‘স্বপ্নের’ কর্ণফুলী টানেল এখন অর্থনীতির বোঝা

নিশাত বিজয়
প্রকাশ: ১৪ অক্টোবর ২০২৫, ১৬:০৩
-68ee1feccba17.jpg)
আনোয়ারা সদর থেকে কর্ণফুলী টানেল পেরিয়ে শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে যেতে সময় লাগবে ১৫ মিনিট। এরমধ্যে টানেল পার হতে সময় লাগবে সাড়ে তিন মিনিট।
চালুর সময় একে বলা হয়েছিল ‘বাংলাদেশের স্বপ্নের টানেল’। কিন্তু এক বছর পর সেই টানেল এখন সরকারের জন্য আর্থিক বোঝা।
চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মিত দেশের প্রথম সুড়ঙ্গপথ ‘কর্ণফুলী টানেল’ চালুর পর এক বছর পেরিয়ে গেলেও প্রত্যাশিত সুফল মিলছে না। টোল আদায় হচ্ছে অল্প, প্রকল্পটির কর্মচারী ও রক্ষণাবেক্ষণের ব্যয় হচ্ছে তার চেয়ে বহু বেশি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কর্ণফুলী টানেল বিগত সরকারের জন্য এক প্রতীকী সাফল্য হলেও বর্তমানে এটি অর্থনীতিতে বড় দায় হয়ে দাঁড়াচ্ছে। পরিকল্পনার সঙ্গে বাস্তবতার বিস্তর ব্যবধানেই এই মেগাপ্রকল্প এখন ‘সাদা হাতি’ হয়ে উঠছে।
কর্ণফুলী টানেল নির্মাণের অন্যতম লক্ষ্য ছিল চট্টগ্রাম নগর ও নদীর ওপারের আনোয়ারা–কর্ণফুলী উপজেলাকে যুক্ত করে ‘ওয়ান সিটি, টু টাউন’ মডেল গড়ে তোলা। কিন্তু সেই পরিকল্পনা এখন বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেই। আনোয়ারা প্রান্তে এখনো শিল্পায়ন হয়নি, পতেঙ্গা ও বে টার্মিনালও হয়নি। ফলে টানেল ব্যবহারকারীর সংখ্যা বাড়ছে না।
বিশেষজ্ঞদের মতে, দক্ষিণ চট্টগ্রাম ও উপকূলীয় অঞ্চলে শিল্পায়ন না ঘটলে এই টানেলের সুফল নাগরিকদের নাগালের বাইরে থেকেই যাবে। টানেলের প্রকৃত সুফল পেতে হলে এর আশপাশের শিল্প ও অবকাঠামো উন্নয়ন জরুরি।
সড়ক পরিবহন ও সেতু উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান সাম্প্রতিক দেশকালকে বলেন, “আগে সরকার সে কাজটা করেনি, কিন্তু কথা বলছিল যে ‘ওয়ান সিটি, টু টাউন’ করবে—মানে ওই পাশেও টাউনের একটা অংশ শিফট করবে। কিন্তু কোরিয়ান ইপিজেট ছাড়া তেমন কোনো প্রকল্প নেই।”
‘ওয়ান সিটি, টু টাউন’ প্রকল্প করার কাজটি সিডিএ (চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ) ও সিটি করপোরেশনের করার কথা। কিন্তু এটা এখনই সম্ভব নয়, বলছেন ফাওজুল।
টানেল ব্যবহারের খরচ বেশি
আনোয়ারার রুবেল গুপ্ত দাশ প্রতিদিন আগ্রাবাদ অফিসে যান শাহ আমানত সেতু পেরিয়ে।
তিনি বলেন, “টানেল ব্যবহার করলে গাড়িপ্রতি ২৫০ টাকা টোল দিতে হয়, এরপর ফ্লাইওভারেও দিতে হয় আলাদা টোল। এতে দৈনিক ৩০০–৩৫০ টাকা বেশি খরচ পড়ে। সেতু দিয়ে গেলে খরচ কম, সময়ও খুব একটা বেশি লাগে না।”
আবার টানেলে সব যানবাহন চলার অনুমতিও নেই।
কর্ণফুলী থানার বাসিন্দা মোহাম্মদ পারভেজ ইসলাম বলেন, “আমি মোটরসাইকেলে চলি, কিন্তু টানেলে সেটার অনুমতি নেই। তাই বোটে করেই যাই। প্রতিদিন যাওয়া–আসায় ২০ টাকা লাগে, বাসে গেলে ১০০ টাকা লাগবে।”
তার মতে, মোটরসাইকেল ও সিএনজি চলাচলের অনুমতি দিলে আয়ও বাড়ত, আমরাও উপকৃত হতাম।
আবার সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর অনুমোদিত হেডরুম ৫ দশমিক ৫ মিটার হলেও টানেলে রাখা হয়েছে মাত্র ৪ দশমিক ৯ মিটার। ফলে ভারী ট্রাক চলাচলে বাধা তৈরি হচ্ছে।
নিরাপত্তাজনিত কারণে দাহ্য পদার্থবাহী গাড়িও নিষিদ্ধ। সব মিলিয়ে ভারী যানবাহনের ব্যবহার প্রায় নেই বললেই চলে।
আয় কম, ব্যয় বেশি
বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের ২৮ অক্টোবর থেকে ২০২৫ সালের ২২ অক্টোবর পর্যন্ত টানেল দিয়ে চলেছে ১৪ লাখ ১১ হাজার ৪১২টি যানবাহন—গড়ে প্রতিদিন প্রায় ৩ হাজার ৯১০টি। যেখানে প্রাথমিক পূর্বাভাস ছিল প্রতিদিন ১৮ হাজার ৪৮৫টি।
এই এক বছরে টোল আদায় হয়েছে ৩৭ কোটি ৪৪ লাখ টাকা, প্রতিদিন গড়ে আয় ১০ লাখ ২৬ হাজার টাকার মতো। কিন্তু পরিচালন ও রক্ষণাবেক্ষণ খরচ বছরে দাঁড়িয়েছে ১৩৬ কোটি ৭২ লাখ টাকা—অর্থাৎ প্রতিদিন প্রায় ৩৭ লাখ ৪৬ হাজার টাকা।
ফলে বার্ষিক আয়–ব্যয়ের ঘাটতি প্রায় ৯৯ কোটি ৩০ লাখ টাকারও বেশি।
পরিকল্পনা ছিল, বাস্তবায়ন নেই
চট্টগ্রামের শিপিং এজেন্ট মো. পার্থ তাজবির বলেন, যে পরিকল্পনায় টানেল হয়েছে সেটিই বাস্তবায়ন হয়নি। আনোয়ারা–বাঁশখালী এলাকায় শিল্পায়ন হয়নি, মাতারবাড়ী প্রকল্পও হয়নি। ফলে ভারী ট্রাক বা পণ্যবাহী যান টানেল ব্যবহার করছে না।
তিনি জানান, শাহ আমানত সেতুর টোল টানেলের চেয়ে আড়াই থেকে ছয় গুণ কম হওয়ায় অনেকেই খরচ বাঁচাতে টানেল এড়িয়ে যাচ্ছেন।
অর্থনীতিবিদ মইনুল ইসলাম বলেন, “চালুর প্রথম পাঁচ বছর টানেল সক্ষমতা অনুযায়ী ব্যবহার হবে না। মিরসরাই শিল্পনগর, মাতারবাড়ী বন্দর, কক্সবাজার পর্যন্ত সড়ক প্রসারিত না হলে সুফল মিলবে না।”
চীনের এক্সিম ব্যাংকের ঋণে এবং সরকারি অর্থায়নে ১০ হাজার ৬৮৯ কোটি টাকায় নির্মিত হয়েছে কর্ণফুলী টানেল। এর মধ্যে ৬ হাজার ৭০ কোটি টাকা ঋণ। ২০২৩ সালের ২৯ অক্টোবর এটি উদ্বোধন করা হয়।
যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের অধ্যাপক সামসুল হক বলেন, “মাটির নিচের প্রকল্পে সময় যত বাড়ে, অপারেশন খরচ তত বেড়ে যায়। এখন টানেল থেকে লাভের আশা করা অবাস্তব।”
উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান সাম্প্রতিক দেশকালকে বলেন, “এখন কিছু করার নাই। ট্রাফিক ফোকাস না করেই এ প্রকল্প সে সময় হাতে নেওয়া হয়। শাহ আমানত সেতু দিয়ে যারা যাতায়াত করে তাদেরকে যেন এ রাস্তায় আনা যায়, তাহলে ট্রাফিক বাড়বে। কক্সবাজারের রাস্তাও সংযুক্ত করা হবে—কারণ এখানে তো ট্রাফিক জেনারেট করতে হবে।”
এ প্রকল্পের সঙ্গে অনেকগুলো সহায়ক প্রকল্প হওয়ার কথা ছিল। সেগুলোর অগ্রগতি কী—এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, “কর্ণফুলী টানেলে ট্রাফিক মুভমেন্ট বাড়ানোর জন্য আমরা কিছু লিংক রোড কাটছি, যাতে তারা এদিকে আসে। এখান দিয়ে যাওয়ার কোথাও জায়গা নাই—তাই কক্সবাজার, পটিয়া বা অন্যান্য রাস্তার সঙ্গে যোগ করার চেষ্টা চলছে।”