Logo
×

Follow Us

প্রচ্ছদ প্রতিবেদন

খাদ্যসংকটে কোটিরও বেশি মানুষ

Icon

বখতিয়ার আবিদ চৌধুরী

প্রকাশ: ০৬ নভেম্বর ২০২৫, ১০:৩৭

খাদ্যসংকটে কোটিরও বেশি মানুষ

প্রতীকী ছবি

বাংলাদেশের দুর্যোগপ্রবণ জেলাগুলোতে আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে এক কোটি ৬০ লাখ মানুষ খাদ্যসংকটে পড়তে যাচ্ছে। খাদ্যসংকটের পাশাপাশি চরম অপুষ্টির শিকার হতে যাচ্ছে ১৬ লাখ শিশু। এই বিশালসংখ্যক জনগোষ্ঠীর মধ্যে কক্সবাজারের বিভিন্ন ক্যাম্পে অবস্থান করা রোহিঙ্গারাও রয়েছে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পসহ দেশের ৩৬ জেলার ৯ কোটি ৬৬ লাখেরও অধিক মানুষের খাদ্যনিরাপত্তা ও পুষ্টি অবস্থা বিশ্লেষণ করে এসব তথ্য প্রকাশ করেছে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন-খাদ্য পরিকল্পনা ও পরিধারণ ইউনিট (এফপিএমইউ), জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও), জাতিসংঘের শিশু তহবিল (ইউনিসেফ) এবং বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি)। গত ২৯ অক্টোবর রাজধানীর আগারগাঁওয়ে চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রে আয়োজিত উল্লিখিত এই চারটি প্রতিষ্ঠান যৌথভাবে ‘ইন্টিগ্রেটেড ফুড সিকিউরিটি ফেজ ক্লাসিফিকেশন (আইপিসি)’ অর্থাৎ ‘সমন্বিত খাদ্যনিরাপত্তা ধাপের শ্রেণিবিন্যাস’ শিরোনামে এই প্রতিবেদনটি প্রকাশ করে। 

৫টি ধাপে মূল্যায়ন

খাদ্যঘাটতি, অপুষ্টি ও ঝুঁকিতে থাকা জনগোষ্ঠীকে পাঁচটি ফেজ বা ধাপে মূল্যায়ন করা হয়েছে। ১. সর্বনিম্ন বা স্বাভাবিক, ২. চাপে থাকা, ৩. সংকটে থাকা, ৪. জরুরি অবস্থা এবং ৫. দুর্ভিক্ষ।

সবচেয়ে বেশি খাদ্যসংকটে কক্সবাজার

‘আইপিসি অ্যানালাইসিস রিপোর্ট অন দি অ্যাকিউট ফুড ইনসিকিউরিটি সিচুয়েশন, বাংলাদেশ’ বা ‘বাংলাদেশে তীব্র খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা বিষয়ক বিশ্লেষণ প্রতিবেদন’ শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এ বছর কোনো জেলায় ধাপ-৫ অর্থাৎ দুর্ভিক্ষ দেখা যায়নি, দেখা যাওয়ার আশঙ্কাও নেই। জানুয়ারি থেকে এপ্রিলে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার ধাপ-৪ বা জরুরি অবস্থায়ও কোনো জেলার জনগোষ্ঠী ছিল না। কিন্তু আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে কক্সবাজার ও ভাসানচরে বসবাসরত তিন লাখ ৬০ হাজারের অধিক (আনুমানিক) রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় জরুরি অবস্থার মধ্যে পড়তে পারেন। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী ছাড়াও কক্সবাজারের স্থানীয় বাসিন্দারাও খাদ্যসংকটে পড়তে যাচ্ছে। বিশেষ করে উখিয়া ও টেকনাফের জনসাধারণ। এই জেলার ৩০ শতাংশ মানুষ খাদ্যসংকটের সম্মুখীন হতে যাচ্ছে।

আরো ১২টি জেলা খাদ্যসংকটে 

কক্সবাজারের মতো অতটা খারাপ পরিস্থিতিতে না হলেও বরগুনা, ভোলা, পটুয়াখালী, বান্দরবান, রাঙামাটি, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, জামালপুর, সিরাজগঞ্জ, গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম ও সুনামগঞ্জ জেলা খাদ্য সংকটের (ধাপ-৩) সম্মুখিন হচ্ছে।  

প্রতিবেদনে এ বছরের জানুয়ারি থেকে এপ্রিল মাস পর্যন্ত এবং মে থেকে ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত খাদ্য নিরাপত্তা ঝুঁকির তথ্য আলাদাভাবে তুলে ধরা হয়। জানুয়ারি থেকে এপ্রিলে ৩৬টি জেলার মধ্যে ১৬টি জেলার (রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীসহ) এক কোটি ৫৫ লাখ মানুষ খাদ্যসংকট বা ধাপ-৩-এ ছিল। আর মে থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে ১৩টি (কক্সবাজারসহ) জেলার এক কোটি ৬০ লাখ মানুষ খাদ্যসংকট বা ধাপ-৩-এর সম্মুখীন হচ্ছে।

প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, জানুয়ারি থেকে এপ্রিল মাস পর্যন্ত খাদ্যসংকটে থাকা নোয়াখালী, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার ও সিলেটের খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা কিছুটা কমেছে; এই জেলাগুলো বর্তমানে ধাপ-২-এ অবস্থান করছে। অন্যদিকে ধাপ-২-এ থাকা বাগেরহাট এবার খাদ্যসংকটের তালিকায় (ধাপ-৩) এই অবস্থান করছে।

অপুষ্টির বিষয়ে যা বলা হয়েছে

জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে ১৮টি দুর্যোগপ্রবণ জেলার ছয় মাস থেকে পাঁচ বছরের কম বয়সী ১৬ লাখ শিশু তীব্র অপুষ্টির সম্মুখীন হচ্ছে। প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, একই সময়ে এক লাখ ১৭ হাজার অন্তঃসত্ত্বা নারী ও শিশুকে বুকের দুধ পান করানো মায়েরা তীব্র অপুষ্টিতে ভুগতে যাচ্ছেন। 

বিগত বছরগুলোতেও ছিল খাদ্যসংকট 

মূলত করোনা মহামারির সময় থেকে বিশ্বব্যাপী উন্নয়নশীল দেশগুলোতে ধীরে ধীরে খাদ্যসংকট বাড়তে থাকে। স্বাভাবিকভাবে সে প্রভাব বাংলাদেশের ওপরও পড়ে। করোনার ধাক্কা কাটিয়ে ওঠার আগেই ২০২২ সালে বিশ্বজুড়ে খাদ্যের দাম এবং খাদ্য সরবরাহে ঘাটতি দ্রুত বৃদ্ধি পায়। ওই বছর ইউক্রেন ও রাশিয়ার মধ্যে যুদ্ধ শুরু হলে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা ছাড়াও খাদ্যপণ্যের বাজারের অন্য পর্যবেক্ষকরা খাদ্য সরবরাহ ব্যবস্থায় অপ্রতুলতা এবং মূল্যবৃদ্ধির বিষয়ে সতর্ক করেন। পরবর্তী সময়ে জ্বালানি এবং সংশ্লিষ্ট সারের দাম বেড়ে গেলে খাদ্যের ঘাটতি দেখা দেয়। 

সে বছর আয়ারল্যান্ডভিত্তিক সংস্থা কনসার্ন ওয়ার্ল্ডওয়াইড এবং জার্মানিভিত্তিক ওয়েল্ট হাঙ্গার হিলফ যৌথভাবে প্রকাশিত বিশ্ব ক্ষুধা সূচকে (জিএইচআই) বলা হয়, ১২১টি দেশের মধ্যে আট ধাপ পিছিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান ৮৪-তে নেমে এসেছে এবং মাঝারি ক্ষুধার ঝুঁকিতে রয়েছে।

একই বছর প্রকাশিত যুক্তরাজ্যভিত্তিক দি ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (ইআইইউ) গ্লোবাল ফুড সিকিউরিটি ইনডেক্স ২০২২-এর সূচকে দেখা যায়, ১১৩টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৮০তম। আর জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) ক্রপ প্রসপেক্টাস অ্যান্ড ফুড সিচুয়েশন শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্বের ৪৫টি দেশে ঘাটতিজনিত উচ্চ খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার আশঙ্কা রয়েছে; সে তালিকায় এশিয়ার ৯টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম।

২০২৩ সালে প্রকাশিত জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০২২ ও ২০২৩ সালে রেকর্ড পরিমাণ খাদ্যশস্য উৎপাদনের পরও মে থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দেশের প্রায় এক কোটি ১৯ লাখ মানুষ চরম খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভুগেছিল।

বৈশ্বিক ক্ষুধা সূচক ২০২৪-এর প্রতিবেদনে দেখা যায়, ১২৭টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৮৪তম। প্রতিবেদন অনুযায়ী, সে সময় বাংলাদেশে মাঝারি মাত্রার ক্ষুধা বিরাজ করছিল। জলবায়ু পরিবর্তন ও লিঙ্গবৈষম্যের কারণে দেশের বিভিন্ন জায়গায় বহু মানুষ খাবারের তীব্র সংকটে রয়েছে বলে ওই প্রতিবেদনে বলা হয়। 

২০২৩ সালের বিশ্ব ক্ষুধা সূচকে বাংলাদেশ ১২৫টি দেশের মধ্যে ৮১তম অবস্থানে ছিল আর ২০২২-এ ছিল ৮৪তম; সর্বশেষ প্রতিবেদনগুলো থেকে এটি নিশ্চিত যে, ক্ষুধা ও খাদ্যসংকটের কোনো উন্নতি হয়নি। 

সংকটের কারণ কী? 

বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব সমগ্র পৃথিবীতেই পড়ছে; বাংলাদেশও এই পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে খাদ্য উৎপাদন ক্রমেই হুমকির মুখে পড়ছে। একটি গবেষণায় দেখা গেছে, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে খরা, মাটি ক্ষয়, লবণাক্ততা ও অমøতা বৃদ্ধির কারণে ফসলের ফলন হ্রাস পাচ্ছে এবং মৎস্য, পোলট্রি ও গবাদি পশুর ওপর তাপীয় চাপ বাড়ছে। আর উৎপাদনে ঘাটতির কারণেই প্রধানত খাদ্য ঘাটতি দেখা দেয়। এ ছাড়া যুদ্ধ, কূটনৈতিক সম্পর্কের শীতলতার ফলে খাদ্য আমদানির জটিলতাসহ বিভিন্ন কারণ তো রয়েছেই।  

উত্তরণের উপায়

খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আমদানির আশায় না থেকে দেশে খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির ওপর জোর দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। এ ক্ষেত্রে কৃষিতে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যথাযথ প্রয়োগের বিষয়ে জোর দিয়েছেন তারা। খাদ্য উৎপাদন, সংরক্ষণ ও বিতরণের প্রতিটি ধাপে আধুনিক প্রযুক্তির প্রয়োগ-খাদ্য উৎপাদন ব্যবস্থাকে আরো কার্যকর, নিরাপদ, পরিবেশবান্ধব এবং পুষ্টিকর করে তুলতে পারে বলে মত দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫