Logo
×

Follow Us

প্রচ্ছদ প্রতিবেদন

‘সবচেয়ে দূষিত’ কল্যাণপুরে জীবন কেমন?

Icon

আবুল বাসার সাজ্জাদ

প্রকাশ: ২১ অক্টোবর ২০২৫, ১৬:৪৪

‘সবচেয়ে দূষিত’ কল্যাণপুরে জীবন কেমন?

প্রতিদিনই কল্যাণপুরের বায়ুমান সূচক থাকে ‘অতি অস্বাস্থ্যকর’ বা ‘বিপজ্জনক’ পর্যায়ে।

ঢাকার গাবতলী এলাকায় বাতাসের মান যে খারাপ, তা বোঝা যায় খালি চোখেই। ধুলাবালিতে ছেয়ে থাকে চারপাশ। কিন্তু পাশের কল্যাণপুর এলাকার অবস্থা বাইরে থেকে এতটা খারাপ মনে না হলেও, বাস্তবে এই অঞ্চলটিই বায়ু দূষণের শীর্ষে অবস্থান করছে।

সুইজারল্যান্ডভিত্তিক প্রতিষ্ঠান আইকিউএয়ার-এর তথ্য অনুযায়ী, প্রতিদিনই এ অঞ্চলের বায়ুমান সূচক থাকে ‘অতি অস্বাস্থ্যকর’ বা ‘বিপজ্জনক’ পর্যায়ে।

তবে কল্যাণপুর নামে আইকিউএয়ারের যে রাউটারটি রয়েছে, সেটিতে মূলত শ্যামলী ও গাবতলী এলাকাও অন্তর্ভুক্ত।

এই এলাকার বাসিন্দারা বলছেন, সড়কে বের হলে মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক হয়ে গেছে। শ্বাসকষ্টজনিত কারণে প্রায়ই চিকিৎসা নিতে হয় তাদের।

গাবতলীর বাসিন্দা নুসরাত মারিয়া সাম্প্রতিক দেশকালকে বলেন, “আমি সবসময় মাস্ক ব্যবহার করি। তবুও নাক-মুখ দিয়ে দূষিত বায়ু ঢুকে। কারণ, মাস্ক ধুলাবালি ঠেকায়, কিন্তু এই এলাকার বাতাসই তো দূষিত। অনেক মানুষকেই দেখছি ডাস্ট অ্যালার্জিতে ভুগছে। নাকে সামান্য ধুলা গেলেই সমস্যা হয়।”

কল্যাণপুরের বাসিন্দা সোমাইয়া হক বলেন, “প্রতিদিন সকালবেলা ঘর মুছেও দুপুরে ধুলায় আবার ভরে যায়। জামা-কাপড় সব ময়লা হয়ে যায় বাহিরে একটু বের হলেই।

ছোট ছেলেকে মাস্ক পরিয়ে বাইরে নিয়ে যাই, তবুও ঠান্ডা লেগে যায় কয়েকদিন পর পর। কীভাবে যেন নাক-মুখ দিয়ে ময়লা ঢুকে।”

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গাড়ির কালো ধোঁয়া, সড়কের ধুলাবালি, নির্মাণসামগ্রী ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনার অব্যবস্থাপনাই দূষণের মূল কারণ। গাবতলীর আমিনবাজার, হেমায়েতপুরসহ আশপাশের এলাকায় ইটভাটাও দূষণের বড় উৎস।

স্থানীয়দের অভিযোগ, পুরোনো বাস, ট্রাক, মিনিবাসের কালো ধোঁয়ায় বাতাস ভারী হয়ে থাকে। এতে অনেকের শ্বাসকষ্ট ও চোখে জ্বালাপোড়া হয়।

পরিবেশ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, রাজধানীর মধ্যে সবচেয়ে বেশি দূষণ ধরা পড়ে কল্যাণপুর, গাবতলী ও মিরপুর এলাকার বায়ুতে।

কল্যাণপুর বাসস্ট্যান্ডে সাফা হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্টের দোকানি নাসিমা আক্তার বলেন, “প্রচুর ধুলাবালি উড়ে। দিনে পাঁচবার দোকানের ফ্লোর ঝাড়ু দিলেও ধুলা থেকেই যায়। মাঝে মাঝে পাশের ডাস্টবিন থেকে তীব্র গন্ধও আসে। এই এলাকায় যদি রাস্তা ঝাড়ু দেওয়া আর পানি ছিটানো নিয়মিত করা যেত, তাহলে কিছুটা হলেও ধুলাবালি থেকে বাঁচা যেত।”

৪ নম্বর দক্ষিণ কল্যাণপুরের বিসমিল্লাহ অটো কারের কর্মচারীরা জানালেন, তারা মাঝেমধ্যেই ঠান্ডা, শ্বাসকষ্টসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হন।

চিকিৎসকরা বলছেন, নির্মাণাধীন ভবন, খোলা বালু, ইটের গুঁড়া ও রাস্তার ধুলা—সব মিলিয়ে বায়ুতে ভাসমান অতি সূক্ষ্ম কণা শ্বাসযন্ত্রের দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি করছে। এছাড়া ড্রেন ও খালের ধারে নিয়মিত বর্জ্য ফেলার কারণে পানি ও মাটিও দূষিত হচ্ছে।

এলাকাজুড়ে দুর্গন্ধ আর মশার উপদ্রবও বেড়েছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা।

গাবতলীর বাসিন্দা ওবায়দুর রহমান বলেন, “দূষণের প্রধান কারণ হচ্ছে গরুর হাটের পাশে ইট আর বালুর বাজার। এখান থেকেই গাড়ি লোড-আনলোড করা হয়। ইট-বালু পরিবহনের যাত্রা শুরুই হয় এখান থেকে। সড়কে প্রচুর ধুলা উড়ে।”

ডাস্ট অ্যালার্জিতে ভোগেন ওবায়দুর। নিজেকে কিছুটা সুরক্ষিত রাখতে খুব প্রয়োজন না হলে গাবতলীর ওই জায়গায় যান না।

“এখানে এলে মাস্ক ছাড়া অসম্ভব। রাস্তার ধুলা যে শুধু রাস্তাতেই থাকে তা নয়, দুই কিলোমিটার পর্যন্ত এলাকায় এই ধুলা বাতাসের সঙ্গে উড়ে বেড়ায়।”

পরিবেশ অধিদপ্তরের বায়ুমান ব্যবস্থাপনা শাখার পরিচালক মো. জিয়াউল হক জানান, আইকিউএয়ারের ঢাকায় মোট সাতটি রাউটার রয়েছে। এর মধ্যে কল্যাণপুর নামে যে রাউটারটি আছে, সেটি শ্যামলী ও গাবতলীকেও যুক্ত করেছে।

তিনি বলেন, “রাউটার যদি গাবতলীতে রাস্তার পাশে থাকে, সেক্ষেত্রে দূষণের মাত্রা কিছুটা বেশিই দেখাবে। কারণ, সেখানে ধুলাবালির পরিমাণ অনেক বেশি।”

বসিলাবাসীও অতিষ্ঠ

গাবতলীর পাশের মোহাম্মদপুরের বসিলা এলাকাতেও ধুলার রাজত্ব। তবে আইকিউএয়ার কখনও এই এলাকাকে দূষিত বলে নির্ণয় করে না।

এই এলাকার বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলতে গেলে তারা ক্ষোভ প্রকাশ করেন। রাস্তা পরিষ্কার না করা ও পানি না ছিটানোর অভিযোগ তুলেন তারা।

স্থানীয় বাসিন্দা মো. আলাউদ্দিন বলেন, “সিটি করপোরেশনের আওতাধীন হলেও কোনো সুবিধা পাই না। বরাবরের মতো অবহেলিত। জ্যাম যেমন অনেক, তেমনি যত্রতত্র বর্জ্য ফেলা ও রাস্তায় ধুলাবালি।

সব সময় ধুলাবালি উড়ে সড়কে। সচেতন কেউ মাস্ক ছাড়া যাতায়াত করে না।”

এই এলাকায় জুতা সেলাই ও পালিশের কাজ করেন খোকন দাস। তাকে সবসময় মাস্ক পরে কাজ করতে দেখা যায়।

তিনি বলেন, “এই জায়গায় প্রথম কয়েকদিন মাস্ক ছাড়া বসতাম। পরে খুসখুসে কাশি হতো। এরপর শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। পরে বুঝলাম নাক-মুখ দিয়ে ধুলা ঢুকেই এমন হচ্ছে। এরপর থেকে মাস্ক পরি।”

বসিলাকে আইকিউএয়ার দূষিত এলাকা হিসেবে না দেখানোর কারণ জানতে চাইলে পরিবেশ অধিদপ্তরের বায়ুমান ব্যবস্থাপনা শাখার পরিচালক মো. জিয়াউল হক জানান, “বসিলায় আইকিউএয়ারের কোনো রাউটার নেই।

এই এলাকাটা আসলে দূষিত হবার প্রধান কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে অতিরিক্ত ধুলাবালি, বর্জ্য, ফিটনেসবিহীন যান চলাচল, এবং আশেপাশের ইটভাটা। এসব ইটভাটা থেকে কল্যাণপুর রোড দিয়েই বিভিন্ন এলাকায় ইট ও বালু পরিবহন করা হয়। অনেক সময় বালুবাহী গাড়ি ঢেকে না আনার ফলে বালু রাস্তায় ছড়িয়ে পড়ে। এসব নানা কারণে আইকিউএয়ারে এই এলাকাটা দূষিত দেখায়।”

তিনি আরও জানান, ঢাকার আশেপাশে প্রায় ১৭১টি ইটভাটা দূষণের বড় উৎস।

“ওয়েস্ট বার্নিং কতটা কমিয়ে আনা যায়, সেটা নিয়ে কাজ করছি। প্রতিদিনই আমাদের অধিদপ্তর অভিযান চালাচ্ছে নানা দূষণ নিয়ে। আর সিটি করপোরেশনকে বলেছি যাতে ধুলাবালি উড়ে এমন জায়গায় ঝাড়ু দেয় ও পানি ছিটায়, কিন্তু তাদেরও জনবলের ঘাটতি রয়েছে, ফলে ঠিকমতো কাজগুলো করতে পারছে না,” বলেন এই কর্মকর্তা।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫