Logo
×

Follow Us

প্রচ্ছদ প্রতিবেদন

খরায় ভুগছে হাওর উন্নয়ন অধিদপ্তর, ঘাটতি সর্বত্র

Icon

আবুল বাসার সাজ্জাদ

প্রকাশ: ০৩ নভেম্বর ২০২৫, ১৪:০৬

খরায় ভুগছে হাওর উন্নয়ন অধিদপ্তর, ঘাটতি সর্বত্র

হাওর ও জলাভূমি উন্নয়ন অধিদপ্তর।

হাওর এলাকার উন্নয়নে ৯ বছর আগে সরকারের নেওয়া একটি পদক্ষেপ কোনো সুফলই বয়ে আনতে পারছে না, যদিও এটি ঠিকঠাক কাজ করলে কোটি মানুষের জীবনে প্রভাব পড়তে পারত।

হাওর অঞ্চলের টেকসই উন্নয়ন ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে ২০১৬ সালে গঠন করা হয় হাওর উন্নয়ন অধিদপ্তর। তবে এই অধিদপ্তরের যা করার কথা ছিল, তার কিছুই করা হয়নি।

প্রায় এক দশকে নিজস্ব ভবন, পর্যাপ্ত লোকবল, কিছুই হয়নি। ফলে সরকারের অর্থের অপচয় ছাড়া হাওর উন্নয়ন বোর্ড থেকে অধিদপ্তরে রূপান্তরের কোনো সুফল হাওরবাসী পায়নি।

হাওর বাঁচাও আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক বিজন সেন রায় সাম্প্রতিক দেশকালকে বলেন, “সরকার যে পরিকল্পনা নিয়েছে সেটা খুবই ভালো, তবে মাঠ পর্যায়ে এর বাস্তবায়ন নাই। হাওরের কৃষি জমি, জলবায়ু, মৎস্যসহ হাওরের কোনো কিছু নিয়ে কখনও কোনো কাজই করেনি তারা।”

অন্য একটি প্রতিষ্ঠানের জমিতে একটি পুরাতন টিনশেড ভবনে কার্যক্রম চালাচ্ছে অধিদপ্তরটি। এছাড়াও নেই কোনো অধ্যাদেশ বা আইন, চূড়ান্ত হয়নি সাংগঠনিক কাঠামো। প্রয়োজনীয় সংখ্যক কর্মকর্তা-কর্মচারী না থাকায় অনেক প্রকল্প শুরুই করা সম্ভব হচ্ছে না। যেগুলো শুরু হয়েছে সেসবও বাস্তবায়নে ধীরগতি দেখা দেওয়ায় হাওর উন্নয়ন কার্যক্রম যেন এখন খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে।

অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে সাম্প্রতিক দেশকালকে বলেন, “কাজের পরিবেশও নেই। নানা রকমের ঘাটতির কারণে কাজের পরিধি বাড়ানো যাচ্ছে না।”

অন্যদিকে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের এক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা বলেন, “অধিদপ্তরকে কার্যকর করার প্রক্রিয়া চলছে। জনবল ও বাজেট অনুমোদনের পর মাঠ পর্যায়ে এর কাজ আরও গতিশীল হবে।”

সর্বশেষ মহাপরিচালক হিসেবে নিয়োগ পেয়েছিলেন মো. আক্তারুজ্জামান। চলতি বছরের ৮ মে তিনি অবসরে যান। এরপর পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব মো. হাবিবুর রহমানকে অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের দায়িত্ব পালনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তিনি মন্ত্রণালয়ের চাপে অধিদপ্তরে নিয়মিত আসতেও পারছেন না।

হাবিবুর রহমান সাম্প্রতিক দেশকালকে বলেন, “এখানে সবকিছুই (ঘাটতি) পাইপলাইনে আছে। বছরখানেক গেলে এগুলোর সুফল দেখা যাবে।”

একটা আইন তৈরির কাজ চলছে জানিয়ে তিনি বলেন, “একসময় তো বোর্ডে লোকই ছিল না। এখন নতুন নিয়োগ চলছে। একটু সময় লাগে। আজ বললেই তো কাল লোকজন দিতে পারে না।”

পরিবেশবিদদের মতে, অধিদপ্তর গঠনের পরও হাওর অঞ্চলে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা ও গবেষণাভিত্তিক পরিকল্পনা গড়ে উঠেনি। নদী-নালা ভরাট, অব্যবস্থাপনা ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে প্রতিবছরই হাওরের প্রকৃতি বদলে যাচ্ছে। অথচ এর মোকাবেলায় টেকসই নীতি এখনও প্রণয়ন হয়নি।

মাঠ পর্যায়ে সমন্বিত উদ্যোগের অভাবে কৃষি, মৎস্য, পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষার প্রকল্পগুলো আলাদা আলাদা পথে এগোচ্ছে। ফলে প্রকৃত উন্নয়ন হচ্ছে না, বরং অনেক জায়গায় প্রকল্পের পুনরাবৃত্তি ঘটছে।

হাওরের গুরুত্ব বিবেচনায় সর্বপ্রথম ‘হাওর উন্নয়ন বোর্ড’ গঠনের ঘোষণা দেওয়া হলেও গঠিত হয় ১৯৭৭ সালে। এরপর দেশের জলাভূমিকে সংযুক্ত করে ২০১৬ সালে বাংলাদেশ হাওর ও জলাভূমি উন্নয়ন অধিদপ্তর গঠন করা হয়।

উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ৭টি জেলাসহ সারা দেশের জলাভূমি, নদ-নদী, খাল-বিল এই অধিদপ্তরের অধীনে। এমনকি সমুদ্রের যে এলাকা ৬ মিটার গভীর সেটাও এর আওতাভুক্ত। এই বৃহৎ পরিধি থাকার পরেও উল্লেখযোগ্য কাজ করতে পারছে না অধিদপ্তর।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানান, বর্তমানে ১০ কোটিরও বেশি বাজেটে চলনবিলের একটি সমীক্ষা প্রকল্প চলমান আছে। এর আগে আরিয়াল বিলের সমীক্ষা প্রকল্প শেষ হয়েছে।

তবে মাঠ পর্যায়ে কোনো প্রকল্প হাতে নিতে পারছে না তারা। পুরো অধিদপ্তরে কর্মকর্তা মাত্র ৭ জন। তবে টেকনিশিয়ান একজনও নেই। আর আঞ্চলিক অফিসগুলোতে কোনো কার্যক্রমও শুরু হয়নি। সুনামগঞ্জে কোনোরকম অফিস করে যোগাযোগ ও তথ্যসেবামূলক কাজ চলছে। বাস্তবায়নমুখী কোনো কাজ এখনও হচ্ছে না।

বাজেট ঘাটতির জন্য ১০ বছরেও এই অধিদপ্তর মাঠ পর্যায়ে কোনো প্রকল্প হাতে নিতে পারেনি বলে স্বীকার করেছেন হাওর উন্নয়ন বোর্ড থেকে অধিদপ্তরে রূপান্তিত হওয়ার সময়কালীন মহাপরিচালক আফরোজা মোয়াজ্জেম।

তিনি বলেন, “এটার প্রচুর সম্ভাবনা আছে। অনেক মাছ হবে, ধান হবে। দেখি আর্থিক অনুমোদনটা আসে কিনা। অনুমোদন এলে কাজ করা যাবে।”

পানি ভবনে এই অধিদপ্তরকে জায়গা দেওয়ার আলোচনা আছে জানিয়ে তিনি বলেন, “আমি চেষ্টা করেছি অধিদপ্তরটাকে প্রাণবন্ত করার জন্য।”

নেই নিজস্ব ভবন

অধিদপ্তরটি যেখানে কার্যক্রম চালাচ্ছে, সেটা একটি টিনশেড ভবন। জরাজীর্ণ এই ভবনটিও তাদের নিজস্ব জায়গায় নয়। জমিটি কোন দপ্তরের, সেটিও নিশ্চিত করে বলতে পারেন না কোনো কর্মকর্তা, এমনকি মহাপরিচালক।

টিনশেড ভবনটির অবস্থাও যাচ্ছেতাই। বৃষ্টি হলে টিন ছেদ করে ভেতরে পানি পড়ে, দেয়ালে ধরেছে ফাটল, পলেস্তারা উঠে যাচ্ছে কোথাও কোথাও।

মহাপরিচালক (অতিরিক্ত দায়িত্ব) মো. হাবিবুর রহমান বলেন, “যারা অফিস করছে তাদের জন্য বিষয়টা চ্যালেঞ্জিং। অফিস ভবন করতেও আমরা উদ্যোগ নিয়েছি, এটাও তো প্রজেক্টের বিষয়, এটা পাস করানোর বিষয় আছে।”

এক বছরের মধ্যে নতুন এই ভবন হয়ে যাবে বলে বিশ্বাস করেন তিনি, যদিও এখনও বাজেটই পাস হয়নি।

হাওর উন্নয়ন বোর্ডে ১৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে কর্মরত একজন কর্মচারী জানান, অধিদপ্তরে যে সাতজন কর্মকর্তা আছেন, তারা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে আসা। বছর বছর বদলি হয়ে যান। পরে একই পদে অন্য কেউ আসেন।

তিনি বলেন, “এখানে বোর্ড আমলে যে ২৯ জন কর্মচারীকে নিয়োগ করা হয়েছিল, তাদের এখনও আত্মীকরণ (অধিদপ্তরে স্থায়ীকরণ) করা হয়নি। অথচ এরাই কিন্তু অধিদপ্তরের প্রাণ। নিয়মিত বেতন হয় না কারও কারও।”

মহাপরিচালক (অতিরিক্ত দায়িত্ব) মো. হাবিবুর রহমান বলেন, “সরকার যখন একটা অধিদপ্তর বানায়, তখন যারা বিশেষজ্ঞ থাকে তাদের মতামতসহ সব অংশীজনদের মতামত নিয়েই করে। এখন আমরা ভালোভাবে কাজ শুরু করলেই হয়ত আপনারা দেখতে পাবেন।”

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) যুগ্ম সম্পাদক এবং বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) চেয়ারম্যান আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, আগে বোর্ডের কার্যক্রম সীমাবদ্ধ ছিল কিছু প্রকল্প, কিছু অবকাঠামো নির্মাণে। অধিদপ্তরে উন্নীত হওয়ায় অনেক কিছু করার সুযোগ এসেছে, এটি পরিবেশ সংরক্ষণ, জীববৈচিত্র্য রক্ষা এবং উন্নয়নের ক্ষেত্রেও ভূমিকা রাখতে পারবে।”

এভাবে কোনো অধিদপ্তর চলতে পারে না বলে মন্তব্য করেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক মুহম্মদ সৈয়দুর রহমান।

হাওর এলাকায় এক কোটিরও বেশি মানুষের বসবাস উল্লেখ করে তিনি বলেন, “অনেক ভালো ভালো কাজের সুযোগ এখানে আছে। তবে এখানে প্রশাসনিক ব্যাপক ঘাটতি আছে।”

উপদেষ্টা নিজেই হতাশ

সম্প্রতি পানি ভবন পরিদর্শনে গিয়ে হাওর অধিদপ্তরের চিত্র দেখে হতাশ হয়েছেন বন, পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন এবং পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। তিনি বলেন, “হাওর অধিদপ্তর সবচেয়ে বেশি অবহেলিত। অথচ এই হাওরে যদি আপনার খাদ্য ব্যবস্থা কোনো কারণে ফল করে ১৭ শতাংশ সরবরাহ কমে যাবে।

কীভাবে হাওরে খাদ্য ব্যবস্থার সুরক্ষা, প্রতিবেশকে ঠিক রেখে খাদ্য উৎপাদন করা যায়, হাওরের মানুষদের উন্নয়নের দাবিটাকে মূলধারায় নিয়ে আসা যায়, তা নিয়ে কাজ করার কথাও জানিয়েছেন তিনি।

হাওর ও জলাভূমি অধিদপ্তর অধ্যাদেশের খসড়া করার কথা জানিয়ে উপদেষ্টা বলেন, উপদেষ্টা পরিষদ এটা অনুমোদন দিলে হাওর অধিদপ্তরের আরও জনবল পাওয়া যাবে।

সরকার একটা হাওর মহাপরিকল্পনা চূড়ান্ত করেছে বলেও জানান রিজওয়ানা হাসান। তিনি বলেন, “একবার যখন হাওরের ফসল ডুবে গেল, তখন আমাদের খাদ্যের দাম বেড়ে গেল। ফলে হাওরবাসীর স্বার্থে আমরা যদি নাও করি, দেশের মানুষের স্বার্থে তো আমাদেরকে করতেই হবে।”

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫