-68ea218554f1b.jpg)
ঢাকার রাস্তায় প্রতিনিয়ত চলে হাজার হাজার পুরনো বাস।
রাজধানী ঢাকার বাসিন্দাদের যানজটের পর সবচেয়ে বড় ভোগান্তি বায়ুদূষণ। ঢাকার রাস্তায় বায়ুদূষণের প্রধান উৎসগুলোর একটি হলো পুরনো বাসের কালো ধোঁয়া। অথচ বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) আইন করেও বাস মালিকদের দাবির মুখে বারবার স্থগিত করেছে পুরনো গাড়ি প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও বিশ্বব্যাংকের পরিসংখ্যান বলছে, ঢাকার বায়ুতে মারাত্মক মাত্রায় বিষাক্ত কণা রয়েছে। এর বড় একটি উৎস হলো মেয়াদোত্তীর্ণ ও পুরনো বাস।
ঢাকার রাস্তায় এখনও হাজার হাজার পুরনো বাস থেকে নির্গত কালো ধোঁয়ায় থাকে কার্বন মনোক্সাইড, নাইট্রোজেন অক্সাইড, সালফার ডাই-অক্সাইড ও পার্টিকুলেট ম্যাটার—যা সরাসরি শ্বাসযন্ত্র ও হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়। পরিবেশ অধিদপ্তরের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঢাকার মোট বায়ুদূষণের প্রায় ৪০ শতাংশই আসে যানবাহন থেকে।
আইন আছে, প্রয়োগ নেই
ঢাকায় প্রতিদিন প্রায় ৫০ লাখ মানুষ যাতায়াত করে। এর মধ্যে গণপরিবহনের বড় অংশ এখনও পুরনো ডিজেলচালিত বাস।
পরিবেশবিদদের মতে, নতুন ইউরো-৪ বা ইউরো-৫ মানের গাড়ি পুরনো গাড়ির তুলনায় ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ কম দূষণ ছড়ায়। অথচ ঢাকায় আধুনিক মানের কিছু বাস যুক্ত হলেও মেয়াদোত্তীর্ণ গাড়িগুলো রাস্তায় রয়ে যাওয়ায় সামগ্রিকভাবে দূষণ কমছে না।
২০১৮ সালে বিআরটিএ পুরনো গাড়ি সরানোর জন্য নীতি প্রণয়ন করে। নিয়ম অনুযায়ী ২০ বছরের বেশি পুরনো বাস-মিনিবাস ও ২৫ বছরের বেশি পুরনো ট্রাক-কোচ চলাচল বন্ধ করার কথা। কিন্তু মালিকদের চাপ ও বিভিন্ন অজুহাতে অভিযান বারবার স্থগিত হয়েছে। ফলে পুরনো গাড়িগুলোই রাস্তায় থেকে গেছে।
এক পরিবেশবিদ নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “এটা খোলাখুলি দোষ স্বীকার যে বাস মালিকদের চাপেই পুরনো গাড়ি সরানো যাচ্ছে না। অথচ দূষণের সবচেয়ে বড় উৎস এগুলোই।”
বিআরটিএর দাবি অভিযান চলছে, সড়কে নেই প্রভাব
যাত্রীদের অভিযোগ, সরকারের ঘোষিত অভিযান সংবাদে থাকে, কিন্তু তার বাস্তব প্রভাব রাস্তায় দেখা যায় না। পুরনো বাসগুলো শুধু দূষণই ছড়াচ্ছে না, দুর্ঘটনাও বাড়াচ্ছে।
মোহাম্মদপুরের কর্মজীবী নারী রুমানা সুলতানা সাম্প্রতিক দেশকালকে বলেন, “পুরনো বাসের কালো ধোঁয়া এতটাই বেশি যে, পেছনে হাঁটলেই নিশ্বাস নেওয়া যায় না। প্রতিদিনই চোখ জ্বালা করে।”
রাফি রহমান নামে আরেকজন বলেন, “যে বাসগুলো দেখলেই বোঝা যায়, সেগুলো স্ক্র্যাপ হওয়া উচিত—সেগুলোই রাস্তায় চলছে। সরকার শুধু অভিযান দেখাচ্ছে, কিন্তু বাস্তবে কিছুই বদলায়নি।”
বিআরটিএ উপপরিচালক (এনফোর্সমেন্ট) হেমায়েত উদ্দিন সাম্প্রতিক দেশকালকে বলেন, “আমাদের প্রতিদিন অভিযান চলছে একাধিক জায়গায়। যেমন বুধবার ১৬টি গাড়ি ডাম্পিং হয়েছে। প্রতিদিনই এরকম ডাম্পিং করা হচ্ছে।”
বিআরটিএ চেয়ারম্যান আবু মমতাজ সাদ উদ্দিন আহমেদ বলেন, “আমরা বিআরটিএ ও পরিবেশ অধিদপ্তরের সঙ্গে যৌথভাবে ঢাকা শহরের তিনটি রুটে প্রতিদিন অভিযান চালাচ্ছি। একেকদিন একেক জায়গায় অভিযান চলছে, আশা করছি এর ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।”
গাড়ি মালিকদের দাবি মানলে সরবে না মেয়াদোত্তীর্ণ বাস
অর্থনৈতিক আয়ুস্কাল নিয়ে গাড়ি মালিকদের দাবি মানলে সরবে না মেয়াদোত্তীর্ণ বাস। তাদের দাবি, সরকারের নির্ধারিত ২০ বছরের অর্থনৈতিক আয়ুস্কাল মানলে সারাদেশের বাসসেবা ব্যাপক হারে ব্যাহত হবে। বাস মালিকদের সক্ষমতা নেই নতুন গাড়ি চালানোর।
ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল আলম সাম্প্রতিক দেশকালকে বলেন, “অর্থনৈতিক আয়ুস্কাল পার হলেই যে গাড়ি বায়ুদূষণ করে, বিষয়টি ঠিক নয়। যদি কোনো গাড়ি কালো ধোঁয়া ছড়ায়, সেটার বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিলে তো আমাদের আপত্তি নেই। সেগুলো ডাম্পিং পাঠাতে পারে, এমনকি বাজেয়াপ্তও করতে পারে।”
আইনে বলা হয়েছে ২০ বছর অর্থনৈতিক সীমা। আপনারা কি এটা বাড়াতে চান?—এই প্রশ্নে তিনি বলেন, “আমরা চাই অর্থনৈতিক আয়ুস্কাল ২৫ বা ৩০ বছর করা হোক। আমেরিকা বা ইউরোপের মতো আমাদের সক্ষমতা নেই ২০ বছর পরপর গাড়ি পরিবর্তন করার। যদি কোনো সমস্যা হয়, মামলা দেবে—সেটা মেরামত করে আবার রাস্তায় চলবে।”
আইনি সংস্কারের পথে সরকার
নগরীর বায়ুদূষণ ও পরিবহন ব্যবস্থার অব্যবস্থাপনা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন নৌ, সড়ক ও রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক আশীষ কুমার দে।
দেশকাল নিউজ ডটকমকে তিনি বলেন, “ঢাকায় বাস মালিকরা যেন সরকারের চেয়েও শক্তিশালী। এজন্য তাদেরকে সরকার পোষ মানাতে পারে না বা চায় না। রাজনৈতিক সরকারগুলো সাধারণত অর্থবান ও প্রভাবশালীদের বিপক্ষে যেতে চায় না। কিন্তু এই সরকারও কেন মেয়াদোত্তীর্ণ বাসগুলো সরাতে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারছে না—তা বোধগম্য নয়।”
তিনি আরও বলেন, “পুরনো ও কালো ধোঁয়া ছাড়ে এমন বাসগুলোই ঢাকার বায়ুদূষণের অন্যতম বড় উৎস। যদি সরকার সত্যিই পরিবেশ দূষণ রোধে আন্তরিক হতো, তবে এগুলো অনেক আগেই রাস্তাচ্যুত করা যেত। হয়তো সরকার এখনো এটিকে গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার মনে করছে না—আর এ কারণেই নগরবাসীকে বিষাক্ত বাতাসে শ্বাস নিতে হচ্ছে।”
যদিও বিআরটিএ দাবি করেছে, ঢাকা শহরের পরিবেশবান্ধব বাসব্যবস্থা গড়ে তুলতে সরকার ইতিমধ্যে নতুন উদ্যোগ নিয়েছে।
বিআরটিএ চেয়ারম্যান আবু মমতাজ সাদ উদ্দিন আহমেদ বলেন, “সড়ক ও সেতু বিভাগের সচিবকে আহ্বায়ক করে একটি কমিটি করা হয়েছে। কমিটি দুই মাসের মধ্যে আইন পর্যালোচনা করে খসড়া প্রতিবেদন জমা দেবে। এরপরই বোঝা যাবে কী পরিবর্তন আসছে।”