প্রতীকী ছবি
‘মা, সুজয় এখন থেকে এই বাড়িতে থাকবে...আমরা লিভ টুগেদার করব’-বলেই বৈশাখী সুজয়কে নিয়ে গটগট করে ঘরে চলে গেল। এটি গরিব মেয়ে ধনী ছেলের গল্প নামের কার্র্টুন। ইউটিউবে শোভা পাচ্ছে এই অ্যানিমেটেড কার্টুনটি।
আর বর্ষা নামের শিশু, বয়স যার ৭, মা-বাবা অফিসে। স্কুল থেকে ফিরে বাসায় বসে বসে এই কার্টুন দেখছে। জানা যায়, বেশির ভাগ সময় ইউটিউবে কার্টুন দেখেই সময় কাটে তার। প্রিয় কার্টুন গরিব মেয়ে ধনী ছেলের প্রেম আর লুল্লু ভূত। সে জানায়, ল্লুল্লু ভূত কাউকে ভালোবাসলে তার চোখের ভেতর লাল হার্ট হয়ে যায়।
বর্ষা জানে না, এসব কার্টুন দেখা তার জন্য ঠিক নয়। কিন্তু ওকে মানা করবে কে? মা-বাবা অফিসে থাকায় তারা জানেন না, বর্ষা কি ধরনের কার্টুন দেখছে আর কিই বা আছে সেসব কার্টুনে? ফলে সে প্রতিদিন টিভিতে দেখছে বৈশাখী সুজয় আর রাজিবের ভালোবাসার গল্প। সেখানে লুকিয়ে পার্টি করা, মদ খাওয়া, প্রেম, লিভ টুগেদার সব আছে।
বর্ষার মতো এ রকম শিশু এখন ঘরে ঘরে। যাদের মা-বাবা কাজে ব্যস্ত থাকায় শিশুদের হাতে তুলে দেন স্মার্টফোন। ফলে বাচ্চাদের সময়টা কাটে কার্টুন দেখে। যেখানে শিশুতোষ কার্টুনের নামে দেখানো হয় বড়দের প্রেমের গল্প।
বাংলা কার্টুন লিখে সার্চ দিলেই অন্তর্জালে চলে আসে এখন গরিব রাখি ওয়ালীর ভাগ্য, আর্মি ছেলের ভালোবাসা, জলপরী ও জেলের প্রেম, রতনের ডাইনি মা, অসহায় গর্ভবতী বউ, শাকচুন্নি বোন, প্রতিবেশির সুন্দরী বউ, ১০০ বউয়ের এক শাশুড়ি, প্রতিবেশীর নিউ ইয়ার ইত্যাদি এমন গল্পের পর্বগুলো। যেখানে রয়েছে অপরিণত বয়সে প্রেম, বিয়ে, ধর্ষণ আর প্রতারণায় ভরা গল্প। এখানে নারী চরিত্রকেও দেখানো হয় নেতিবাচকভাবে। শেখানো হয় কীভাবে মিথ্যে কথা বলতে হয়, বিপদে ফেলতে হয় বন্ধুকে।
এসব কার্টুনের বাইরে রয়েছে টম অ্যান্ড জেরি, ডোরেমন, ডিজনী, হানি-বানি, নন্টে-ফন্টে, মটু-পাতলু, ছোটা ভীম সিনচ্যানসহ এমন আরো কতসব নামের কার্টুন। বেশির ভাগ কার্টুনের প্রতিপাদ্য শত্রুতা, প্রতিহিংসা, ধর্ষণ, একাধিক বিয়ে।
লুল্লু ভূত। ইউটিউবে জনপ্রিয় কার্টুনের অন্যতম। এর প্রতিটি পর্ব ইউটিউবে দেখেছে প্রায় ৮০ থেকে ৯০ লাখের বেশি দর্শক। সাবস্ক্রাইব করেছে ৪৭ লাখ মানুষের বেশি। লুল্লু ভূতের কার্টুনে রয়েছে ল্লুল্লুর মদখোর বউ, লুল্লুর ভ্যাালেন্টাইস ডে, ধোঁকা খেল লুল্লু, লুল্লু ভূতের ভালোবাসা, লুল্লু ভূতের বিয়ে, লুল্লুর বস্ত্রহরণ-এমন নানা সব এপিসোড। যেখানে লুল্লু বারবার প্রেমে পরে, মেয়েদের পেছনে পেছনে সে ঘোরে, একাধিক মেয়ে তাকে ভালোও বাসে। সব মেয়েরা তাকে চায়। সে মেয়েদের আকৃষ্ট করতে নানা ধরনের আচরণ করে।
ছোট ছোট শিশুরা এসব কার্টুন মনোযোগ দিয়ে দেখছে। ফলে তারা শিশু বয়সেই শিখছে প্রেম-সংঘাত-হিংসা। ছোট বয়সেই মনের দিক থেকে তারা হয়ে যাচ্ছে অনেক বড়। অনুভূতির অনুরণন আগেই আসছে তাদের শিশু মনে। ফলে স্কুলগুলোতে ওয়ান-টু-থ্রি-ফোরের ছেলেমেয়েরাও আজকাল প্রেমে পড়ছে। প্রেমপত্র লিখছে। শিক্ষকরা সেসব নিয়ে বসছেন অভিভাবকদের সঙ্গে। অভিভাবকরা বুঝতেই পারছেন না তার শিশুসন্তান এমন আচরণ করছে কেন?
আসলে কার্টুনে কী দেখানো হচ্ছে বা শিশুরা কার্টুনের নামে কী দেখছে তা জানেন না অনেক অভিভাবকই। তারা খবরই রাখেননি ঠাকুরমার ঝুলির গল্পে নৈতিক শিক্ষা দেওয়া হলেও তা বানানো হয় বড়দের উপযোগী করে। ডিজনি-পিকচার নির্মিত এনিমেটেড মুভিগুলো ৯০ ভাগই স্রেফ প্রেম-ভালোবাসার গল্প।
জনপ্রিয় টম অ্যান্ড জেরিতেও টম তার মেয়ে বন্ধু টুডলস বা পাশের বাড়ির অন্য কোনো মেয়ে বিড়ালকে আকৃষ্ট করার জন্য নানা আচরণ করে। ডোরেমনেও নবিতার বান্ধবী সিজুকার দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা চলে। প্রশ্ন, এসব কার্টুন কি শিশু-কিশোরদের জন্য যৌন ইঙ্গিতবাহি নয়? অভিভাবকরা নানা কাজে ব্যস্ত, তাই শিশুদের হাতে মোবাইল তুলে দিয়েই যেন দায় ফুরোতে চাইছেন। আর এভাবেই ডিভাইসে আসক্ত দেশের ৬০ শতাংশ শিশু আসক্ত হয়ে পড়ছে তাদের অনুপযোগী কার্টুনে।
ইউনিসেফের ‘মীনা’ কিংবা সিসিমপুর বাদ দিলে শিশুদের জন্য খুব বেশি কার্টুন সিরিজ তৈরি হয়নি বাংলাদেশে। ‘মন্টু মিয়ার অভিযান’ নামে থ্রিডি কার্টুন একসময় জনপ্রিয়তা পেলেও তা হারিয়ে গেছে। নিরুপায় শিশুরা তাই খুঁজে বেড়ায় মোবাইল মনিটরে ভিনদেশি কার্টুন।
মোহাম্মদপুরে থাকেন গৃহিণী মাহমুদ আরা। তিনি বলেন, কাজের সময় বাচ্চা বিরক্ত করে। কান্নাকাটি করে। তাই বাচ্চাকে শান্ত রাখতে তিনি মোবাইল ফোন দেন। বাচ্চা শান্ত থাকলে সংসারের কাজগুলো তিনি ঠান্ডাভাবে করতে পারেন। জানান, মোবাইল ফোন হাতে নিয়ে তার বাচ্চা কী দেখছে তা তিনি জানেন না। ধরেই নিয়েছেন কার্টুনই দেখে। ডিওএইচএসের খালকিন নাহিদ জানান, কার্টুনে আসলে কী দেখানো হয় তা নিয়ে কখনো ভাবেননি তিনি। ভেবেছেন এখানে শিশুদের উপযোগী করে সব বানানো হয়। কাজের সময় ঝামেলা কমাতে সন্তানকে ছেড়ে দেন ইউটিউব।
এ রকম নানা সমস্যা দেখা যাচ্ছে শিশুদের মধ্যে। যেমন-দেড় বছরের একটি মেয়েশিশু কথা বলতেই চায় না। যাও বা বলে তা কার্টুনের মতো করে হিজিবিজি করে বলে, যা অনেকটাই অস্পষ্ট। বিষয়টি নিয়ে চিন্তায় আছেন তার মা। সে মাশা অ্যান্ড দ্য বিয়ার দেখে। এই কার্টুনে মাশা খুব দুষ্টামি করে। মেয়েটিও মাশার মতো করে কথা বলে। সারা দিন নানা জিনিসপত্র মাটিতে ফেলে দেয়। আবার রোহান নামের একটি ছেলের কথা বলা যায়, যার আচরণ দিন দিন রুক্ষ হয়ে উঠেছে। কদিন আগে সে বাথরুমে তেল ফেলে দিয়েছিল বাসার হেল্পিং হ্যান্ড যেন পিছলে পড়ে যায়। কোথায় শিখেছে জানতে চাইলে জানায়, কার্টুনে দেখেছে এভাবে শাস্তি দিতে হয়।
অনেক অভিভাবককেই শিশুদের সঙ্গে কার্টুন দেখতে বসে বিব্রত হতে হয়। কারণ বড়দের নাটকের মতো ডায়ালগ সেখানে। এসব বাচ্চাদের অপরিণত মস্তিষ্কে কী প্রভাব ফেলছে তা নিশ্চয়ই ভাবনার বিষয়। প্রায় সময়ই চ্যানেল বদলে ফেলে অভিভাবকরা হয়তো সাময়িকভাবে সমাধান পান, কিন্তু এটা তো স্থায়ী কিছু নয়।
চিত্রশিল্পী ও বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব মুস্তফা মনোয়ার উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন ইউটিউবে কার্টুন বেশির ভাগই শিশুবান্ধব নয় বলে। তার মতে, আগে বাংলাদেশ টেলিভিশনে শিশুদের মননশীলতার দিকটায় প্রাধান্য দিয়ে অনেক যত্ন করে ভেবে বানানো হতো অনুষ্ঠান। শিশুদের মনোজগৎ বোঝেন এমন ব্যক্তি কার্টুন তৈরি করলে তা শিশুবান্ধব হবে-অভিমত শিল্পী মুস্তাফা মনোয়ারের। শিশুদের মধ্যে আগ্রহ তৈরি করে, এমন শিক্ষামূলক কার্টুন তৈরির উদ্যোগ নেওয়া জরুরি বলে মনে করেন তিনি, যা নিজ দেশের ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি ও মনস্তাত্মিক বিকাশে সাহায্য করবে।
কার্টুন নির্মাতা সোহেল মোহাম্মদ রানা বলেন, দেশে দেশীয় সংস্কৃতি বা নৈতিক মূল্যবোধে তৈরি বাংলা ভাষায় কার্টুন সিরিজের সংখ্যা খুবই কম। ফলে শিশুরা বিদেশি কার্টুনগুলো দেখে অন্য দেশের সংস্কৃতি শিখছে। তার মতে, ভালো কার্টুন তৈরি হলেই সমস্যার সমাধান হবে না। মা-বাবার সচেতনতা দরকার সবার আগে।
মনোবিজ্ঞানী ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, নেতিবাচক কার্টুন শিশু মনে দ্রুত প্রভাব ফেলে। তার সাদা মনে সে ভেবেই নেয়, জগৎ বুঝি এমনই। কারণ তার প্রিয় চরিত্রগুলো তো এমন করছে। ফলে তার প্রিয় কার্টুন চরিত্রগুলো যা করে সে তাই অনুসরণ করার চেষ্টা করে। সে যখন কোনো কার্টুন আগ্রাসি হিংসা প্রতিশোধমূলক ঘটনা দেখে তখন তার মস্তিষ্কে এক ধরনের ডোপামিন নিঃস্বরিত হয়। ডোপামিন এক ধরনের নিউরোট্রান্সমিটার, যা মস্তিষ্কের রাসায়নিক বার্তাবাহক হিসেবে কাজ করে। এই ডোপামিন আনন্দ, অনুপ্রেরণা এবং সন্তুষ্টি অনুভব করায়। ফলে সে যখন কার্টুনে মাদক, সেক্স, পরকীয়া লিভটুগেদার দেখে, তখন তার ভেতর এক স্নায়বিক প্রক্রিয়া তৈরি হয়। যার কারণে শিশু বয়সেই তার শারীরিক ও মানসিক অনুভূতি তৈরি হয় বড়দের মতো। প্রকাশ করতে পারে না বলে সে বিভিন্ন নেতিবাচক আচরণ করে, যা অনেক অভিভাবকই বুঝতে পারেন না।
তিনি শিশুদের মনোবিকাশের জন্য তাদের সঙ্গে আনন্দময় সময় কাটানোর পরামর্শ দেন। বলেন, সে কি দেখছে তা খেয়াল রাখতে হবে। প্রয়োজনে তার সঙ্গে বসে কার্টুনসহ তার উপযোগী শিশুতোষ অনুষ্ঠান দেখতে হবে। সবচেয়ে ভালো হয় শিশুকে তার বয়সী শিশুদের সঙ্গে মাঠে খেলাধুলা ও সংস্কৃতিচর্চায় উৎসাহিত করা।
