মজুত পর্যাপ্ত, তবুও কেন অস্থির পেঁয়াজের বাজার
আবুল বাসার সাজ্জাদ
প্রকাশ: ১২ নভেম্বর ২০২৫, ১৫:৩৩
হঠাৎ করেই বেড়েছে পেঁয়াজের দাম।
দেশে হঠাৎ করেই পেঁয়াজের দাম বেড়ে যাওয়ায় হতবাক ক্রেতারা। কয়েক দিনের ব্যবধানে কেজিতে দাম বেড়েছে অন্তত ৪০ টাকা।
এ বছর পেঁয়াজের মৌসুম প্রায় শেষের দিকে। ডিসেম্বরে ‘মুড়িকাটা পেঁয়াজ’ এবং জানুয়ারিতে নতুন মৌসুমের পেঁয়াজ বাজারে আসার কথা। ব্যবসায়ীরা বলছেন, মজুত পেঁয়াজ দিয়ে চাহিদা মেটানো সম্ভব হলেও অসাধু চক্র মুনাফা করতে দাম বাড়াচ্ছে।
সাধারণত প্রতি বছর প্রায় ৫ লাখ টন পেঁয়াজ আমদানি করতে হলেও এবার তা হয়নি। কৃষি মন্ত্রণালয় গতবারের চেয়ে বেশি উৎপাদনের কথা বললেও বৃষ্টিতে ফসল নষ্ট হওয়ার কথা জানিয়েছেন কৃষকরা। ভোক্তা চাহিদা ও জোগানের হিসাবে গরমিলের কারণেও সংকট তৈরি হয়েছে বলে মনে করছেন কেউ কেউ।
ছোট ব্যবসায়ীদের মতে, এ বছর পেঁয়াজের বাম্পার ফলন হওয়ায় বছরের শেষ সময়ের জন্য পর্যাপ্ত সরবরাহ রয়েছে। এরপরও বাজার অস্থির হওয়ার পেছনে সিন্ডিকেটের কারসাজি দেখছেন তারা।
তাদের এই ধারণাকে সমর্থন করে কৃষকরা বলছেন, তাদের হাতে এখন আর পেঁয়াজ নেই, সবটাই মধ্যস্বত্বভোগীদের কাছে। প্রতি বছর তারাই কৃত্রিম সংকট তৈরি করে।
সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্য বলছে, এক মাসের ব্যবধানে পেঁয়াজের দাম প্রায় ৪০ টাকা বাড়লেও তা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় এখনও ৩০ টাকা কম।
তবে কৃষি অধিদপ্তরের শীর্ষ কর্মকর্তারা আশা করছেন, সপ্তাহখানেকের মধ্যে পেঁয়াজের বাজারে স্থিতিশীলতা ফিরবে। তারা জানান, চলতি মাসের শেষের দিকেই মুড়িকাটা পেঁয়াজ বাজারে আসতে শুরু করবে।
ফরিদপুরের পেঁয়াজ চাষি মো. হাবিব খান বলেন, “আগামী ডিসেম্বরের শুরুতে মুড়িকাটা পেঁয়াজ বাজারজাত করতে পারব। তখন পেঁয়াজের বাজার ঠান্ডা হবে।”
এ বছরও পেঁয়াজের বাম্পার ফলন হয়েছে দাবি করে তিনি বলেন, “সিন্ডিকেটের জন্য দাম বাড়ছে। পুরনো পেঁয়াজ আর আমাদের কাছে নেই। সব বড় বড় ব্যবসায়ীদের কাছে।”
কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছর দেশে প্রায় ৩০ থেকে ৩৭ লাখ টন পেঁয়াজ উৎপাদিত হয়েছে। পচনশীল হওয়ায় এর সাড়ে সাত শতাংশ পর্যন্ত নষ্ট হয়ে যেতে পারে।
কারওয়ান বাজারের পাইকারি দোকান মেসার্স মিনহাজ বাণিজ্যালয়ের বিক্রেতা মো. রাজিব বলেন, “নভেম্বর মাস হচ্ছে হালি পেঁয়াজের মৌসুমের শেষের সময়। এই সময়ে পেঁয়াজের কিছুটা ঘাটতি সাধারণত তৈরি হয়, তাই দামও কিছুটা বেড়ে যায়।
“কিন্তু এই বছর অন্য বছরের মতো বাজারে ঘাটতি নেই। বাজারে যে পেঁয়াজ আছে, তা দিয়ে নতুন (মুড়িকাটা) পেঁয়াজ বাজারে আসা পর্যন্ত চলবে,” বলেন তিনি।
রাজিবের মতে, “মুড়িকাটা পেঁয়াজ বাজারে আসা শুরু করে ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে। এই সময়ের মধ্যে আমদানি করে সিন্ডিকেটের থাবা নষ্ট করলে দাম কমবে। নাহলে বাজার কী হবে, বোঝা মুশকিল।”
এই বাজারের আরেক পাইকারি বিক্রেতা আব্দুস সামাদ আকন্দও মনে করেন, সিন্ডিকেটের কারণেই দাম বাড়ছে।
সাম্প্রতিক দেশকালকে তিনি বলেন, “বাজার কম দেখে ব্যবসায়ীরা পেঁয়াজ আটকে দিয়েছে। আমদানি হলে সিন্ডিকেট করে লাভ হবে না, পেঁয়াজের দাম কমবেই।”
“এখন বাজারে যে পেঁয়াজ আছে, সেটার মৌসুম শেষের দিকে। তাই অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করে সিন্ডিকেট চক্র সুবিধা নিতে চাচ্ছে। এই বছর পেঁয়াজের উৎপাদন বেশি, তাই বছরের বেশিরভাগ সময়ে দাম ৭৫ টাকা ছিল,” যোগ করেন তিনি।
দাম বাড়ায় ব্যবসায় নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে জানিয়ে এই বিক্রেতা বলেন, অন্য সময়ে ঘণ্টায় গড়ে পাঁচ বস্তা পেঁয়াজ বিক্রি করতে পারলেও এখন এক বস্তা বিক্রি করতেই হিমশিম খাচ্ছেন।
বর্তমানে কারওয়ান বাজারে পাইকারিতে মানভেদে ফরিদপুরের পেঁয়াজ ৯৫ থেকে ১০০ টাকা এবং পাবনার পেঁয়াজ ১০০ থেকে ১০৫ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।
দাম না কমলে আমদানি
এদিকে দাম না কমলে পেঁয়াজ আমদানির ইঙ্গিত দিয়েছে সরকার।
রবিবার সচিবালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন বলেন, চলতি সপ্তাহের মধ্যে বাজারে দাম না কমলে পেঁয়াজ আমদানির সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। তবে দাম স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এলে আর অনুমতি দেওয়া হবে না।
“পেঁয়াজ আমদানি করতে ইচ্ছুক ২ হাজার ৮০০ জনের আবেদন মন্ত্রণালয়ে আছে। এর ১০ শতাংশকেও যদি আমদানির অনুমতি দেওয়া হয়, তাহলে বাজারে ধস নামবে। আমরা ধস নামাতে চাই না,” বলেন তিনি।
তিনি মনে করেন, মৌসুমের শেষ সময় এবং পেঁয়াজের ওজন কমে যাওয়ার কারণে সম্প্রতি দাম বাড়তে পারে। তবে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে দাম বাড়ানোর কোনো তথ্য তার কাছে নেই বলে জানান বাণিজ্য উপদেষ্টা।
তিনি স্বীকার করেন, হঠাৎ করে পেঁয়াজের কেজি ৪০ টাকা বেড়ে যাওয়াটা যুক্তিসংগত নয়।
বাণিজ্য সচিব মাহবুবুর রহমান জানান, বর্তমানে সাড়ে তিন লাখ টনের মতো পেঁয়াজ মজুত আছে। তার তথ্যমতে, চলতি মাসে ৮৫ থেকে ৮৭ হাজার টন এবং আগামী মাসে আড়াই লাখ টন পেঁয়াজ আসবে। এরপরও বাজারে নিয়মিত সরবরাহ থাকবে।
তবে আমদানির সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছেন ফরিদপুর থেকে ঢাকায় পেঁয়াজ সরবরাহকারী আব্দুর রশিদ। তিনি বলেন, “পেঁয়াজ আমদানি করে কৃষকের পেটে লাথি দিলে ভবিষ্যৎ ভালো হবে না। কারণ কৃষকরা এই বছরে এমনিতেই খুব বেশি লাভ করতে পারেনি।”
তার আশঙ্কা, “আমদানি করলে আগামী বছরে উৎপাদন কমে যাবে।”
“সরকার যদি বৈধ পথে ৫০ হাজার টন আমদানির সুযোগ দেয়, তাহলে অবৈধ পথে আসবে দুই লাখ টন। অবৈধ পথেই বেশি আসে। এজন্য আমদানির সুযোগ না দিয়ে মনিটরিং করলেই দাম কমে যাবে,” বলেন তিনি।
দাম বাড়ার কারণ ব্যাখ্যা করে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সরেজমিন শাখার পরিচালক মো. ওবায়দুর রহমান মন্ডল বলেন, “স্টক ভালো থাকলেও দেশের মানুষ প্রতিদিনই পেঁয়াজ খাচ্ছে, ফলে তা খরচ হচ্ছে। এই মুহূর্তে আমাদের আড়াই লাখ টন পেঁয়াজ স্টকে আছে।”
তিনি আরও বলেন, “বাংলাদেশে কেমন যেন একটা সংস্কৃতি হয়ে গেছে যে, বছরের শেষে যখন কোনো পণ্য শেষ হতে যায়, তখন ব্যবসায়ীরা সেটার দাম অনেক বাড়িয়ে দেয়।
