কোন বাস্তবতায় আটকে যাচ্ছে বাংলাদেশের আসিয়ান আকাঙ্ক্ষা?
সিফাত কবীর
প্রকাশ: ০৫ নভেম্বর ২০২৫, ১৭:৩৭
আসিয়ানের পতাকা।
বছরের পর বছর ধরে বাংলাদেশ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর আঞ্চলিক জোট আসিয়ান এর সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করার প্রবল আগ্রহ দেখিয়ে আসছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতি থেকে শুরু করে জাতীয় নেতাদের বক্তৃতায়ও ঢাকা বারবার সংকেত দিয়েছে যে, তারা এই অঞ্চলের সবচেয়ে গতিশীল রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংগঠনগুলোর একটির কাছাকাছি যেতে চায়।
বর্তমানে বাংলাদেশের লক্ষ্য হলো সেক্টরাল ডায়ালগ পার্টনার (এসডিপি) মর্যাদা অর্জন করা। তবে দেশের অনেকেই এখনো আশাবাদী যে একদিন বাংলাদেশ পূর্ণ সদস্যপদও পাবে, যদিও আসিয়ান সনদ অনুযায়ী এই লক্ষ্য আইনত প্রায় অসম্ভব।
২০০৬ সাল থেকে বাংলাদেশ আসিয়ান রিজিওনাল ফোরাম (এআরএফ) এর মাধ্যমে আসিয়ানের সঙ্গে যুক্ত। এই ফোরামে ২৭টি দেশ অংশ নেয়, যেখানে এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা হয়। তবে এখন ঢাকা চায় আসিয়ানের সেক্টরাল ডায়ালগ পার্টনার (এসডিপি) হতে, যা বাণিজ্য, পরিবহন ও টেকসই উন্নয়নে সহযোগিতার নতুন দিগন্ত খুলে দেবে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আঞ্চলিক সংগঠন শাখার সচিব এম ফরহাদুল ইসলাম সাম্প্রতিক দেশকালকে বলেন, “বাংলাদেশ ইতোমধ্যে আসিয়ান রিজিওনাল ফোরামের (এআরএফ) সদস্য।”
তিনি আরও বলেন, “আমরা এখন সক্রিয়ভাবে সেক্টরাল ডায়ালগ পার্টনার হওয়ার দিকে অগ্রসর হচ্ছি।”
বাংলাদেশ কি আসিয়ানের জন্য উপযুক্ত প্রার্থী?
ভৌগোলিকভাবে বাংলাদেশ দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার বাইরে অবস্থিত। তাই ২০০৭ সালে গৃহীত আসিয়ান সনদের অধীনে এটি আসিয়ানের পরিধির বাইরে পড়ে। সেই সনদের ৬ নম্বর অনুচ্ছেদে স্পষ্টভাবে বলা আছে, নতুন কোনো সদস্য রাষ্ট্রকে অবশ্যই “দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার স্বীকৃত ভৌগোলিক অঞ্চলের অন্তর্গত” হতে হবে।
এম ফরহাদুল ইসলাম বলেন, “বাংলাদেশ দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার দেশ নয়, এটাই পূর্ণ সদস্য হওয়ার সবচেয়ে বড় বাধা।”
তিনি বলেন, “আমি আসিয়ান চার্টারের কথা বলছি, যেখানে স্পষ্ট উল্লেখ আছে যে পূর্ণ সদস্য হতে হলে দেশটি অবশ্যই দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার দেশ হতে হবে।”
নীতিনির্ধারকদের দৃষ্টিতে বাংলাদেশের অবস্থান
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খোন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম দেশকাল নিউজ ডটকমকে বলেন, “কোনো আঞ্চলিক অংশীদারিত্ব কেবল বাণিজ্য ও অর্থনীতির ভিত্তিতে গড়ে ওঠে না, এখানে রাজনৈতিক অর্থনীতির দিকও থাকে।”
তিনি বলেন, “সমজাতীয় দেশগুলোর মধ্যে গঠিত আঞ্চলিক সংগঠনগুলোর মূল লক্ষ্য রাজনৈতিক ঐক্য তৈরি করা, যেন তারা একসঙ্গে বহিরাগত প্রভাব ঠেকাতে পারে। যেমন বিমসটেক, ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ও আসিয়ান, এসব সংগঠন কেবল বাণিজ্যের জন্য নয়, রাজনৈতিক কারণেও গঠিত।”
গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, “আসিয়ানের দেশগুলো বাংলাদেশকে কেবল দক্ষিণ এশিয়ার দেশ হিসেবেই দেখে।”
তিনি আরও বলেন, “এটা আমাদের জন্য দুঃখজনক যে আমরা আমাদের অভ্যন্তরীণ দুর্বলতার কারণে কোনো শক্তিশালী আঞ্চলিক ফোরাম বা সংগঠন তৈরি করতে পারিনি। আমার মতে, আগামী দিনগুলোতে বাংলাদেশ আসিয়ানের পূর্ণ সদস্য হওয়ার খুব একটা সম্ভাবনা নেই।”
আসিয়ান দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য পরিস্থিতি
আসিয়ান দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্যে একটি বড় ভারসাম্যহীনতা রয়েছে, যা স্পষ্টভাবে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর পক্ষে।
ঢাকা প্রতিবছর মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম ও সিঙ্গাপুরের মতো দেশ থেকে প্রায় ৭০০ কোটি মার্কিন ডলার মূল্যের পণ্য আমদানি করে, কিন্তু রপ্তানি করে এর চেয়ে অনেক কম, ১০০ কোটি ডলারেরও নিচে। আমদানি পণ্যের মধ্যে রয়েছে পাম তেল, পেট্রোলিয়াম, যন্ত্রপাতি ও ইলেকট্রনিক সামগ্রী, আর রপ্তানি পণ্যের মধ্যে রয়েছে তৈরি পোশাক, পাটজাত পণ্য ও ওষুধ।
বাংলাদেশের ব্যবসায়ী ও নীতিনির্ধারকরা আসিয়ানকে ৬৬ কোটিরও বেশি ভোক্তাবিশিষ্ট বিশাল ও সম্ভাবনাময় বাজার হিসেবে দেখছেন, যার সম্মিলিত জিডিপি ৩ ট্রিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে।
খোন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম জানান, ২০২৩ থেকে ২০২৪ অর্থবছরে আসিয়ান দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য পরিমাণ ছিল ৬.২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
বাংলাদেশ কেন আসিয়ানের কাছাকাছি যেতে চায়
বাংলাদেশের আসিয়ানের প্রতি আগ্রহের পেছনে অর্থনৈতিক ও কৌশলগত, দুই ধরনের কারণই আছে। এশিয়ার দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির একটি দেশ হিসেবে বাংলাদেশ ৬০ কোটিরও বেশি মানুষের এই বৃহৎ বাজারে প্রবেশের সুযোগ দেখতে চায়।
খোন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, “আসিয়ান বাংলাদেশকে দক্ষিণ এশিয়ার দেশ হিসেবেই দেখে। অর্থনীতির বাইরেও এখানে একটি রাজনৈতিক মাত্রা রয়েছে, যেটিকে উপেক্ষা করা যায় না।”
আসিয়ানের সমর্থন পেতে বাংলাদেশের কূটনৈতিক উদ্যোগ
গত কয়েক বছরে আসিয়ানের দৃষ্টি আকর্ষণে বাংলাদেশ কূটনৈতিক প্রচেষ্টা জোরদার করেছে। সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে এসডিপি মর্যাদা পাওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেছে এবং থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার মতো আসিয়ান সদস্য দেশগুলোর সমর্থন চেয়েছে।
খোন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, “দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে আসিয়ান সম্পর্কে ভারতের অবস্থান সবচেয়ে শক্তিশালী। ভারত ইতোমধ্যে আসিয়ানের সঙ্গে নির্বাচিত পণ্যের ওপর প্রেফারেনশিয়াল ট্রেড এগ্রিমেন্ট (পিটিএ) স্বাক্ষর করেছে। কূটনৈতিকভাবে ভারত আসিয়ানের সঙ্গে সম্পর্ক বাড়াচ্ছে।”
তিনি বলেন, “দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার কিছু দেশ ভারতের সঙ্গে কূটনৈতিক দূরত্ব বজায় রাখতে চায়। তাই ভবিষ্যতে কোনো দক্ষিণ এশীয় দেশকে সদস্যপদ দেওয়ার সময় ভারতের প্রভাব থাকতে পারে।”
রোহিঙ্গা ইস্যুর কারণে মিয়ানমার বাংলাদেশবিরোধী অবস্থান নিতে পারে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “হ্যাঁ, সেটাই বিষয়। সবকিছুই রাজনৈতিক ও কৌশলগত বিবেচনার সঙ্গে জড়িত।”
এম ফরহাদুল ইসলাম বলেন, “আমরা এখন আসিয়ানের সেক্টরাল ডায়ালগ পার্টনার হওয়ার দিকে নজর দিচ্ছি এবং প্রতিদিনই আমাদের প্রস্তুতি আরও উন্নত হচ্ছে।”
আসিয়ানে বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থান
বাংলাদেশ ২০০৭ সাল থেকে ট্রিটি অব অ্যামিটি অ্যান্ড কো-অপারেশন ইন সাউথইস্ট এশিয়া (টিএসি) এর অংশীদার। বাংলাদেশ আসিয়ান রিজিওনাল ফোরামের (এআরএফ) একজন অংশগ্রহণকারীও বটে।
২০১৩ সালে বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো আসিয়ানের জন্য নিজস্ব রাষ্ট্রদূত নিয়োগ দেয় এবং পরের বছর ঢাকায় আসিয়ান কমিটি গঠিত হয়, যার লক্ষ্য ছিল আসিয়ান ও বাংলাদেশের মধ্যে সহযোগিতা ও দৃশ্যমানতা বৃদ্ধি করা।
সম্প্রতি, ১২ আগস্ট, প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস ও মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী দাতো সেরি আনোয়ার বিন ইব্রাহিম বৈঠকে বাংলাদেশের আসিয়ান সম্পৃক্ততা গভীর করার আকাঙ্ক্ষা নিয়ে আলোচনা করেন। সেই বৈঠকে মুহাম্মদ ইউনূস আসন্ন আসিয়ান চেয়ারম্যানশিপে মালয়েশিয়ার সমর্থনও চান।
এর আগে ২৭ জুলাই, প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিমের কন্যা ও মালয়েশিয়ার পিপলস জাস্টিস পার্টির ভাইস প্রেসিডেন্ট নুরুল ইজ্জাহ আনোয়ার এর সঙ্গে সাক্ষাতে মুহাম্মদ ইউনূস আবারও বাংলাদেশের আসিয়ান সদস্যপদ অর্জনের বিষয়ে মালয়েশিয়ার সমর্থন চান।
