Logo
×

Follow Us

প্রচ্ছদ প্রতিবেদন

উত্তরে অ্যানথ্রাক্স আতঙ্ক, খামারিদের নাভিশ্বাস

Icon

আবুল বাসার সাজ্জাদ

প্রকাশ: ১২ অক্টোবর ২০২৫, ১৬:৩৫

উত্তরে অ্যানথ্রাক্স আতঙ্ক, খামারিদের নাভিশ্বাস

গরুকে টিকা দিচ্ছেন পশু চিকিৎসক।

রংপুর জেলার একাধিক উপজেলায় অ্যানথ্রাক্সের প্রাদুর্ভাব ছড়িয়ে পড়েছে। বিশেষ করে পীরগাছা, মিঠাপুকুর ও কাউনিয়া উপজেলায় সাম্প্রতিক সময়ে গবাদিপশুতে অ্যানথ্রাক্সে আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা বেড়েই চলছে।

এতে স্থানীয় খামারি ও কসাইপাড়ার মানুষের মধ্যে দেখা দিয়েছে ব্যাপক উদ্বেগ ও আতঙ্ক। আক্রান্ত এলাকার মানুষ এখন গরু পালনের চেয়ে জবাইয়ের দিকেই বেশি ধাবিত হচ্ছেন।

অনেক সময় দেখা যাচ্ছে, ভিন্ন রোগে আক্রান্ত হলেও পশু জবাই করা হচ্ছে—যা পশু ব্যবসাকে মারাত্মক হুমকির মুখে ফেলেছে।

কাউনিয়া উপজেলার খামারি আলি আজগর দেশকাল নিউজ ডটকমকে বলেন, “এই রোগ ছড়িয়ে পড়ায় গরু বিক্রি কমে গেছে, কেউ সহজে পশু কিনতে চায় না। এতে আমরা বড় ক্ষতির মুখে পড়েছি। তাই অসুস্থ হলেই গরু জবাই করে মাংস বিক্রি করে দিচ্ছি। কারণ, অসুস্থ পশুর মাংস মানুষ নিতে চায় না।”

পশুর স্বাস্থ্য পরীক্ষা ছাড়াই রংপুর বিভাগজুড়ে প্রতিদিন গড়ে দেড় হাজারের বেশি পশু জবাই করা হচ্ছে।

রংপুরের কাউনিয়া উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা এ আর এম আল মামুন বলেন, “মানুষের আর্থিক অবস্থা ভালো না, তাই অসুস্থ হলেই মাংস বিক্রি করে কিছু টাকা পাওয়ার আশায় গরু জবাই করে দিচ্ছে।”

পীরগাছা উপজেলার খামারি মজিদ মিয়া বলেন, “বর্তমানে যে অবস্থা, তাতে পশু ও মানুষের নিরাপত্তা একসঙ্গে মারাত্মক হুমকির মুখে পড়ছে। পশুর রোগ মানবদেহে চলে যাচ্ছে।”

একই এলাকার খামারি আলম সিকদার বলেন, “আগে কখনও এই ধরনের রোগের মুখোমুখি হইনি। এই জেলায় গরু পালন বা খামারে গরু রাখা এখন অনিরাপদ হয়ে গেছে। আমরা ব্যাপক লোকসানের মুখে পড়েছি।”

গত জুলাই ও সেপ্টেম্বরে পীরগাছা উপজেলায় অ্যানথ্রাক্সের উপসর্গ নিয়ে দুজনের মৃত্যু হয়েছে। একই সময়ে অ্যানথ্রাক্স রোগে উপজেলার চারটি ইউনিয়নে প্রায় ৩০০ জন আক্রান্ত হন। আর মারা গেছে দুই শতাধিক গরু।

দেশে রোগের প্রকোপ ও প্রাদুর্ভাব নজরদারি করা প্রতিষ্ঠান জাতীয় রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর)-এর একটি প্রতিনিধিদল গত সেপ্টেম্বরে পীরগাছা উপজেলার সদর ও পারুল ইউনিয়নে অ্যানথ্রাক্সের উপসর্গ থাকা ১২ নারী-পুরুষের নমুনা সংগ্রহ করে।

তারা জানায়—ফ্রিজে রাখা গরুর মাংসেও অ্যানথ্রাক্সের জীবাণু পাওয়া গেছে। এছাড়া ছাগলের মাংসের সংস্পর্শে এসেও একজনের দেহে অ্যানথ্রাক্স শনাক্ত হয়েছে।

প্রাণিসম্পদ বিভাগ জানিয়েছে, আক্রান্ত এলাকাগুলোতে জরুরি টিকাদান কর্মসূচি চালু রয়েছে। পাশাপাশি স্থানীয়দের সচেতন করতে মাইকিং, লিফলেট বিতরণ ও গ্রামভিত্তিক সভা আয়োজন করা হচ্ছে।

জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা আবু ছাইদ বলেন, “রংপুর জেলায় প্রায় ১৩ লাখের বেশি গরু, ছাগল ও ভেড়া আছে। গত ২৬ আগস্ট থেকে এখন পর্যন্ত পীরগাছা, কাউনিয়া, মিঠাপুকুর ও রংপুর সদরে ১ লাখ ৬৫ হাজারের বেশি গবাদিপশুকে অ্যানথ্রাক্স রোগের প্রতিরোধী টিকা দেওয়া হয়েছে।”

আইইডিসিআর পরিচালক তাহমিনা শিরীন সাম্প্রতিক দেশকালকে বলেন, “অ্যানথ্রাক্স থেকে নিরাপদ থাকতে হলে অসুস্থ গরু, ছাগল বা অন্য কোনো গবাদিপশু জবাই করা যাবে না। তাদের চিকিৎসা করাতে হবে। আর মারা গেলে মাটিতে গভীর গর্ত করে পুঁতে ফেলতে হবে। কোনো অবস্থাতেই মৃত পশুকে খাল বা জলাশয়ে ফেলা যাবে না।”

অসুস্থ গরু বা ছাগল জবাই করলে অ্যানথ্রাক্স ছড়াতে পারে জানিয়ে তিনি বলেন, “সবার প্রতি আমাদের পরামর্শ হলো—অসুস্থ পশু জবাই করবেন না এবং সেগুলোর সংস্পর্শে আসবেন না। এটি ভয়ের নয়, বরং সতর্কতার বিষয়। আতঙ্কিত না হয়ে সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে।”

তিনি আরও বলেন, মৃত পশুর মাংস বা চামড়া ব্যবহার না করা এবং টিকা দেওয়া—প্রতিরোধের প্রধান উপায়।

রংপুরের কাউনিয়া উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা এ আর এম আল মামুন বলেন, “৯ সেপ্টেম্বর থেকে ১৬ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত কাউনিয়ায় ছয়জন আক্রান্ত হয়েছিলেন। এখন পাঁচজন পুরোপুরি সুস্থ হয়েছেন, তবে একজনের হাতে দাগ রয়েছে।”

এই উপজেলার জন্য আসা ৩৫ হাজার ভ্যাকসিনের মধ্যে প্রায় ৩৪ হাজার পশুকে টিকা দেওয়া হয়েছে।

প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা মামুন বলেন, “এই রোগের জীবাণু ৭০ বছর পর্যন্ত মাটিতে টিকে থেকে সংক্রমণ ঘটাতে পারে। কোনো পশু মারা গেলে মাটির ছয় ফুট গভীরে পুঁতে ফেলতে হবে।”

অ্যানথ্রাক্স আক্রান্ত গরুর জ্বর বেশি থাকে উল্লেখ করে তিনি বলেন, “তাই প্রতিটি বাজারে প্রতিদিন যে পশু জবাই করা হবে, তার প্রাথমিকভাবে জ্বর মেপে সন্দেহ হলে আরও গভীরভাবে পরীক্ষা করা হচ্ছে।

আইইডিসিআরের তথ্যমতে, অ্যানথ্রাক্স একটি মারাত্মক প্রাণিবাহিত রোগ, যা বাংলাদেশে মানুষ ও পশু উভয়ের জন্যই বিপদজনক অবস্থানে রয়েছে, বিশেষ করে উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোতে।

অ্যানথ্রাক্স মূলত তৃণভোজী প্রাণীর রোগ। এ রোগে আক্রান্ত গবাদিপশুর প্রায়ই প্রাণহানি ঘটে। এই রোগে আক্রান্ত পশুর সংস্পর্শে আসা, দূষিত চামড়া, হাড় বা পশম নাড়াচাড়া করা, কিংবা কাঁচা বা পুরোপুরি রান্না না করা মাংস খাওয়ার মাধ্যমে মানুষের মধ্যেও সংক্রমণ ঘটতে পারে।

রোগটির জীবাণু মানবদেহে প্রবেশের পর লক্ষণ প্রকাশের সময়কাল ১ থেকে ২০ দিন। যদিও মানুষের মধ্যে এর সংক্রমণ তুলনামূলকভাবে কম, তবে দেরিতে রোগ নির্ণয় হলে তা মারাত্মক হতে পারে।

অ্যানথ্রাক্সের উপসর্গের মধ্যে রয়েছে জ্বর, ক্ষতের মতো গোলাকার ফুসকুড়ি, কখনও কখনও চুলকানি।

উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে অ্যান্টিবায়োটিক ও লোশন দিয়ে এর চিকিৎসা পাওয়া যায়।

আইইডিসিআরের তথ্যমতে, ২০১০ সাল থেকে প্রতি বছরই বিক্ষিপ্তভাবে এ রোগের প্রাদুর্ভাবের খবর পাওয়া যায়। আগের প্রাদুর্ভাবের তথ্যের ভিত্তিতে ২০১৯ সালে আইইডিসিআর পাঁচ জেলার (সিরাজগঞ্জ, পাবনা, মেহেরপুর, টাঙ্গাইল ও রাজশাহী) নয়টি উপজেলায় সক্রিয় অ্যানথ্রাক্স নজরদারি কার্যক্রম শুরু করে।

রংপুরে ৩০ লাখ টিকা সরবরাহের উদ্যোগ

গত ৫ অক্টোবর মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, অতিসত্ত্বর প্রাণিসম্পদ গবেষণা প্রতিষ্ঠান (এলআরআই) রংপুর বিভাগে প্রায় ৩০ লাখ অ্যানথ্রাক্স টিকা সরবরাহ করবে, যার মধ্যে রংপুর ও গাইবান্ধা জেলাতেই ২০ লাখ টিকা পাঠানো হবে।

রংপুর জেলার নয়টি উপজেলায়—পীরগাছা (৫৩ হাজার ৪০০), কাউনিয়া (৩৪ হাজার), রংপুর সদর (২৬ হাজার ৫০০), মিঠাপুকুর (৩৪ হাজার ৫০০), গঙ্গাচড়া (৪ হাজার ৮০০), তারাগঞ্জ (৪ হাজার ৩০০), বদরগঞ্জ (৫ হাজার) ও পীরগঞ্জে (৫ হাজার)—এখন পর্যন্ত ১ লাখ ৬৭ হাজার গরুকে টিকা দেওয়া হয়েছে।

জেলার ৩৬টি কসাইখানায় গবাদিপশুর স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য ৩৬টি মেডিকেল টিম গঠন করা হয়েছে। টিকা দেওয়ার জন্য কাজ করছে আরও ৩২টি মেডিকেল টিম।

গাইবান্ধা জেলার সুন্দরগঞ্জ উপজেলায় ২৬ হাজার ৪০০ গরুকে টিকা দেওয়া হয়েছে। আক্রান্ত এলাকায় দ্রুত প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা হিসেবে গরু পুঁতে ফেলা, টিকাদান, মাইকিং, উঠান বৈঠক ও লিফলেট বিতরণ করা হয়েছে। পাঁচটি ভেটেরিনারি মেডিকেল টিম গঠন করা হয়েছে।

রক্তের ১১টি নমুনা পরীক্ষায় সবগুলো নেগেটিভ পাওয়া গেলেও মাংসের ১১টি নমুনার মধ্যে ১০টি পজিটিভ পাওয়া গেছে।

মন্ত্রণালয়ের পরামর্শে রংপুর ও গাইবান্ধা জেলায় অ্যানথ্রাক্স সংক্রমণের উৎস ও পরিস্থিতি মূল্যায়নের জন্য প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর একটি উচ্চ পর্যায়ের অনুসন্ধান টিমও গঠন করেছে।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫