সার কারখানায় বাড়ছে গ্যাসের দাম, চলতি সপ্তাহেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত
 
													জান্নাতুল ফেরদৌসী
প্রকাশ: ২৮ অক্টোবর ২০২৫, ১৭:০৯
 
					গ্যাস প্রক্রিয়াকরণ স্থাপনায় কাজ করছেন প্রকৌশলীরা।
দেশের কৃষি উৎপাদন খাতে বড় ধরনের পরিবর্তন আসছে। বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) সার কারখানার জন্য গ্যাসের দাম উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে। চলতি সপ্তাহের শেষ দিকেই এ বিষয়ে চূড়ান্ত ঘোষণা আসতে পারে।
এ সিদ্ধান্ত কার্যকর হলে গ্যাস সংকটে থাকা দেশীয় সার উৎপাদন খাত নতুন চাপে পড়বে, যা কৃষি উৎপাদন খরচে বড় ধরনের প্রভাব ফেলবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতে যখন সরকার সার আমদানির ওপর নির্ভর করছে, ঠিক তখনই গ্যাসের দাম বাড়ানোর এই পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। মাত্র এক মাস আগেই সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি প্রায় ২ হাজার ৮০০ কোটি টাকার সার আমদানির অনুমোদন দিয়েছে। আসন্ন বোরো মৌসুমকে সামনে রেখে সৌদি আরব, মরক্কো, চীন ও রাশিয়া থেকে প্রায় ১ লাখ ৪৫ হাজার টন ইউরিয়া ও কাঁচামাল আমদানি করা হচ্ছে, যা মূলত রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন কারখানাগুলোতে বিতরণ করা হবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিইআরসি চেয়ারম্যান জালাল আহমেদ দেশকাল নিউজ ডটকমকে বলেন, “গ্যাসের দাম বৃদ্ধির বিষয়ে সব টেকনিক্যাল কমিটির সুপারিশ এসে গেছে। যেকোনো সময়ই এ সংক্রান্ত আদেশ জারি হতে পারে।”
তিনি মনে করেন, দাম বাড়লেও তা কৃষি খাতে বড় কোনো ক্ষতি করবে না।
“আমার মনে হয়, দাম কিছুটা বাড়লেও তা কৃষি ও খাদ্য নিরাপত্তার ক্ষতি করবে না।”
সার আমদানির বিষয়টি স্বীকার করে তিনি বলেন, “হ্যাঁ, সরকার সার আমদানির সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে গ্যাসের দাম সামান্য বাড়লে প্রভাবও সামান্যই পড়বে।”
তবে তিনি যোগ করেন, “এখনো নিশ্চিতভাবে বলা যাচ্ছে না দাম বাড়বে কি না। এটা সত্য যে, আমদানিকৃত পণ্য সবসময় দেশীয় উৎপাদনের তুলনায় বেশি দামি।”
তবে জ্বালানি অর্থনীতিবিদ ও ভোক্তা অধিকারকর্মীরা এ প্রস্তাবের বিরোধিতা করছেন। কনজিউমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা শামসুল আলম বলেন, “সার কারখানাগুলোর উৎপাদন সক্ষমতা গ্যাস সংকটের কারণে ক্রমেই কমছে। এমন পরিস্থিতিতে গ্যাসের দাম বাড়ানো অযৌক্তিক।”
তিনি এর পরিণতি সম্পর্কে সতর্ক করে বলেন, “এতে পুরো খাদ্য সরবরাহ শৃঙ্খল ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। অনেক কারখানা ইতিমধ্যে গ্যাসের অভাবে পূর্ণ ক্ষমতায় উৎপাদন করতে পারছে না।”
তিনি প্রশ্ন তোলেন, “এই অবস্থায় সরকার কীভাবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এই কারখানাগুলোর জন্য গ্যাসের দাম বাড়াতে পারে?”
পেট্রোবাংলা ও গ্যাস বিতরণ কোম্পানিগুলো যৌথভাবে প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের দাম ১৬ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৪০ টাকা করার প্রস্তাব দিয়েছে, যা প্রায় ১৫০ শতাংশ বেশি। গত ৬ অক্টোবর অনুষ্ঠিত এক জনশুনানিতে বিভিন্ন পক্ষ নিজেদের অবস্থান তুলে ধরে। তবে কর্মকর্তারা জানান, তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানির ক্রমবর্ধমান ব্যয়ের কারণে গ্যাসের দাম অপরিবর্তিত রাখা সম্ভব নয়।
জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “এলএনজি খুব ব্যয়বহুল পণ্য। উৎপাদনশীল কারখানাগুলোকে গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত করতে হলে আমাদের স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি কিনতে হবে।”
তিনি আরও বলেন, “আমাদের নিজস্ব গ্যাস নেই এবং বড় রপ্তানিকারকদের সঙ্গে কোনো দীর্ঘমেয়াদি আমদানি চুক্তিও নেই। তাই বাধ্য হয়ে স্পট মার্কেট থেকেই উচ্চমূল্যে গ্যাস কিনতে হচ্ছে। এর ফলে গৃহস্থালি, শিল্প, এমনকি সার কারখানাগুলোকেও চাহিদা অনুযায়ী গ্যাস সরবরাহ করা সম্ভব হচ্ছে না।”
নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত করা গেলে বাংলাদেশে বছরে ২০ লাখ টনের বেশি ইউরিয়া সার উৎপাদনের সক্ষমতা রয়েছে। পেট্রোবাংলার কর্মকর্তারা বলছেন, গ্যাসের দাম ঘনমিটার প্রতি ৩০ টাকা বা তার বেশি হলেও দেশে উৎপাদিত সার আন্তর্জাতিক বাজার থেকে আমদানি করা সারের চেয়ে সস্তা হবে।
এতে সরকারের ওপর আর্থিক চাপও বাড়ছে। বর্তমানে প্রতি কেজি ইউরিয়া সার উৎপাদনে খরচ হয় প্রায় ৩৮ টাকা। কিন্তু কৃষকদের কাছে তা ২৭ টাকায় বিক্রি করা হয় এবং নিবন্ধিত ডিলাররা কেনেন ২৫ টাকায়। ফলে প্রতি কেজিতে সরকারকে ১৩ টাকা ভর্তুকি দিতে হচ্ছে। গ্যাসের দাম বাড়লে এই ভর্তুকির পরিমাণ আরও বাড়বে, যদি না খুচরা পর্যায়ে সারের দাম বাড়ানো হয়। আর তা করা হলে কৃষকদের ওপর নতুন করে চাপ তৈরি হবে।
পেট্রোবাংলার তথ্য অনুযায়ী, গত ২৬ অক্টোবর সার কারখানাগুলোতে গ্যাস সরবরাহ ছিল ১৪৪ দশমিক ১৩ মিলিয়ন ঘনফুট, যেখানে চাহিদা ছিল ২১৩ মিলিয়ন ঘনফুট। ওই দিন সারাদেশে মোট গ্যাস সরবরাহ ছিল ২ হাজার ৭৭৪ দশমিক ১ মিলিয়ন ঘনফুট, যার বিপরীতে চাহিদা ছিল ৪ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট।

