ওএসডি: কাজ ছাড়া বেতন ভাতার বৃত্ত ভাঙবে কবে

খোকন তালুকদার
প্রকাশ: ২০ অক্টোবর ২০২৫, ১৪:৪৬

প্রশাসনে ওএসডি প্রথা পূর্বেও ছিল, এখনও আছে। কিন্তু এত সংখ্যক অফিসার ওএসডি থাকার নজির কম।
ঘোষণা দিয়েও প্রশাসনে বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বা ওএসডি করে রাখার ধারাবাহিকতা থেকে বের হতে পারেনি সরকার।
সরকারের ৭৩ সচিবের মধ্যে ওএসডি রয়েছেন ৯ জন, যারা সুনির্দিষ্ট কোনো দায়িত্ব পালন করছেন না এক বছরেরও বেশি সময় ধরে। সচিব পদ মর্যাদার আরও তিন কর্মকর্তাকেও ওএসডি করে রাখা হয়েছে।
এ নিয়ে ওএসডিতে যাওয়া ও বর্তমানে কর্মরত সচিবদের মধ্যে রয়েছে বিরূপ প্রতিক্রিয়া। তারা বলছেন, ওএসডি করে তাদের জীবনকে অস্বাভাবিক করে তোলা হচ্ছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন অতিরিক্ত সচিব সাম্প্রতিক দেশকালকে বলেন, “সরকার তাদের কাজে ফেরাক, না হয় অবসরে পাঠিয়ে দিক। এভাবে তো প্রশাসনের শুভ আচরণ প্রকাশ পায় না। এটাও এক ধরনের বৈষম্য।”
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, “ওএসডি সচিবদের মধ্যে দু’একজনের বিষয়ে সরকার সহানুভূতিশীল রয়েছে। তারা হয়তো কাজে ফেরার সুযোগ পেতে পারেন। বাকি কয়েকজনের বিষয়ে বিগত শেখ হাসিনা সরকারের সময়ে রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ রয়েছে। তাদের বিষয়ে বর্তমান সরকার অনড় অবস্থানে রয়েছে।”
ওএসডি সচিবদের বিষয়ে সরকারের তরফ থেকে দ্রুতই সিদ্ধান্তে আসা দরকার বলে মন্তব্য করে ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, “সরকার চাইলে বাধ্যতামূলক অবসরও দিতে পারে। বসিয়ে বসিয়ে বেতন-ভাতা, গাড়ি-বাড়ির সুবিধা দেওয়ার কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ নেই।”
‘এতে অসন্তোষ বাড়ে’
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা রাশেদা কে. চৌধুরী সাম্প্রতিক দেশকালকে বলেন, “প্রশাসনে ওএসডি প্রথা পূর্বেও ছিল, এখনও আছে। কিন্তু এত সংখ্যক অফিসার ওএসডি থাকার নজির কম।”
অভিজ্ঞতাসম্পন্ন কর্মকর্তাদের বসিয়ে রাখলে প্রশাসনে লাভের পরিবর্তে ক্ষতিই বেশি হয় বলে মন্তব্য করে তিনি আরও বলেন, “এতে অসন্তোষ বাড়ে। পদোন্নতির যোগ্য যারা, তারাও নানা কারণে ভীতির মধ্যে থাকে। এখান থেকেও রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তির সৃষ্টি হয়। সরকারের উচিত, যতটা সম্ভব জ্ঞাত অভিযোগগুলো নিষ্পত্তি করে কাজের স্বাভাবিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনা।”
অর্থের অপচয়
সরকারের সাবেক সিনিয়র সচিব খ. ম. কবিরুল ইসলাম সাম্প্রতিক দেশকালকে বলেন, “ওএসডি সচিবদের বিষয়ে দ্রুতই সিদ্ধান্তে আসা দরকার সরকারের পক্ষ থেকে। কাজ না করিয়ে তাদের বসিয়ে বসিয়ে বেতন দেওয়ায় সরকারের অর্থের অপচয় হচ্ছে।”
কাজের ক্ষেত্রে যোগ্য মনে না করলে তাদের অবসরে পাঠানো যেতে পারে বলে মত দিয়ে তিনি বলেন, “এভাবে তাদের রেখে দেওয়া প্রশাসনের সিদ্ধান্তহীনতা ও ভঙ্গুর অবস্থাকেই নির্দেশ করে। আবার কারও মধ্যে রাগ-ক্ষোভও বাড়তে পারে। ভুল কোনো আচরণও তাদের দ্বারা প্রকাশ পেতে পারে। এতে দায়ভারও সরকারের ঘাড়ে আসতে পারে।”
সংস্কার কমিশনের সদস্যও বিরক্ত
জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের সদস্য ছিলেন এমন একজন সাবেক আমলা ওএসডি ও চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ নিয়ে বিরক্তি প্রকাশ করেছেন।
সাম্প্রতিক দেশকালকে তিনি বলেন, “আমরা অনেক গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ দিয়েছি সরকারকে। কিন্তু জনগুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ বাস্তবায়নে সরকার ও জনপ্রশাসনের আগ্রহ কম। এসব নিয়ে আমরা সংবাদমাধ্যমে খোলামেলা তেমন কিছু বলতেও পারছি না।”
ওএসডি নীতি নিয়ে তিনি বলেন, “এটার সঙ্গে সরকারের নানা ধরনের নীতি জড়িত থাকে। পছন্দ-অপছন্দের ব্যাপার জড়িত থাকে, রাজনৈতিক মানসিকতাও বিবেচনায় থাকে। তবে তাদের কাজে ফেরাতে পারলে অনেক দিকেই সফলতা আসতে পারে। এতে অন্যরা কাজের ক্ষেত্রে বৈচিত্র্য দেখতে পাবে। আবার প্রশাসনিক শৃঙ্খলার বিষয়গুলোও অন্যদের জন্য নজির হয়ে থাকবে।”
কাজে ফেরানো সম্ভব না হলে বাধ্যতামূলক অবসরের পথ খোলা আছে বলেও মন্তব্য করেছেন তিনি।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা বলেছেন, ওএসডি সচিবদের বিষয়ে খুব নেতিবাচক অবস্থানে রয়েছে সরকার। তারা বলছেন, ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনা সরকার জনবিরোধী নানা কাজ করিয়েছে এই ওএসডি সচিবদের অনেককেই দিয়ে। তাদের ফিরিয়ে আনা হলে পতিত সরকারের স্বার্থ নিশ্চিত করতে তারা আবার সক্রিয় হতে পারেন বলেও আশঙ্কা আছে অন্তর্বর্তী সরকারে।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের নিয়োগ, পদোন্নতি ও প্রেষণ (এপিডি) অনুবিভাগের অতিরিক্ত সচিব মো. এরফানুল হক সাম্প্রতিক দেশকালকে বলেন, “ওএসডি সচিবদের কাজে ফেরানো হবে কি না, সে বিষয়ে কোনো নির্দেশনা আমাদের কাছে আসেনি। এটা সরকারের উচ্চপর্যায়ের সিদ্ধান্তের বিষয়।
“এ জন্য আলাদা বিভাগ রয়েছে। তাছাড়া উপদেষ্টা পরিষদেও এ সংক্রান্ত কমিটি রয়েছে। তারা যেভাবে সিদ্ধান্ত নেবেন, সে অনুযায়ী পরবর্তী কাজ হবে।”
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের শৃঙ্খলা ও তদন্ত অনুবিভাগের যুগ্ম সচিব সুফিয়া নাজিম বলেন, “কারও নামে ফৌজদারি মামলা বা বিভাগীয় ব্যবস্থার কোনো খবর আপাতত জানা নেই।”
‘দোষ থাকলে বিচার হোক, না থাকলে কাজের সুযোগ দিন’
ওএসডিতে থাকা কয়েকজন সচিব বলেছেন, দোষ থাকলে তাদের বিচার হোক। আর না থাকলে কাজে ফেরার সুযোগ দিক সরকার।
গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় বা দপ্তর না হলেও তুলনামূলক কম গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরে পদায়নের কথাও বলছেন একজন।
তিনি বলেন, “কাজে থাকতে না পারা এক ধরনের মানসিক নির্যাতন। বেশিরভাগেরই অবসরে যাওয়ার বয়স হয়েছে। সরকার চাইলে ইচ্ছা অবসরেও পাঠাতে পারে।”
ওএসডিতে থাকা আরেকজন সচিব বলেন, “আমি অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে ৬ মাস দায়িত্ব পালন করেছি। হঠাৎ করেই আমাকে ওএসডি করা হয়েছে। কেন করা হয়েছে— সে ব্যাখ্যা তো আমি সরকারের কাছে চাইতে পারি না। সরকারের জন্য যা ভালো মনে হয়েছে, তাই করেছে। কিন্তু সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছাড়া এভাবে ওএসডি করলে জনপ্রশাসনের কাজ ও নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে।”
বিচার ছাড়া কর্মহীন করে ঝুলিয়ে রাখায় সামাজিক ও পারিবারিকভাবে হেয় হচ্ছেন বলে মন্তব্য করে তিনি আরও বলেন, “চাকরির কারণে কোনো রাজনৈতিক নেতা বা এমপি-মন্ত্রীর কাজের সঙ্গে যুক্ত থাকতে হয়েছে অনেক আমলাকেই। এমন বহু কর্মকর্তার পদোন্নতিও হয়েছে এই সরকারের আমলে। তাদের নিয়েও তো কম বিতর্ক নেই। তবু তাদেরকে সরকার কাজে রেখেছে। আমরা কাজে ফিরতে পারলে মনোযোগ দিয়েই দায়িত্ব পালন করব।”
ওএসডিতে থাকা নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব পালনকারী সাবেক সচিব শফিউল আজিম সাম্প্রতিক দেশকালকে বলেন, “সরকার যদি আমাকে ওএসডি থেকে মুক্ত করে কোনো দপ্তরে পদায়ন করে, আমি সেখানেই কাজ করব। এতে আমার বা আমাদের আলাদা কোনো পছন্দ নেই। কাজে ফিরতে পারাটা নিঃসন্দেহে সম্মানজনক।”
আওয়ামী লীগ সরকার নির্বাচন কমিশনকে ব্যবহার করে প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন করেছিল, আর আপনি সেই নির্বাচন কমিশনেরই সচিব ছিলেন— এমন মন্তব্যের জবাবে তিনি বলেন, “২০২৪ সালের মে মাসে আমাকে নির্বাচন কমিশনে পদায়ন করা হয়। তারপর কোনো নির্বাচন হয়নি। তারপরও সরকার আমাকে ওএসডি করেছে কেন, সেটি আমার জানা নেই।”
বিব্রত তারাও
একটি মন্ত্রণালয়ের সচিব সাম্প্রতিক দেশকালকে বলেন, “মাঝে মধ্যে কাজের স্বার্থে ওএসডি সচিবদের সঙ্গে দেখা বা মুখোমুখি হতে হয়। তখন কোনো কোনো ক্ষেত্রে নিজেদের কাজ নিয়ে বিব্রতও হতে হয়।
“ব্যাচ ও বয়সে সিনিয়র হওয়ায় ব্যক্তিগত বিষয় খোঁজখবর বা ভালো-মন্দ কিছু বলাও সম্ভব হয় না। আবার অনেকে আত্মসম্মান রক্ষার্থে ঘরের বাইরে তেমন বেরও হন না।”
ওএসডি কর্মকর্তারা কীভাবে সময় পার করেন— এই প্রশ্নে তিনি বলেন, “মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ কম হয়। কাজের ক্ষেত্র নির্দিষ্ট না থাকায় তারা কোনো দপ্তরে যেতে পারেন না। আবার প্রয়োজন না হলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়েও তারা যান না।”
ওএসডি যারা
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মো. মশিউর রহমান ২০২৪ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর থেকে, সেতু বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. মনজুর হোসেন ২০২৪ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর থেকে, আইসিটি বিভাগের সচিব মো. সামসুল আরেফিন ২০২৪ সালের ১২ সেপ্টেম্বর থেকে, স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবারকল্যাণ বিভাগের সচিব মো. আজিজুর রহমান ২০২৪ সালের ২০ আগস্ট থেকে ওএসডি আছেন।
জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের সচিব মো. নূরুল আলমকে ২০২৪ সালের ৮ আগস্ট, মো. রুহুল আমিনকে ২১ সেপ্টেম্বর, মো. মিজানুর রহমান ও নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের সচিব শফিউল আজিমকে ২০২৪ সালের ৩ ডিসেম্বর, নৌপরিবহন সচিব এ কে এম মতিউর রহমানকে ২০২৪ সালের ২ অক্টোবর ওএসডি করা হয়।
গ্রেড–১ভুক্ত আব্দুল্লাহ সাজ্জাদ, মো. জিল্লুর রহমান চৌধুরী ও মো. নাসির উদ্দিন আহমেদও ওএসডিতে রয়েছেন।