বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া এবং তার বড় ছেলে ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।
জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে গণঅভ্যুত্থনের পক্ষে থাকা রাজনৈতিক দলগুলো প্রার্থী বাছাই ও ঘোষণা করতে শুরু করলেও তাদের প্রধানমন্ত্রী প্রার্থী কে—এই বিষয়টি ঘোষণা করছে না।
৩০০ আসনে প্রার্থী ঘোষণা করা জামায়াত তো বটেই, ২৩৭ আসনে প্রার্থী ঘোষণা করা বিএনপিও এ বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত জানায়নি। আর জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)-র নীতিগত সিদ্ধান্ত হলো, তাদের দলীয় প্রধান সরকারপ্রধান হবেন না।
নির্বাচনের পর সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জয়ী দল তাদের সংসদীয় নেতা হিসেবে যাকে নির্বাচিত করবে, তিনিই হবেন পরবর্তী সরকারপ্রধান। তবে সাধারণত নির্বাচনের আগেই রাজনৈতিক দলগুলো সরাসরি বা পরোক্ষভাবে এ বিষয়টি স্পষ্ট করে। কিন্তু এবারের পরিস্থিতি ভিন্ন।
সংস্কারের যে আলোচনা চলছে, সেখানে প্রধানমন্ত্রী ও দলীয় সভাপতি—দুই পদে একই ব্যক্তির না থাকার প্রস্তাব আছে। ফলে জিতলেও দলের প্রধানই সরকারপ্রধান থাকবেন, এটি নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না।
সংস্কার নিয়ে যে গণভোটের কথা বলাবলি হচ্ছে—যদি তা জাতীয় নির্বাচনের আগে বা নির্বাচনের দিনও হয়—তাহলে এর পক্ষে জনরায় এলে কী হবে, তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। কারণ, সংস্কারের বিষয়টি পরবর্তী সংসদেই অনুমোদন পেতে হবে।
বিএনপিতে প্রশ্ন কেন?
১৯৯১ সালের পঞ্চম সংসদ নির্বাচন থেকে বিএনপির প্রধানমন্ত্রী প্রার্থী নিয়ে কোনো প্রশ্ন কখনও ছিল না। দলীয় চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকেই সরকারপ্রধান হিসেবে সামনে রেখেই ভোট চেয়ে এসেছে দলটি।
তবে এবারের পরিস্থিতি ভিন্ন। বেগম খালেদা জিয়াকে তিনটি আসনে মনোনয়ন দেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তিনি মুক্ত থাকলেও রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন না। তার শারীরিক অবস্থা এখনও পুরোপুরি স্থিতিশীল বলা যাবে না।
২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি খালেদা জিয়া কারাগারে যাওয়ার পর থেকেই বিএনপি তাকিয়ে আছে তার ছেলে তারেক রহমানের দিকে। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের পর খালেদা জিয়া সব মামলা থেকে অব্যাহতি পেলেও দলের দিকনির্দেশনায় এর কোনো পরিবর্তন আসেনি।
বিএনপির চেয়ারপারসন মুক্ত থাকলেও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের পদ রয়ে গেছে। এমনকি বিএনপির কোন নেতা কোন আসনে নির্বাচন করবেন, সম্ভাব্য জোটের নেতাদের জন্য কোন আসন ছাড়া হবে—এই সিদ্ধান্তও তারেক রহমানই চূড়ান্ত করছেন।
২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগ পর্যন্ত বিএনপির প্রধানমন্ত্রী প্রার্থী নিয়ে কোনো ধরনের প্রশ্ন ছিল না। তবে ২০১৮ সালে খালেদা জিয়া আইনি জটিলতায় ভোটে অংশ নিতে না পারার বছরেও এ নিয়ে ধোঁয়াশা ছিল।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি তার ২০ দলীয় জোটের পাশাপাশি ‘জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট’ নামে আরও একটি মোর্চার মাধ্যমে ভোটে আসে। সে বছরও তারা জিতলে কে প্রধানমন্ত্রী হবেন, সেই প্রশ্নের উত্তর দেয়নি।
দেশের সংবাদমাধ্যম তো বটেই—যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকরাও বিএনপির শীর্ষ নেতাদের কাছ থেকে এ প্রশ্নের স্পষ্ট জবাব পাননি।
এবারও বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সাত বছর আগের সুরেই বলছেন, “আমাদের দলীয় চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া যদি সুস্থ থাকেন এবং কাজ করার উপযোগী থাকেন, তাহলে তো তিনিই প্রধানমন্ত্রী হবেন। তার অনুপস্থিতিতে আমাদের চেয়ারম্যান তারেক রহমান হবেন।”
বিএনপির একাধিক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে সাম্প্রতিক দেশকালকে বলেন, “বিএনপি সরকার গঠনের সুযোগ পেলে ক্ষমতার বিন্যাস অনেকটা সৌদি আরবের ‘বাদশাহ–রাজপুত্র’ মডেলে হতে পারে। খালেদা জিয়া থাকবেন প্রধানমন্ত্রীর আসনে, আর তারেক রহমান হবেন নীতিনির্ধারক ও প্রশাসনিক পরামর্শদাতা হিসেবে সরকারের মুখ্য শক্তি।”
দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস সাম্প্রতিক দেশকালকে বলেন, “এখন নানা সংকটে আছি, সেগুলোতেই ফোকাস দিচ্ছি। আর দলের মহাসচিব তো জানিয়েছেন, আমরাও বলেছি বারবার—সবকিছুই ঘটনার ওপর নির্ভর করছে।”
স্থায়ী কমিটির আরও চারজন নেতার কাছ থেকেও জানতে চাওয়া হলে তারাও প্রায় একই কথা বলেন। কারও কাছ থেকে সুস্পষ্ট জবাব মেলেনি।
দলের একজন ভাইস চেয়ারম্যান নাম প্রকাশ না করার শর্তে সাম্প্রতিক দেশকালকে বলেন, “আমি মনে করি, এই সিদ্ধান্ত যেভাবেই হোক, বেগম জিয়ার নামই প্রাধান্য পাবে কিংবা পাওয়া উচিত।”
ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় কমিটির একজন সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে সাম্প্রতিক দেশকালকে বলেন, “আমরা তরুণরা মনে করি, এত বড় অভ্যুত্থানের পর দেশকে আবার শক্তিশালী করতে আমাদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানকেই প্রধানমন্ত্রী করা উচিত। ম্যাডাম উপদেষ্টা হয়ে পরামর্শ দেবেন।”
বিএনপির মতো একইভাবে জামায়াতও বিষয়টি খোলাসা করছে না। তারা ইতোমধ্যে ৩০০ আসনে প্রার্থী ঘোষণা করে ভোটের আগার প্রচারও শুরু করেছে। কিন্তু তারা জিতলে কে সরকার চালাবেন, সেটি স্পষ্ট করেনি।
দলের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল হালিম সাম্প্রতিক দেশকালকে বলেন,“প্রধানমন্ত্রী কে হবেন, এটা এখনো ঠিক করিনি। আমাদের দলের প্রধান শফিকুর রহমানই নেতৃত্ব দিচ্ছেন। আগে তো নির্বাচন, নির্বাচন শেষ হলেই বোঝা যাবে আমরা কাকে প্রধানমন্ত্রী করব।”
এনসিপি কী ভাবছে
ক্ষমতার আলোচনায় আছে জুলাই অভ্যুত্থানের স্পিরিটে তৈরি তরুণদের রাজনৈতিক দল ‘এনসিপি’। তারা একক বা জোটবদ্ধভাবে নির্বাচনে অংশ নিতে পারে।
দলটির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক সামান্তা শারমিন সাম্প্রতিক দেশকালকে বলেন,“আমরা দলীয় প্রধান ও সরকারপ্রধানকে আলাদা রাখার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছি। সরকার গঠন করতে পারলে কে সরকারপ্রধান হবেন—এ মুহূর্তে তা বলা ঠিক হবে না।”
দলটির যুগ্ম আহ্বায়ক সারোয়ার তুষার বলেন,“আমরা ৩০০ আসনে প্রার্থী চূড়ান্ত করছি। সরকার গঠনের সুযোগ পেলে দলের আহ্বায়ককে প্রধানমন্ত্রী করা হবে—এমনটা মনে করি। তবে আমরা গণতান্ত্রিক দল, তাই সিদ্ধান্ত দল যা নেবে, সেটাই চূড়ান্ত হবে।”
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দলের একজন কেন্দ্রীয় নেতা সাম্প্রতিক দেশকালকে বলেন,“দলের আহ্বায়ক আছেন, সদস্যসচিব আছেন, তাছাড়া উপদেষ্টা পরিষদেও কয়েকজন আছেন। সব হিসাব-নিকাশ করে দল যা সিদ্ধান্ত নেবে, তাই হবে। আগে থেকে কিছু বলা যাচ্ছে না।”
স্বাধীনতার পর যারা প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব সামলেছেন
স্বাধীনতার পর কখনও রাষ্ট্রপতি শাসিত, কখনও মন্ত্রিপরিষদ শাসিত সরকার ছিল। রাষ্ট্রপতি শাসিত ব্যবস্থায় প্রথম প্রধানমন্ত্রী ছিলেন আওয়ামী লীগের তাজউদ্দীন আহমদ। মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রবাসী সরকারে ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল থেকে ১৯৭২ সালের ১২ জানুয়ারি পর্যন্ত তিনি দায়িত্বে ছিলেন।
শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানে বন্দিত্ব শেষে দেশে ফিরে ১৯৭২ সালের ১২ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেন। পদে থাকেন ১৯৭৫ সালের ২৪ জানুয়ারি পর্যন্ত।
পরবর্তী প্রধানমন্ত্রীরা হলেন:
মো. মনসুর আলী (২৫ জানুয়ারি ১৯৭৫–১৫ আগস্ট ১৯৭৫) – আওয়ামী লীগ
মশিউর রহমান (২৯ জুন ১৯৭৮–১২ মার্চ ১৯৭৯) – জাগদল/বিএনপি
শাহ আজিজুর রহমান (১৫ এপ্রিল ১৯৭৯–২৪ মার্চ ১৯৮২)
আতাউর রহমান খান (৩০ মার্চ ১৯৮৪–১৫ জানুয়ারি ১৯৮৫) – জাতীয় পার্টি/জনদল
মিজানুর রহমান চৌধুরী (৯ জুলাই ১৯৮৬–২৭ মার্চ ১৯৮৮) – জাতীয় পার্টি
মওদুদ আহমদ (২৭ মার্চ ১৯৮৮–১২ আগস্ট ১৯৮৯) – জাতীয় পার্টি
কাজী জাফর আহমদ (১২ আগস্ট ১৯৮৯–৬ ডিসেম্বর ১৯৯০) – জাতীয় পার্টি
খালেদা জিয়া (১৯৯১–১৯৯৬ স্বল্পমেয়াদে ও ২০০১–২০০৬) – বিএনপি
শেখ হাসিনা (১৯৯৬–২০০১, ২০০৮–২০১৪, ২০১৪–২০২৪) – আওয়ামী লীগ
(১৯৯১ সাল থেকে সংসদীয় সরকার ব্যবস্থায় প্রধানমন্ত্রীই নির্বাহী প্রধান)
