ভারতের চাল দুবাই থেকে কেন কিনছে বাংলাদেশ?
 
													আবুল বাসার সাজ্জাদ
প্রকাশ: ২৭ অক্টোবর ২০২৫, ১৭:৩৬
 
					জেটিতে আমদানি করা চালের বস্তা খালাস করা হচ্ছে।
মরুভূমির দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইয়ে চাল উৎপাদন হয় না, নিজেরাই তারা আমদানিনির্ভর। সেই দেশ থেকে বাংলাদেশের চাল কেনা নিয়ে তৈরি হয়েছে বিস্ময়।
খাদ্য অধিদপ্তর দেশকাল নিউজ ডটকমকে নিশ্চিত করেছে যে, এই চাল ভারতীয়, তবে আসবে দুবাই থেকে।
কিন্তু ভারতীয় চাল কেন সে দেশ থেকে না এনে দুইবারের পরিবহন খরচ যোগ করে দুবাই থেকে আনা হবে?- এই প্রশ্নে একজন কর্মকর্তা ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতির কথা তুলে ধরে সেটি আর না বাড়ানোর যুক্তি দিয়েছেন।
গত ২২ অক্টোবর খাদ্য মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাবে সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ মিয়ানমার ও দুবাই থেকে মোট ১ লাখ টন চাল কেনা অনুমোদন দেয়।
অর্থ মন্ত্রণালয় সেদিন সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, মিয়ানমার থেকে ৫০ হাজার টন আতপ চাল আর দুবাই থেকে ৫০ হাজার টন নন-বাসমতি সেদ্ধ চাল আসবে। এতে মোট ব্যয় হবে ৪৪৬ কোটি ২৩ লাখ ৮ হাজার ৫৭০ টাকা।
অর্থ মন্ত্রণালয় বলেছে, ২০২৫-২৬ অর্থবছরে আন্তর্জাতিক উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে প্যাকেজ-২’র আওতায় ৫০ হাজার টন নন-বাসমতি সেদ্ধ চাল আমদানির অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। প্রতি টন ৩৫৫ দশমিক ৯৯ ডলার হিসাবে দুবাইয়ের মেসার্স ক্রিডেন্টওয়ান এফজেডসিও থেকে এই চাল কেনা হবে। এতে ব্যয় হবে ২১৬ কোটি ৯০ লাখ ৪৭ হাজার ৭০ টাকা।
আর মিয়ানমার থেকে ‘জি টু জি’ ভিত্তিতে ৫০ হাজার টন আতপ চাল আমদানির অনুমোদন দেওয়া হয়। প্রতি টন ৩৭৬ দশমিক ৫০ ডলার হিসাবে এতে ব্যয় হবে ২২৯ কোটি ৩২ লাখ ৬১ হাজার ৫০০ টাকা।
দুবাই কিন্তু তার চালের চাহিদার পুরোটাই আমদানি করে থাকে। এর মধ্যে সিংহভাগ যায় ভারত থেকে। তবে দুবাইয়ের জেবেল আলি বন্দর চালের বড় পুনঃরপ্তানি হাব, যা আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে পুনরায় রপ্তানি করে।
ক্রেডেন্টওয়ান এফজেসিওর মতো কোম্পানিগুলো ভারতীয় বাসমতি এবং নন-বাসমতি চালের বড় আমদানিকারক। ফলে, এই আমদানি যদিও ‘দুবাই থেকে’ বলা হচ্ছে, তা পরোক্ষভাবে ভারত থেকেই আনা হচ্ছে হাত ঘুরে।
খাদ্য অধিদপ্তরের সংগ্রহ বিভাগের পরিচালক মো. মনিরুজ্জামান সাম্প্রতিক দেশকালকে বলেন, “চাল সরবরাহকারীর অফিস দুবাই। এখন দুবাই থেকে চাল আমদানি যদি মিডিয়ায় আসে আমরা কী বলব? আসলে চালের সোর্স হলো ইন্ডিয়া।”
ভারতের চাল ভারত থেকে কেন আনা হচ্ছে না- এই প্রশ্নে তিনি বলেন, “আমাদের এখানে ওপেন টেন্ডার হয়, সারা পৃথিবীর সরবরাহকারীরা এতে অংশ নিতে পারে। তার অফিস কোথায় এটা তো কোনো বিষয় না। সে কোন দেশ থেকে দেবে, কাকে দেবে এটা হলো গুরুত্বপূর্ণ।
দুবাই থেকে আনায় চালের দাম বেশি পড়বে কি না, এই প্রশ্নে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সরেজমিন উইংয়ের অতিরিক্ত পরিচালক (মনিটরিং ও বাস্তবায়ন) মো. জামাল উদ্দীন বলেন, “এখানে ট্রান্সপোর্টেশন না, প্রাইস না, দুই দেশের যে অসম বাণিজ্য ঘাটতি, সেই বিষয়গুলো এখানে জড়িত। হয়ত ভারত থেকে বাংলাদেশ আমদানি আর বাড়াতে চাচ্ছে না।”
দুবাইয়ে জনশক্তি রপ্তানি করায় সেখানকার মুদ্রা আসছে জানিয়ে এই কর্মকর্তা এই যুক্তিও দেন যে, “সেজন্য সেখান থেকে আনাটা আমাদের জন্য সহজ। আমরা ওখান থেকে করা আয় থেকে দায় শোধ করছি।”
আমদানি কেন লাগছে
আউশ ধান উঠেছে, এখন আমন উঠার আগে আগে কেন চাল আমদানি কেন করতে হচ্ছে?- এমন প্রশ্নে মনিরুজ্জামান বলেন, “আমাদের যথেষ্ট চাল আছে, তারপরও বাইরে থেকে আনতে হয় কারণ হলো যে সামনে আমনে যদি কোনো ঝুঁকি হয়। গত বছর বন্যা হলো তারপর আমাদের বেশ কিছু চাল বিতরণ করতে হয়েছে।”
গত বছর ৯ লাখ টন আমদানি করা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, “সেই অনুপাতে তো এবার এক লাখ টন, খুবই কম খুবই কম।”
“প্রতি বছরই আমদানি হচ্ছে। সরকারের কথা হলো যে, কোনো ঝুঁকি নেওয়া যাবে না। অসুবিধা তো নাই কিছু চাল যদি আসে থাকল”, বলেন তিনি।
ভারতের চাল দুবাই থেকে আনার বিষয়ে খাদ্য অধিদপ্তরের হাত নেই জানিয়ে মনিরুজ্জামান আরও বলেন, “সরকার কেনো চাল কিনছে এটা সরকার বা রাষ্ট্রের পলিসি। আমরা শুধু সরকারের পলিসিটা বাস্তবায়ন করি। এটা কেবিনেটের সভায় আলোচনা হয়, সেখানে সিদ্ধান্তগুলো হয়।”
দেশে ১০ থেকে ১২ লাখ টন চাল মজুদ থাকাটা স্বাভাবিক অবস্থা, তবে বর্তমানে প্রায় ১৫ লাখ টন চাল মজুদ রয়েছে এই কর্মকর্তা।
দেশে উৎপাদন চাহিদার চেয়ে বেশি, দাবি উপদেষ্টার
চলতি বছরের ২০ আগস্ট দিনাজপুর সার্কিট হাউজে খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি নিয়ে এক মতবিনিময় সভায় খাদ্য মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আলী ইমাম মজুমদার বলেন, দেশে চাহিদার চেয়ে এক কোটি মেট্রিক টন খাদ্য বেশি উৎপাদন হয়েছে। তারপরও বাজার স্থিতিশীল রাখার জন্য চাল আমদানি করা হচ্ছে।
গত ২৮ মে ময়মনসিংহ বিভাগীয় কমিশনার কার্যালয়ে বোরো সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন, মজুত ও বিতরণ বিষয়ে আয়োজিত বৈঠক শেষে উপদেষ্টা বলেন, “বর্তমানে দেশের খাদ্য পরিস্থিতি অত্যন্ত সন্তোষজনক। খাদ্যের মজুত আছে ১৫ লাখ টনের মতো, যেটা গত বছরের এই দিনের চেয়ে ৩ লাখ টন বেশি।
“এবার বোরো ধান ভালো হয়েছে। ভাগ্য সুপ্রসন্ন থাকলে, আমনও যদি ভালো হয়, তাহলে আশা করা যায়, চাল আমদানি করতে হবে না।”
আর চলতি বছরের শুরুতে ২১ জানোয়ারি চট্টগ্রাম বন্দরের জিসিবি জেটিতে আমদানি করা খাদ্যদ্রব্য খালাস কার্যক্রম পরিদর্শন শেষে তিনি অবশ্য বলেন, চলতি বছর সরকারি পর্যায়ে নয় লাখ টন চাল আমদানি হবে বলে।
সেদিন তিনি ভারত ও মিয়ানমার থেকে আমদানি আর পাকিস্তানের সঙ্গে চুক্তি প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ে থাকার কথা জানান। বলেন, ভিয়েতনামের সঙ্গেও আলোচনা চলছে।
“অন্য কোনো সোর্স পাওয়া যায় কি না তার চেষ্টা চলছে। বাণিজ্যকে আমরা রাজনীতির সাথে মিলাচ্ছি না। ভারত যেহেতু আমাদের নিকটতম প্রতিবেশী এবং আমদানি খরচ তুলনামূলকভাবে কম, তুলনামূলক সস্তা দামে পাওয়া যায়। সে কারণে ওখান থেকে চাল আসাটা অব্যাহত আছে।
অর্থনীতিবিদদের মতামত
অর্থনীতিবিদদের মতে, এতে প্রতি টন চালে অতিরিক্ত অর্থ গুনছে সরকার, যা জনগণের অর্থের অপচয়। খাদ্য নিরাপত্তার যুক্তি দেখিয়ে চাল আমদানির উদ্যোগ নিলেও, বাংলাদেশের খাদ্য ক্রয় প্রক্রিয়া আবারও তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েছে। কারণ দুবাই চাল উৎপাদনকারী দেশ নয়; বরং তারা নিজেরাই ভারত থেকে আমদানি করে তা পুনঃরপ্তানি করে। প্রতিবেশী দেশ ভারত থেকে সরাসরি সরকারি বা বেসরকারি পর্যায়ে চাল আমদানি করার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও দুবাইয়ের মধ্যস্থতাকারী প্রতিষ্ঠানের শরণাপন্ন হওয়ার ঘটনাটি বেশ বিস্ময়কর।
জাহাঙ্গীরগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ সফিকুল ইসলাম বলেন, “যারা এসব সিদ্ধান্ত নেন, তারা তো ভেবেচিন্তে নেয় না। আর এখানে যারা যুক্ত আছে তাদের ইন্টারেস্ট আছে। সোর্স থেকে যদি কেনা যায়, সেখানে অবশ্যই মূল্য কম পড়ে। এখনের পলিসি মেকাররা এভাবে না করে তারা ভিন্ন রকম করছে এটা তাদের ব্যাখ্যায় জানা যাবে। তবে ইনডিরেক্টলি ভায়া হয়ে নিয়ে আসার কোনো প্রয়োজন ছিল না।”
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা জানান, আন্তর্জাতিক টেন্ডারের মাধ্যমে এই ক্রয় প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে। ক্রিডেন্টওয়ান সম্ভবত সর্বনিম্ন দরদাতা হিসেবে কাজ পেয়েছে।
বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা করছেন সাধারণ মানুষও। মোহাম্মদপুরের বাসিন্দা শাহরিয়ার খান বলেন, ভারতীয় চাল দুবাই ঘুরে বাংলাদেশে পৌঁছানোর প্রক্রিয়াটির পেছনের কারণ কী এবং কার লাভ হচ্ছে—সেই জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা সরকারের জন্য এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। নাকি নির্দিষ্ট মহলের কেউ দুর্নীতি করছে সেটাও স্পষ্ট করা উচিত।

