Logo
×

Follow Us

প্রচ্ছদ প্রতিবেদন

এইচএসসির ফলাফলে ধস কেন?

Icon

তানিয়া আক্তার

প্রকাশ: ১৮ অক্টোবর ২০২৫, ১৭:০৮

এইচএসসির ফলাফলে ধস কেন?

এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশের পর পুরো দেশজুড়ে শুরু হয়েছে বিস্তর আলোচনা, বিতর্ক এবং আত্মজিজ্ঞাসা। গত দুই দশকের মধ্যে এবারই প্রথম পাসের হার ৬০ শতাংশের নিচে নেমে এলো কেন?

প্রায় ১২ লাখ পরীক্ষার্থীর মধ্যে পাস করেননি ৫ লাখেরও বেশি। জিপিএ-৫ প্রাপ্তির সংখ্যাও নেমে এসেছে ৬৯ হাজারে, যা গত বছরের তুলনায় প্রায় অর্ধেক।

ফলাফল বিশ্লেষণে দেখা গেছে, বড় শহরের তুলনায় এবার মফস্বল বা গ্রামের কলেজগুলোর ফলাফল বেশি খারাপ হয়েছে। ইংরেজিতে দুর্বলতা আবারও সামনে এসেছে।

আন্তঃশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় কমিটির সভাপতি খন্দোকার এহসানুল কবির দাবি করছেন, খাতা মূল্যায়নে কড়াকড়ির কারণে যে যত নম্বর পাওয়ার যোগ্য, তাকে তত নম্বরই দেওয়া হয়েছে—এই কারণেই ফলাফল এমন।

তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ এত সরল ব্যাখ্যায় সন্তুষ্ট নন। তিনি শহর ও মফস্বলের শিক্ষার মানের পার্থক্য ঘোচাতে না পারা, এমনকি ২০২৪ সালের রাজনৈতিক অস্থিরতার প্রভাবকেও দায়ী করছেন।

শিক্ষা পরিসংখ্যান ব্যুরো (ব্যানবেইস) জানাচ্ছে, ২০০৫ সালে এইচএসসিতে পাসের হার ছিল ৫৯ শতাংশ। তারপর থেকে এই হার আর নিচে নামেনি; বরং বিভিন্ন বছরে ৭০ থেকে ৯৫ শতাংশের মধ্যে ওঠানামা করেছে।

ফল বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ২০০৫ সালে পাসের হার ছিল ৫৯ শতাংশের বেশি, ২০০৬ সালে প্রায় ৬৪ শতাংশ, ধারাবাহিকভাবে বাড়তে বাড়তে ২০১২ সালে হয় ৭৮ দশমিক ৬৭ শতাংশ।

এরপর থেকে প্রতি বছর কিছুটা কমে ২০১৮ সালে তা ৬৬ দশমিক ৬৪ শতাংশে নেমে আসে। পরের বছর আবার প্রায় ৭৪ শতাংশে ওঠে।

কোভিড-১৯-পরবর্তী সময়ে অটোপাস, গ্রেস নম্বর এবং নমনীয় মূল্যায়নের কারণে ফলাফল ছিল ভালো। ২০২১ সালে পাসের হার ছিল ৯৫ দশমিক ২৬ শতাংশ, ২০২২ সালে ৮৫ দশমিক ৯৫ শতাংশ, ২০২৩ সালে ৭৮ দশমিক ৬৪ শতাংশ।

২০২৪ সালে পাসের হার ছিল ৭৭ দশমিক ৭৮ শতাংশ। এবার তা এক ধাক্কায় নেমে এসেছে ৫৮ দশমিক ৮৩ শতাংশে।

এবার ২০২টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে একজন শিক্ষার্থীও পাস করেনি। গত বছর এই সংখ্যাটি ছিল মাত্র ৬৫।

আন্তঃশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় কমিটির সভাপতি ও ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান খন্দোকার এহসানুল কবির বলেন, “আমাদের বিবেচনায় উত্তরপত্র মূল্যায়ন যথেষ্ট ভালোভাবে হয়েছে, এবং সেই হিসাবে যথাযথ ফলাফলই আমাদের কাছে এসেছে। আমরা কাউকে কোনো ছক বেঁধে দিইনি বা নির্দিষ্ট নির্দেশ দিইনি যে, তিনি এভাবে নম্বর দেবেন বা ওভারমার্কিং করবেন।”

তবে খাতা দেখার কড়াকড়িতে এমন ফলাফল হয়েছে—এই সরল ব্যাখ্যায় যেতে চান না ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ।

তিনি সাম্প্রতিক দেশকালকে বলেন, “কেন খারাপ হলো, তার সুনির্দিষ্ট গবেষণা হয় না—এই কারণেই জানা যায় না। আমরা অনুমানভিত্তিক কথা বলি। এ নিয়ে বিশ্লেষণ দরকার।”

এই শিক্ষক দেশে শিক্ষার গুণগত মান নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন।

তিনি বলেন, “শিক্ষক দক্ষতা, পাঠ্যক্রম এবং পাঠদান—সবকিছুতেই মান নিশ্চিত করতে হবে। এমন খারাপ ফলাফলের ধারাবাহিকতা থাকলে শিক্ষার্থীরা ভেঙে পড়তে পারে। তবে শুধু ফল নয়, শিক্ষার মানের দিকেও নজর দিতে হবে।

শিক্ষা ব্যবস্থাকে শুধুমাত্র পরীক্ষাভিত্তিক ও সার্টিফিকেটমুখী না রেখে গুণগত শিক্ষা, দক্ষতা, নৈতিকতা ও বাস্তব জীবনে প্রয়োগযোগ্য জ্ঞান অর্জনের দিকে ধাবিত করতে হবে।”

মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ আরও বলেন, “এই ফলাফল যদি শিক্ষা ব্যবস্থাকে আত্মসমালোচনার সুযোগ করে দেয়, তাহলে এই কঠিন ফলাফল হয়তো ভবিষ্যতের জন্য দরকারি একটি মোড় পরিবর্তনের সূচনা হতে পারে।”

২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানও পরীক্ষার্থীদের মনে প্রভাব ফেলতে পারে বলে মনে করেন তিনি।

“তারা সে সময় অনেক মাস ক্লাস পায়নি। আর গণঅভ্যুত্থানের পর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অনেক শিক্ষককে সরে যেতে বাধ্য করা হয়। এ কারণেও পড়াশোনায় ব্যাঘাত ঘটতে পারে,” বলেন এই শিক্ষক।

বেশি অকৃতকার্য ইংরেজিতে

আন্তঃশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় কমিটির চেয়ারম্যান জানান, এবার সবচেয়ে বেশি ফেল করেছে ইংরেজি বিষয়ে। বোর্ডভেদে ৩৫ থেকে ৪৫ শতাংশ পরীক্ষার্থী পর্যন্ত অকৃতকার্য হয়েছেন এই একটি বিষয়ে।

সবচেয়ে কম ৫৪ দশমিক ৮২ শতাংশ পরীক্ষার্থী পাস করেছেন ইংরেজিতে। কিছু বোর্ডে পাসের হার ৫০ শতাংশের সামান্য বেশি।

পাসের হারের দিক দিয়ে মানবিক বিভাগের ফল সবচেয়ে খারাপ। এই বিভাগে প্রতি দুই জনের একজনই পাস করতে পারেননি।

ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগে পাসের হার এবার ৫৫ দশমিক ৫২ শতাংশ। সেই তুলনায় বিজ্ঞান বিভাগের চিত্র তুলনামূলক ভালো—পাসের হার ৭৫ শতাংশের কিছু বেশি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের শিক্ষক মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ বলেন, “মানবিক বিভাগ যারা নেয়, তারা সাধারণত পড়াশোনায় দুর্বল। আর্থিকভাবে সচ্ছল ও মেধাবী শিক্ষার্থীরা সাধারণত বিজ্ঞান নেয়। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকেও তাদের বিজ্ঞান নিতে উৎসাহিত করা হয়। যারা পড়াশোনায় দুর্বল, তারা গণিত ও ইংরেজি বিষয়েই বেশি সমস্যায় পড়ে। এ কারণেই মানবিকে পাসের হার কম, আর ইংরেজিতে এই বিভাগের শিক্ষার্থীরাই বেশি ফেল করেছে বোঝা যাচ্ছে।”

ইংরেজিতে সবচেয়ে বেশি ৭৫ দশমিক ১৬ শতাংশ পাস করেছে বরিশাল বোর্ডে। ঢাকা বোর্ডে পাসের হার ৭৩ দশমিক ৬৬ শতাংশ।

রাজধানীর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর মান তুলনামূলক ভালো হওয়ায় এখানে সামগ্রিক ফলাফলও ভালো—ঢাকা মহানগরে পাসের হার ৮০ শতাংশের বেশি।

আঞ্চলিক বৈষম্য: শহর বনাম মফস্বল

ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান বলেন, “ঢাকা মহানগরীতে পাসের হার ৮৪ শতাংশ হলেও শরীয়তপুর ও গোপালগঞ্জে তা ৪২ শতাংশ। ঢাকা বিভাগের অন্য দুই জেলা টাঙ্গাইলে এটি ৪৪ শতাংশ, রাজবাড়ীতে প্রায় ৪৬। মফস্বলের মধ্যে নরসিংদীর অবস্থা তুলনামূলক ভালো—সেখানে পাসের হার ৬৮ শতাংশ।”

এভাবে দেখা গেছে, মফস্বল ও গ্রামের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো তুলনামূলক বেশি খারাপ করেছে। এটি অবশ্য প্রতি বছরই একই রকম প্রবণতা।

কোন বোর্ডে কত পাস

চলতি বছর ৯টি সাধারণ শিক্ষা বোর্ডের মধ্যে পাসের হারে এগিয়ে ঢাকা শিক্ষা বোর্ড। সবচেয়ে পিছিয়ে কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ড।

ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের পাসের হার ৬৪ দশমিক ৬২ শতাংশ, কুমিল্লায় ৪৮ দশমিক ৮৬ শতাংশ।

অন্য বোর্ডগুলোর মধ্যে রাজশাহীতে ৫৯ দশমিক ৪০, যশোরে ৫০ দশমিক ২০, চট্টগ্রামে ৫২ দশমিক ৫৭, বরিশালে ৬২ দশমিক ৫৭, সিলেটে ৫১ দশমিক ৮৬, দিনাজপুরে ৫৭ দশমিক ৪৯ এবং ময়মনসিংহে ৫১ দশমিক ৫৪ শতাংশ শিক্ষার্থী পাস করেছেন।

চলতি বছর এইচএসসি ও সমমানের লিখিত পরীক্ষায় অংশ নেয় ১১টি শিক্ষা বোর্ডের ১২ লাখ ৫১ হাজার ১১১ জন শিক্ষার্থী।

এর মধ্যে ৯টি সাধারণ বোর্ডে পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ১০ লাখ ৫৫ হাজার ৩৯৮ জন, যা গত বছরের তুলনায় ৭২ হাজার ৮৮৩ জন কম। এসব পরীক্ষার্থী দেশের ৪ হাজার ৮০৮টি প্রতিষ্ঠানের অধীনে ১ হাজার ৬০৫টি কেন্দ্রে পরীক্ষা দেয়।

মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের অধীনে আলিম পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ৮৬ হাজার ১০২ জন, যা গত বছরের চেয়ে ১ হাজার ৯৭৪ জন কম। ২ হাজার ৬৮২টি মাদ্রাসার এসব শিক্ষার্থী ৪৫৯টি কেন্দ্রে পরীক্ষা দেয়।

কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের অধীনে এইচএসসি (ভোকেশনাল) ও ডিপ্লোমা ইন কমার্স পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ১ লাখ ৯ হাজার ৬১১ জন, যা গত বছরের তুলনায় ৭ হাজার ২৫ জন কম। ১ হাজার ৮২৪টি প্রতিষ্ঠানের এসব শিক্ষার্থী ৭৩৩টি কেন্দ্রে পরীক্ষা দিয়েছে।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫