গণভোট: কাউকে খুশি করতে পারল না সরকার
আল হেলাল শুভ, খোকন তালুকদার ও আবুল বাসার সাজ্জাদ
প্রকাশ: ১৫ নভেম্বর ২০২৫, ১৫:৪৭
জুলাই সনদ বাস্তবায়নে গণভোট। প্রতীকী ছবি
জাতীয় নির্বাচন ও গণভোট নিয়ে সরকার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তাতে আগামী নির্বাচনে সম্ভাব্য দুই প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি ও জামায়াত—দুই পক্ষই বিরূপ প্রতিক্রিয়া জানালেও সরকার মনে করে সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে।
গণভোটের সময় নিয়ে সরকারের সিদ্ধান্ত আর বিএনপির দাবির সঙ্গে মিলে গেছে। জাতীয় নির্বাচনের দিনই ‘জুলাই সনদ’ নিয়ে জনগণের মতামত নিতে চায় সরকার। তবে এতে অসন্তুষ্ট জামায়াত, যারা নভেম্বরের মধ্যে গণভোটের দাবিতে ইতিমধ্যে আন্দোলনে আছে।
জ্বালানি উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান অবশ্য দেশকাল নিউজ ডটকমকে বলেছেন, তারা কারও দাবি মেনে বা কারও দাবি অগ্রাহ্য করে সিদ্ধান্ত নেননি। এসব বিষয়ে পরে সরকারের পক্ষ থেকে ব্যাখ্যা আসবে।
জাতীয় নির্বাচন সংখ্যানুপাতিক ভোটাধিকারের ভিত্তিতে হচ্ছে না—এ বিষয়েও সরকার তার অবস্থান জানিয়ে দিল। এটিও জামায়াত ও তার সঙ্গে থাকা দলগুলোর অসন্তুষ্টির আরেক কারণ। এই অবস্থায় তারা প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনার সামনে অবস্থানের ঘোষিত কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্তও নিয়েছে।
তবে গণভোটের সময় ও ভোটের পদ্ধতি নিয়ে দাবি মেনে নিলেও বিএনপিও সন্তোষ প্রকাশ করেনি, যেটি সরকারের জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ হিসেবেই দেখা হচ্ছে।
প্রধান উপদেষ্টা জুলাই সনদ থেকে সরে গেছেন—এমন অভিযোগও করা হয়েছে দলটির পক্ষ থেকে।
আরেক আলোচিত দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) এখনও প্রধান উপদেষ্টার ভাষণ নিয়ে আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানায়নি। তবে দলটির শীর্ষস্থানীয় এক নেতা নির্বাচন কমিশনের সক্ষমতা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন।
কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের অনুপস্থিতিতে প্রধান দুই দলের মধ্যে যখন এই বিভেদ এবং দুই পক্ষই যখন সরকারের সিদ্ধান্ত নিয়ে অসন্তোষ জানাচ্ছে, তখন রাজনীতিতে নতুন কোনো সংকট তৈরি হয় কি না, এ নিয়ে প্রশ্ন ছিল জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের শিক্ষক মো. শামসুল আলমের কাছে।
জবাবে তিনি বলেন, “এখন যে ঘটনাগুলোর সংবাদ দেখছি, এগুলো করা হচ্ছে যাতে এগুলোর কারণে ভীত হয়ে অন্তর্বর্তী সরকার নির্বাচনটা পিছিয়ে দেয়। আমাদের দাবিটা হচ্ছে, কোনো অবস্থাতেই নির্বাচন না পিছিয়ে ফেব্রুয়ারিতে রমজানের আগে করে ফেলা—আমরা স্বাধীনভাবে আবার ভোট দিতে চাই।”
দলগুলো অসন্তোষ জানালেও প্রধান উপদেষ্টার ভাষণে রাজনৈতিক সংকট নিরসনের আশা দেখতে পাওয়ার কথাও জানান তিনি। বলেন, “আমরা আশা করব রাজনৈতিক দলগুলো আর বেশি মতপার্থক্য না দেখিয়ে, যে বিষয়গুলো নিয়ে মতপার্থক্য সেগুলো দূরে রেখে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কাজটা আরও এগিয়ে নেবে।”
সরকারের ভেতরের একটি অংশ নির্বাচন দিয়ে দ্রুত চলে যেতে চাইছে বলেও মনে করেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানের এই শিক্ষক। তিনি বলেন, “আমরাও আশা করছি যে একটা সুন্দর, সুষ্ঠু নির্বাচন হোক, সবাই মিলে অংশগ্রহণ করুক। নির্বাচনের জন্য সবাই কিন্তু নিজেদের প্রার্থী বাছাই করছে, বিভিন্ন এলাকায় প্রচার করছে। অর্থাৎ এই প্রেক্ষিতে যতই নির্বাচনের দিকে যাবে দেশ ও জাতি, ততই আরও ভালো দিকে যাবে।”
প্রধান দুই দাবি পূরণের পরেও বিএনপির অসন্তোষ কেন?
বিএনপির দাবি অনুযায়ী জাতীয় নির্বাচন ও গণভোট একই দিনে হতে যাচ্ছে। আবার সংখ্যানুপাতিক ভোটাধিকার বা পিআর পদ্ধতিও সরকার মেনে নেয়নি। এরপরও প্রধান উপদেষ্টার ভাষণে খুশি নন দলটির নেতারা।
দলটির অসন্তুষ্টির কারণ হলো—জুলাই সনদ নিয়ে প্রধান উপদেষ্টা যে গণভোটের কথা বলছেন, তাতে ‘হ্যাঁ’ জয়যুক্ত হলে সংসদ নির্বাচনে নির্বাচিত প্রতিনিধি নিয়ে একটি সংবিধান সংস্কার পরিষদ গঠিত হবে। এই প্রতিনিধিরা একই সঙ্গে জাতীয় সংসদের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন। কিন্তু গত ১৭ অক্টোবর সই হওয়া জুলাই সনদে এই বিষয়টির উল্লেখ ছিল না।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, “সংবিধান সংস্কার পরিষদ নতুন ধারণা। ঐকমত্য কমিশনে এই বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়নি।”
জামায়াতসহ আট দলে অসন্তোষ বেশি
জামায়াত-ইসলামী আন্দোলনসহ আটটি দল যেসব দাবি নিয়ে সোচ্চার, তা কার্যত নাকচ করে দিয়েছে সরকার।
অন্যদিকে দলগুলোর ঘোষণা আছে—আগে গণভোট আর পিআর পদ্ধতি না হলে জাতীয় নির্বাচন হতেই দেওয়া হবে না।
তাদের দাবির মধ্যে আছে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশ জারি ও সেই আদেশের ওপর নভেম্বর মাসের মধ্যেই গণভোট আয়োজন; আগামী জাতীয় নির্বাচনে সংসদের উভয় কক্ষে পিআর (সংখ্যানুপাতিক ভোটাধিকার) পদ্ধতি চালু; অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের লক্ষ্যে সবার জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করা; ‘ফ্যাসিস্ট সরকারের’ জুলুম-নির্যাতন, গণহত্যা ও দুর্নীতির বিচার দৃশ্যমান করা; এবং ‘স্বৈরাচারের দোসর’ জাতীয় পার্টি ও ১৪ দলের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা।
প্রধান উপদেষ্টা প্রথম ও প্রধান দুটি দাবি কার্যত নাকচ করে দেওয়ার পর জামায়াতের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, “দুইটি ভোট (গণভোট ও জাতীয় নির্বাচন) একই দিনে দিতে গিয়ে জাতিকে একটি সংকটে ফেলে দেওয়া হলো।”
এমন প্রতিক্রিয়া জানিয়ে সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার জানিয়েছেন, দাবি আদায়ে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনার সামনে অনির্দিষ্টকালের জন্য অবস্থান কর্মসূচি বহাল আছে। সেটি কবে থেকে হবে, তা আগের ঘোষণা অনুযায়ী রবিবার জানানো হবে।
প্রধান উপদেষ্টা জনগণের অভিপ্রায় ও গণদাবিকে উপেক্ষা করেছেন বলে অভিযোগ এনে জামায়াত নেতা বলেন, “আমরা দলের পক্ষ থেকে খুবই পরিষ্কার করে বলতে চাই, প্রধান উপদেষ্টা এ ঘোষণায় জনগণের আকাঙ্ক্ষা পূরণ হয়নি।”
জামায়াতের সঙ্গে থাকা আরেক দল ইসলামী আন্দোলনের মহাসচিব ইউনূস আহমাদ দেশকাল নিউজ ডটকমকে বলেন, “জাতি যা চেয়েছিল তার একেবারেই বিপরীত হয়েছে। এটা করে কোনো এক পক্ষকে খুশি করা হয়েছে। বিষয়টিকে একপেশে।”
একই সঙ্গে আন্দোলনে থাকা আরেক দল বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের আমির মামুনুল হকও অসন্তুষ্ট। তিনি বলেছেন, “জাতীয় নির্বাচন ও গণভোট একসঙ্গে করার ঘোষণা দিয়ে এবং একই প্রশ্নের মধ্যে আলাদা আলাদা চারটি অংশ রেখে গণভোটকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলা হয়েছে। এর মাধ্যমে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সাংবিধানিক স্বীকৃতিও ঝুঁকিতে পড়েছে।”
দলীয় প্রতীকে জাতীয় নির্বাচনের সঙ্গে গণভোট হলে গণভোটের গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নগুলো মানুষ যথাযথভাবে বুঝে মত প্রকাশ করতে পারবে না বলেও মনে করেন খেলাফত নেতা। তার আশঙ্কা—এতে গণভোটের স্বচ্ছতা ও গ্রহণযোগ্যতা বিঘ্নিত হবে।
আরেক দল খেলাফত মজলিসের আমির আব্দুল বাছিত আজাদ বলেছেন, “একই দিনে গণভোট ও জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজনের সক্ষমতা নিয়ে জনমনে সংশয় রয়েছে। নির্বাচন কমিশন সকল দলের জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করতে পারবে কি না, সে প্রশ্নও রয়েছে। এতে জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়ন নিয়ে আরও জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে।”
জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি (জাগপা)-র প্রতিক্রিয়াও একই রকম। দলের সহ-সভাপতি রাশেদ প্রধান বলেন, “হাজারো শহীদের রক্তের বিনিময়ের প্রাপ্ত নতুন বাংলাদেশে প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্যে দেশ ও জাতির প্রত্যাশা পূরণ হয়নি।”
নির্বাচন কমিশন কি সক্ষম?
এই প্রশ্ন তুলেছেন এনসিপি মুখ্য সমন্বয়ক নাসিরউদ্দিন পাটওয়ারী। তিনি বলেন, “গণভোট ও জাতীয় নির্বাচন একই দিনে অনুষ্ঠিত হলে এনসিপির কোনো আপত্তি নেই। তবে নির্বাচন কমিশনের সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে। এ জন্য সরকার এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কাছে আহ্বান জানানো হবে নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করার জন্য, কারণ কমিশন দুর্বল থাকলে একদিনে ভোট আয়োজন হুমকির মুখে পড়বে।”
প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ.এম.এম. নাসির উদ্দিন এই বিষয়টি নিয়ে এখনও মন্তব্য করেননি, কারণ তিনি সরকারের কাছ থেকে আনুষ্ঠানিক কোনো মন্তব্য পাননি।
তবে কমিশনের একাধিক কর্মকর্তা সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, একই দিনে দুটি বিষয়ে ভোটের আয়োজনে তাদের কোনো সমস্যা হবে না। একই ভোটকেন্দ্রে কেবল কক্ষ ও একটি করে ব্যালট বাক্স বাড়িয়ে ভোট নেওয়া সম্ভব। এতে ভোট কর্মকর্তার সংখ্যা সামান্য বাড়াতে হবে।
তবে একসঙ্গে ভোট হলে গণনা শেষ করতে অনেক বেশি সময় লাগবে, যা কোনো কোনো ক্ষেত্রে রাত পেরিয়ে যেতে পারে।
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রায় ২ হাজার ৮০০ কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে। এর সঙ্গে গণভোটের জন্য অতিরিক্ত ৩০০ থেকে ৪০০ কোটি টাকা লাগতে পারে। আলাদাভাবে গণভোট আয়োজন করতে গেলে প্রায় সমপরিমাণ অর্থই ব্যয় হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাবে: জ্বালানি উপদেষ্টা
প্রধান উপদেষ্টার ভাষণের পর রাজনৈতিক দলগুলো অসন্তোষ প্রকাশের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ; সড়ক পরিবহন ও সেতু; এবং রেলপথ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান দেশকাল নিউজ ডটকমকে বলেন, “এটা সাময়িক একটা অবস্থা। আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাবে। সরকারের তরফ থেকে এগুলোর ব্যাখ্যা আসবে।”
ভাষণে বিএনপির দাবি পূরণ হয়েছে, অপরদিকে জামায়াতের দাবিগুলো পূরণ হয়নি—এমন অভিযোগের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে উপদেষ্টা বলেন, “এটা একদমই ঠিক না। এখানে কারও দাবি রাখা হয়েছে আর কারও দাবি রাখা হয়নি—এমন অভিযোগ সত্য নয়। বরং এই আদেশে জুলাইয়ের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটানো হয়েছে।”
নির্বাচন কমিশন সংস্কার কমিশনের সাবেক সদস্য ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক কাজী মাহফুজুল হক বলেন, “এই ভাষণে ইতিবাচক অনেক দিক রয়েছে।”
সংস্কার নিয়ে নির্বাচিত সরকারকেই মূল দায়িত্বটি পালন করতে হবে বলে মত দিয়ে তিনি বলেন, “কারণ অন্তর্বর্তী সরকারের হাতে এত সময় নেই। কিছু কিছু সংস্কার এই সরকারও শুরু করেছে। তাছাড়া এগুলো বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি প্রয়োজন। সে কারণে পরবর্তী সরকারকে প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা তাদের দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে।”
