Logo
×

Follow Us

প্রচ্ছদ প্রতিবেদন

দেশে ইলিশের উৎপাদন কমছে

Icon

বখতিয়ার আবিদ চৌধুরী

প্রকাশ: ২৫ অক্টোবর ২০২৫, ১০:৫৩

দেশে ইলিশের উৎপাদন কমছে

“সিন্ধু উজিয়ে যে মাছ ধরা পড়ে, তার নাম ‘পাল্লা’-অতি উপাদেয় মৎস্য। নর্দমা উজিয়ে ভরোচ শহরে যে মাছ ধরা পড়ে তার নাম ‘মাদার’-সেও উপাদেয় মৎস্য। আর গঙ্গা-পদ্মা উজিয়ে যে মাছ বাঙালিকে আকুল উতলা করে তোলে, তার নাম ইলিশ...।” বাংলা সাহিত্যের প্রথিতযশা লেখক সৈয়দ মুজতবা আলী তার ‘আড্ডা’ রচনায় এভাবেই রসিয়ে রসিয়ে ইলিশের সঙ্গে পরিচয় করিয়েছেন পাঠকদের।

ইলিশের সোনালি দিন ফুরিয়েছে অনেক আগেই। তার পরও মৌসুমে যতটুকু ইলিশ জালে ধরা দেয়, তার দামও আকাশচুম্বী। 

এখন গরিবের পাত দূর অস্ত-মধ্যবিত্তের পাতেও ইলিশ ওঠে কালেভদ্রে। কেন বাড়ছে ইলিশের দাম? আসল ব্যাপারটি হচ্ছে ইলিশের উৎপাদন কমেছে। বিশেষ করে নদীতে ইলিশ উৎপাদন আশঙ্কাজনকভাবে কমেছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে সমুদ্রের ইলিশের ওপরই নির্ভর করতে হয়। কিন্তু সেখানেও জেলেদের কণ্ঠে হতাশার সুর। উপকূলের জেলেরা বলছেন, ‘আগে বঙ্গোপসাগরের মোহনায় বড় ইলিশ পাওয়া যেত, এখন আর পাওয়া যায় না। বড় ইলিশের জন্য এখন যেতে হয় গভীর সমুদ্রে।’ 

মৎস্য অধিদপ্তরের তথ্য মতে, ২০১৮-১৯ সালে সারা দেশে ৫.৩২ লাখ টন ইলিশ আহরণ করা হয়েছিল। ২০১৯-২০২০ সালে আহরণের পরিমাণ কিছুটা বেড়ে ৫.৫০ লাখ টনে দাঁড়ায়। তারপর ২০২০-২১ সালে  ৫.৬৫ লাখ টন, ২০২১-২২ সালে ৫.৬৬ লাখ টন, ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৫.৭১ লাখ টন পর্যন্ত আহরণ করা হয়েছিল। কিন্তু এর পরই ইলিশ আহরণের পরিমাণ থাকে। ২০২৩-২৪ সালে ইলিশের উৎপাদন কমে দাঁড়ায় ৫.২৯ লাখ টন। গত অর্থবছরের তুলনায় প্রবৃদ্ধির হারও কমেছে। বর্তমান প্রবৃদ্ধির হার ৭.৩ শতাংশ।

ইলিশের উৎপাদন কমে যাওয়ার নেপথ্যে একাধিক প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট কারণ রয়েছে। প্রাকৃতিক কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম ও প্রধান সমস্যা ‘জলবায়ু পরিবর্তন’। বঙ্গোপসাগরের পানির তাপমাত্রা ক্রমেই বাড়ছে। বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর এবং নরওয়েজিয়ান মেটিওরোলজিক্যাল ইনস্টিটিউটের একটি যৌথ গবেষণায় দেখা গেছে, দেশের প্রায় সর্বত্র বৃষ্টির পরিমাণ কমে গেছে। আর সেই সঙ্গে বেড়েছে তাপমাত্রা।

গবেষণা অনুযায়ী, ১৯০১ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে বাংলাদেশের বার্ষিক গড় তাপমাত্রা প্রায় ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০৫০ সালের মধ্যে এ অঞ্চলের গড় সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রা বর্তমানের তুলনায় প্রায় ১.২ থেকে ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি হতে পারে।

সাধারণত ইলিশের প্রজনন ও বর্ধনের জন্য ২৬ থেকে ২৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা ভালো। এর বেশি হলেই ডিম ফোটার হার কমে যায়। জাটকার মৃত্যুও বেড়ে যায়। এ ছাড়াও উজানের নদীগুলোর প্রবাহ কমে যাওয়া-বিশেষত, শুকনো মৌসুমে ইলিশের স্বাভাবিক চলাচল বাধাগ্রস্ত করছে। মেঘনার মোহনায় ডুবোচরের সংখ্যা বাড়ায় ইলিশের চলাচলের প্রধান পথগুলো সংকুচিত হচ্ছে। নদী ও উপকূলীয় অঞ্চলে শিল্পবর্জ্য ও প্লাস্টিকের দূষণে ইলিশের আবাসস্থল ও খাদ্যশৃঙ্খল মারাত্মকভাবে হুমকির মুখে পড়েছে। 

সম্প্রতি মৎস্য অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে মেঘনা, তেঁতুলিয়া ও পদ্মা নদীতে মোট ১৭টি স্থান চিহ্নিত করা হয়েছে, যেগুলোতে মা ইলিশ ও জাটকার যাতায়াত বাধাগ্রস্ত হয়। এর মধ্যে মেঘনা নদীতে ১৪টি, পদ্মা নদীতে দুটি এবং তেঁতুলিয়া নদীতে একটি স্থানে যাতায়াত বাধাগ্রস্ত হয়। এই স্থানগুলো ভোলা, বরিশাল, পটুয়াখালী, চাঁদপুর, লক্ষ্মীপুর, নোয়াখালী ও শরীয়তপুর জেলার মধ্যে পড়েছে।

ইলিশের উৎপাদন কমে যাওয়ার পেছনে চোরা শিকারেরও প্রভাব রয়েছে। এ প্রসঙ্গে বরিশাল জেলার কথাই ধরা যাক। জেলার মেঘনা নদীর হাইমচর, মালদ্বীপের চর, চর শেফালী এলাকায় ইলিশ ডিম ছাড়ে এবং এসব এলাকায় জাটকা বেড়ে ওঠে। কিন্তু চোরা শিকারিরা ব্যাপক হারে এসব জাটকা শিকার করে। দেশের প্রতিটি উপকূলেই এমন চোরা শিকারিদের উৎপাত রয়েছে। এই চোরা শিকারিরা ‘কারেন্ট জাল’ও বড় ফাঁদের মতো চর জাল পেতে রাখে। এই জালগুলো এতটাই সূক্ষ্ম যে, জাটকা থেকে শুরু করে যেকোনো ছোট মাছ পর্যন্ত আটকে যায়। এই জালগুলো এমনভাবে পানির নিচে পাতা হয়, যা সহজে দেখা যায় না। শুধু চোরা শিকারিরাই নয়, স্বাভাবিক সময়ে জেলেরাও এই জালগুলো ব্যবহার করতে শুরু করেছেন। 

মাছ ধরার ক্ষেত্রে ঘোস্ট ফিশিং বা ভৌতিক মৎস্য আহরণ বলে একটি কথা প্রচলিত রয়েছে। নদীতে বা সাগরে জেলেদের পাতা জাল অনেক সময় পরিত্যক্ত হয়ে একই স্থানেই পড়ে থাকে। মাছ ধরার নৌকা বা ট্রলার ডুবে গেলে এমনটি হয়ে থাকে। সেই জালগুলোতে প্রচুর মাছ ধরা পড়ে, এর মধ্যে ইলিশও রয়েছে, এসব জালে কত মাছ ধরা পড়ে, স্বাভাবিকভাবেই তার কোনো হিসাব পাওয়া যায় না। মূলত হিসাব না থাকার কারণেই ‘ভৌতিক মৎস্য আহরণ’ কথাটির প্রচলন ঘটেছে। দেশের একটি সংবাদমাধ্যমের বরাতে মৎস্য অধিদপ্তরের পটুয়াখালী জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. কামরুল ইসলাম বলেন, ‘ভৌতিক মৎস্য আহরণের প্রভাব মারাত্মক। এটা এখন আমাদের উপকূলের একটি বড় সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে।’ একই সংবাদমাধ্যমের বরাতে জানা যাচ্ছে, ‘পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারিজ টেকনোলজি বিভাগের অধ্যাপক সাজেদুল হক তিন বছর ধরে এসব জাল সংগ্রহ ও সমুদ্রের দূষণ রোধে একটি প্রকল্পের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তার নেতৃত্বে তিন বছরে ১৩ হাজার কেজি জাল উদ্ধার করা হয়েছে। এসব জাল নদী বা সাগরে পরিত্যক্ত অবস্থায় ছিল।’

সম্প্রতি মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আকতার বলেছেন, ‘ইলিশ আহরণের পরিমাণ ৪৮ শতাংশ কমে গেছে। এর প্রধান কারণ দূষণ বলে তিনি মনে করেন। তাঁর ভাষায়, প্লাস্টিক বর্জ্যসহ নানা ধরনের দূষণ বন্ধ না হলে দেশের প্রাণিজ চাহিদা মেটানো ভবিষ্যতে হুমকির মুখে পড়বে। নদী ও সাগরের পানিতে একদিকে প্লাস্টিকের বর্জ্য ও শিল্পবর্জ্য যেমন মিশছে, তেমনি কীটনাশক মিশেও পানি দূষিত করছে। ফলে পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেন কমে যাচ্ছে। শ্বাস-প্রশ্বাস ব্যাহত হয়ে নানাভাবে মাছের ক্ষতি করছে। পানিদূষণের কারণে মাছের খাবারও কমে যাচ্ছে। সম্প্রতি এক গবেষণায় ইলিশের শরীরে মাইক্রোপ্লাস্টিক থেকে শুরু করে সিসা, ক্যাডমিয়াম, পারদ, আর্সেনিক, ক্রোমিয়াম প্রভৃতি ভারী ধাতুও পাওয়া গেছে। দূষণের কারণেই এমনটি ঘটছে।  তিনি আরো বলেন, ‘২২ দিন যদি আমরা মা ইলিশকে রক্ষা করতে পারি, তবে উৎপাদন বাড়বে।’

ইলিশের উৎপাদন বাড়াতে এবং বিলুপ্তির হাত থেকে বাঁচাতে সচেতনতা ও দায়িত্বশীল আচরণের কোনো বিকল্প নেই। ইলিশের ওপর প্রকৃতির যে বিরূপ প্রভাব পড়ছে, তা আসলে প্রকৃতির প্রতি মানুষের বিরূপ আচরণেরই প্রতিক্রিয়া। প্রকৃতির ওপর সদয় আচরণ করলে ইলিশের সুদিন আবার ফিরে আসতেও পারে। তখন গরিবের পাতেও দুই খানা ইলিশ সুবাস ছড়াবে।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫