মেট্রোরেল: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আশঙ্কা কতটা সত্য হলো?

হারুন ইসলাম
প্রকাশ: ১৩ অক্টোবর ২০২৫, ১৬:৪৭

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতর দিয়ে মেট্রোরেলের লাইন নিয়ে যাওয়ার সময় যে প্রবল বিরোধিতা এবং যেসব সম্ভাব্য সমস্যা ও ক্ষতির কথা বলাবলি হচ্ছিল, সেগুলো এখন আর তেমন আলোচনায় নেই।
শিক্ষার্থীরা কিছু কিছু সমস্যার কথা বললেও তারা ব্যাপক মাত্রায় এই ট্রেন ব্যবহার করে যাতায়াত করছেন, স্বল্পতম সময়ে যাতায়াত করতে পেরে উচ্ছ্বাসও প্রকাশ করছেন।
যানজটে জর্জর ঢাকাবাসীর জন্য মেট্রোরেল এসেছে এক নতুন স্বস্তির বাতাস হয়ে। রাজধানীর উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত দ্রুত ও নির্ভরযোগ্য যাতায়াতের এই মাধ্যমটি নাগরিক জীবনে গতি এনেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা টিএসসি সংলগ্ন মেট্রো স্টেশন থেকে ট্রেনে চড়েন বা এখানে নামেন।
২০১৯ সালে যখন প্রথম এই স্টেশন স্থাপনের প্রস্তাব ওঠে, তখন তীব্র বিরোধিতা হয়েছিল। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাস্তবতা বদলেছে। এখন মেট্রোরেল ঢাবির ছাত্রছাত্রীদের জীবনের এক অপরিহার্য অংশ হয়ে উঠেছে। কেউ কেউ বলছেন, এটি একবিংশ শতাব্দীর আধুনিকতার প্রতীক; আবার অনেকে মনে করছেন, এটি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বকীয়তা ও স্বাধীন পরিবেশের উপর এক ধরনের চাপ।
শিক্ষার্থীদের বড় একটি অংশ মনে করেন—মেট্রো স্টেশন তাদের জন্য আশীর্বাদ। বিশেষ করে যারা প্রতিদিন উত্তরা, কাজীপাড়া, মিরপুর বা আগারগাঁও থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে আসেন, তাদের জন্য এটি সময় বাঁচানোর সুন্দর এক সমাধান।
আগে যেখানে ক্লাসে পৌঁছতে এক থেকে দেড় ঘণ্টা লেগে যেত, এখন মেট্রোরেলে ২০ থেকে ২৫ মিনিটেই গন্তব্যে পৌঁছানো যাচ্ছে। অনেক শিক্ষার্থী বলছেন, এই সময় সাশ্রয় তাদের পড়াশোনায় মনোযোগ এবং মানসিক প্রশান্তি দুটোই বাড়িয়েছে।
মেট্রোরেল নির্মাণের সময় একটি বড় উৎকণ্ঠা ছিল—এটি শব্দদূষণের কারণ হবে কি না।
এখন পরিস্থিতি কী?—এই প্রশ্নে সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী আল আমিন বলেন, “আমরা লাইব্রেরিতে পড়তে আসি, তাদের অনেক সমস্যা হয়ে গেছে। মেট্রোরেলের পথ লাইব্রেরির পাশ দিয়ে হওয়ায় যাওয়া–আসার সময় অনেক শব্দ হয়।
“শুধু তাই নয়, টিএসসি এলাকায় স্টেশন হওয়ায় এখন সারাক্ষণ ভিড় আর শব্দ থাকে। বহিরাগতদেরও সংখ্যা অনেক বেড়ে গেছে। এটা আমাদের নিরাপত্তা আর পড়াশোনার পরিবেশের জন্য ভালো না।”
ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী সাবিহা রহমান বলেন, “টিএসসি আমাদের সংস্কৃতির প্রতীক। এখন সেখানে সারাক্ষণ ট্রেনের শব্দ, মানুষের ভিড় আর বাণিজ্যিক পরিবেশ তৈরি হচ্ছে। একসময় এই জায়গাটা হয়তো তার ঐতিহ্যই হারিয়ে ফেলবে।”
ট্রেনে শিক্ষার্থীদের জন্য ভাড়ায় ছাড় দেওয়ার দাবি একাধিকবার কর্তৃপক্ষ নাকচ করলেও এখনও এই দাবি তোলা হচ্ছে।
বিজয় একাত্তর হলের আবাসিক শিক্ষার্থী মো. রায়হান সাম্প্রতিক দেশকালকে বলেন, “অনেকে বলেন, হাফ ভাড়া না থাকলে মেট্রোরেল আমাদের জন্য তেমন কার্যকর নয়। কিন্তু আমি মনে করি, সময়ের মূল্য অনেক বেশি। লোকাল বাসের তুলনায় মেট্রোরেলের ফ্যাসিলিটিগুলো অনেক উন্নত। ভাড়া একটু বেশি হলেও সেটা যুক্তিসঙ্গত। অবশ্য হাফ পাস চালু হলে আমরা আরও খুশি হব।”
তবে এ বিষয়ে সবাই একমত নন। অনেকের অভিযোগ, মেট্রোরেলের ভাড়া শিক্ষার্থীদের জন্য বেশ ব্যয়বহুল হয়ে দাঁড়িয়েছে। মিরপুর বা উত্তরা থেকে প্রতিদিন যাতায়াতকারী শিক্ষার্থীদের মাসিক ব্যয় প্রায় তিনগুণ বেড়ে গেছে। আগে বাসে যেখানে মাসে এক হাজার টাকার মধ্যেই চলত, এখন সেখানে তিন হাজার টাকার কাছাকাছি লাগছে।
উত্তরা থেকে আসা ফলিত গণিত বিভাগের শিক্ষার্থী নাফিসা তাসনিম বলেন, “সময় বাঁচছে ঠিকই, কিন্তু আমাদের মতো শিক্ষার্থীদের জন্য এতটা বাড়তি খরচ টানা কঠিন হয়ে যাচ্ছে। হাফ ভাড়া না থাকায় মেট্রোরেল অনেকের নাগালের বাইরে থেকে যাচ্ছে।”
ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল) জানায়, মেট্রোরেল একটি উচ্চ ব্যয়সাপেক্ষ প্রকল্প। ট্রেন পরিচালনা, বিদ্যুৎ সরবরাহ, রক্ষণাবেক্ষণ, নিরাপত্তা এবং টিকিটিং সিস্টেমের ব্যয় মেটাতে বিশেষ ছাড় দেওয়া সম্ভব নয় বলে জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ।
সংস্থাটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফারুক আহমেদ একাধিক সময় বলেছেন, “ছাত্রছাত্রীদের জন্য আলাদা ছাড় রাখা হবে না; তবে এমআরটি পাস ব্যবহার করলে সব যাত্রী ১০ শতাংশ ছাড় পাবেন।”
এই অবস্থান শিক্ষার্থীদের হতাশ করেছে। তাদের মতে, দেশের অন্যান্য পরিবহনে যেমন ছাত্রদের জন্য ছাড় চালু আছে, মেট্রোরেলেও সেটি থাকা উচিত ছিল।