্য সংগ্রহের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বিএফআইইউতে চিঠি পাঠানো হয়।

অনুসন্ধান করতে গিয়ে দুদক জানতে পেরেছে, প্রকল্পের কোনো অর্থ দেশে আসেনি; সব লেনদেন বিদেশে হয়েছে। শুধু মালপত্র দেশে এসেছে।

রূপপুরে যে খরচে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র হচ্ছে, ভারতে তার চেয়ে সাত ভাগের এক ভাগ খরচে একই উৎপাদনক্ষমতার বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মিত হচ্ছে বলে সংবাদমাধ্যমে খবর এসেছে।

ডিফেন্স কর্পের প্রতিবেদনে বলা হয়, মালপত্র কেনাকাটায় ওভার ইনভয়েসিং (মূল্য বেশি দেখানো) হয়েছে এবং প্রকল্পের কাজ পাইয়ে দেওয়ার বিনিময়ে মালয়েশিয়ার মানি এক্সচেঞ্জের মাধ্যমে ঘুষ প্রদান করা হয়েছে।

কিন্তু অনুসন্ধান করতে গিয়ে সেই মানি এক্সচেঞ্জগুলোর নাম এখনও জানতে পারেনি দুদক। ওভার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে টাকা পাচার হয়েছে কিনা, সেই বিষয়টিও বের করা যাচ্ছে না।

দুদক সূত্র বলছে, পরমাণু শক্তি কমিশনে তথ্য চেয়ে চুক্তি-সংক্রান্ত কিছু নথি পাওয়া গেছে। সেগুলো পর্যালোচনা করা হচ্ছে। তবে এখন পর্যন্ত ব্যাংকিং লেনদেনের কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।

আবার প্রকল্প এলাকার কাজ পরিমাপ করার মতো কোনো বিশেষজ্ঞও নেই দুদকে। সাধারণত গণপূর্ত অধিদপ্তর দুদকের অনুসন্ধান কাজে সহায়তা করে থাকে। প্রকল্প এলাকায় সরেজমিন পরিদর্শনও করেনি অনুসন্ধান দল।

শেখ হাসিনা ও তার পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে থাকা অভিযোগের অনুসন্ধানের নেতৃত্বে ছিলেন দুদকের উপপরিচালক মো. সালাহউদ্দিন। তাকে কয়েক মাস পর যশোরে বদলি করা হয়। এরপর দলনেতা হন উপপরিচালক মনিরুল ইসলাম।

অনুসন্ধান দলে রয়েছেন সহকারী পরিচালক আফনান জান্নাত কেয়া, এ কে এম মর্তুজা আলী সাগর, এস এম রাশেদুল হাসান, আতিয়া মোবাশ্বেরা তমা, মনিরুল ইসলাম ও উপসহকারী পরিচালক আব্দুল্লাহ আল মামুন।

তাদের মধ্যে সহকারী পরিচালক মনিরুল ইসলামকে সম্প্রতি পিরোজপুরে এবং উপসহকারী পরিচালক আব্দুল্লাহ আল মামুনকে রিজার্ভ শাখায় বদলি করা হয়েছে।

অনুসন্ধান শুরু হওয়ার পর এখন পর্যন্ত তারা ১৯টি মামলা করেছেন, যেগুলোর তদন্ত চলছে।

অনুসন্ধান দলের প্রধান মনিরুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

পরে দুদকের মুখপাত্র ও মহাপরিচালক (প্রতিরোধ) আকতার হোসেনকে কল করা হলে তিনি রিসিভ করেননি। পরে প্রশ্ন পাঠিয়ে জবাব চাওয়া হলেও এই প্রতিবেদন প্রকাশ পর্যন্ত কোনো প্রতিক্রিয়া আসেনি।

দুদকের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুল মোমেনকে হোয়াটসঅ্যাপে প্রশ্ন পাঠালে তিনিও জবাব দেননি, তবে তিনি প্রশ্নটি দেখেছেন বলে হোয়াটসঅ্যাপে দেখা গেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সংস্থা বিএফআইইউয়ের কোনো মন্তব্যও জানতে পারেনি দেশকাল নিউজ ডটকম। যোগাযোগ করা হলে কেউ মন্তব্য করতে রাজি হননি।

কী বলছে রোসাটম

দুর্নীতির অভিযোগ ওঠার পর রোসাটম এক বিবৃতিতে প্রকল্প বাস্তবায়নে কোনো ধরনের দুর্নীতির অভিযোগ অস্বীকার করে। সংবাদমাধ্যমে আসা প্রতিবেদনকে উসকানিমূলক আখ্যা দিয়ে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার হুঁশিয়ারিও দেয় রুশ কোম্পানিটি।

২০২৪ সালের ২৪ ডিসেম্বর এক বিবৃতিতে রোসাটম বলে, “আমরা গণমাধ্যমে প্রকাশিত/প্রচারিত অসত্য তথ্যগুলোকে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পটিকে কলঙ্কিত করার একটি প্রয়াস হিসেবে বিবেচনা করছি।”

রোসাটম জানিয়েছে, তারা তাদের সকল প্রকল্পে উন্মুক্ত কর্মপন্থা, দুর্নীতি প্রতিরোধ নীতি এবং ক্রয় পদ্ধতিতে স্বচ্ছতা নিশ্চিতকরণে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। ব্যবসা প্রক্রিয়ায় উন্মুক্ততা তৃতীয় পক্ষীয় নিরীক্ষার মাধ্যমে নিয়মিতভাবে নিশ্চিত করা হয়ে থাকে।

২০২৪ সালের ২৫ আগস্ট বিষয়টি নিয়ে কথা বলেন ঢাকায় রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত আলেকজান্ডার মান্টিটস্কি। সেদিন অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদের সঙ্গে বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নে তিনি বলেন,“নির্দ্বিধায় বলতে পারি, এটি গুজব ও মিথ্যা।”

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫