একের ভেতরে অনেক: গণভোটের প্রশ্ন নিয়েই অনেক প্রশ্ন
নিশাত বিজয়
প্রকাশ: ১৬ নভেম্বর ২০২৫, ১১:২৬
জুলাই সনদ বাস্তবায়নে গণভোট। প্রতীকী ছবি
জুলাই সনদ নিয়ে যে প্রশ্নে গণভোট হতে যাচ্ছে, তা দেখে বিস্মিত সাবেক সংবাদকর্মী এবং বর্তমানে একটি জনসংযোগ প্রতিষ্ঠানে কর্মরত খাইরুল বাশার।
বেশ কয়েক বছরের সাংবাদিকতা জীবনে রাজনীতি, নির্বাচন কমিশন ও সংসদ নিয়ে সংবাদ সংগ্রহ ও লেখার অভিজ্ঞতা থাকা খাইরুল বুঝতে পারছেন না, ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’—এই একটি মাত্র সিদ্ধান্ত যেখানে দিতে হবে, সেখানে চারটি প্রসঙ্গ এবং প্রতিটি প্রসঙ্গে একাধিক বিষয় কীভাবে থাকে।
সাম্প্রতিক দেশকালকে তিনি বলেন, “জুলাই সনদের বিষয়ে যে চারটি বিষয় রয়েছে, সেগুলোর মধ্যে দেশ ও রাষ্ট্র পরিচালনার নানা গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত রয়েছে। যেগুলো নিয়ে আসলে একটি ‘হ্যাঁ–না’ দিয়ে উত্তর দেওয়া নাগরিকের গণতান্ত্রিক অধিকার হরণের শামিল। পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে অগণতান্ত্রিক আচরণেরও সামিল।”
কোনো প্রসঙ্গে তিনি ‘হ্যাঁ’ এবং কোনো প্রসঙ্গে ‘না’ ভোট দিতে চান জানিয়ে খাইরুল বলেন, “তাই এ নিয়ে প্রতিটি বিষয়ে আলাদা আলাদা প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার সুযোগ থাকা উচিত। প্রয়োজনে একাধিক দিনে ভোট গ্রহণ করা যেতে পারে।”
গত ১৩ নভেম্বর জাতির উদ্দেশে ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস জানান, জাতীয় নির্বাচন ও গণভোট হবে একই দিনে। সেই সঙ্গে গণভোটের প্রশ্ন কী হবে, তাও তুলে ধরেন তিনি। সেই প্রশ্নে মোটাদাগে আছে চারটি বিষয়। প্রতিটি বিষয়েই আবার আছে নানা প্রসঙ্গ।
যে চারটি প্রসঙ্গে গণভোট হতে যাচ্ছে, সেটি সাধারণ মানুষের বোধগম্য কি না—সেই প্রশ্নও উঠেছে এরই মধ্যে।
সেই গণভোটে ‘হ্যাঁ’ জয়যুক্ত হলে পরের সংসদে কী কী হবে, তাও জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা। সেদিন থেকেই আলোচনা উঠেছে—কীভাবে এতগুলো প্রসঙ্গে নাগরিকরা একই মত পোষণ করবে।
প্রধান উপদেষ্টার ডেপুটি প্রেস সচিব আজাদ মজুমদার বলেন, “চারটি প্রশ্নের জন্য একটি উত্তর দেওয়া হবে—হ্যাঁ বা না। কেউ যদি ‘হ্যাঁ’ দেয়, তাহলে তা চারটিতেই সম্মতির অর্থ বহন করবে।”
‘জনগণকে বোঝাবেন কী করে?’
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি–সিপিবির সাবেক সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্সও গণভোটের প্রশ্ন নিয়ে অসন্তুষ্ট। দেশকাল নিউজ ডটকমকে তিনি বলেন, “ভোটাররা কোনো বিষয়ে একমত, আবার অনেক বিষয়ে একমত নয়। তাহলে তারা কিসে ভোট দেবেন? আর যারা জনগণকে বোঝাবেন, তারা কীভাবে এতো অল্প সময়ে সবাইকে বোঝাবেন?”
গণভোট এ মুহূর্তে অপ্রয়োজনীয় বলে মত দিয়ে তিনি আরও বলেন, “গণভোটের ফল যদি নির্বাচিত সংসদ না মানে, তাহলে তো সেটা কিছুই হবে না। আগে সংসদ কোন বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে, তারপর গণভোট দেওয়া উচিত। নতুবা এটা নতুন সংকট তৈরি করবে।”
জুলাই গণঅভ্যুত্থানে সক্রিয় দল বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি সাইফুল হকও বলেন, “অতি জ্ঞানী মানুষও এত গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের উত্তর একটি ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ দিয়ে দিতে পারবেন না। সরকারের নিজের সংকট জনগণের ওপর চাপানো হয়েছে মনে হচ্ছে।”
প্রশ্ন কি বোধগম্য?
এই প্রশ্নটি সামনে এনেছেন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের সংগঠন ইউনিভার্সিটি টিচার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ—ইউট্যাবের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক জাহাঙ্গীর হোসেন বাবু।
দেশকাল নিউজ ডটকমকে তিনি বলেন, “আমাদের দেশের মানুষ গণভোট বলতে বোঝে ‘এই সরকার থাকবে কি থাকবে না’। কিন্তু যেটা আমাদের দেশের শিক্ষিত শ্রেণীই ঠিকভাবে বুঝে উঠতে পারছে না, সেখানে সাধারণ মানুষ সেটাকে কীভাবে গ্রহণ করবে? মানুষ না বুঝেই একটা সময় ‘না’ ভোট দিয়ে দেবে। তখন? তখন তো সংস্কারই আর হবে না।”
রাজনৈতিক যে অনৈক্য দেখা যাচ্ছে, সেটিও বিবেচনায় রাখা দরকার বলে মত দিয়েছেন তিনি। বলেন, “প্রশ্নগুলো বুঝে ভোট দেওয়াটা একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। জুলাই সনদ নিয়ে আগে সবাইকে একমত হতে হবে। কিন্তু এই একমতই যদি না থাকে, তাহলে এই সনদেরই বা কী কার্যকারিতা থাকে?”
এই গণভোট আগের অন্যান্য নির্বাচনের চেয়ে আলাদা বলে মন্তব্য করে তিনি বলেন, “একক কোনো প্রশ্নের বিষয়ে দ্বিমত থাকলে মতামত বা ভোট প্রদানের সুযোগ রাখা হয়নি। এগুলো সুদূরপ্রসারী কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।”
বিএনপি–জামায়াত নাখোশ অন্য কারণে
গণভোট আর জাতীয় নির্বাচন একই দিনে করার দাবিটি পূরণ হলেও বিএনপি সরকারের ঘোষণায় নাখোশ। কারণ জুলাই সনদ নিয়ে প্রধান উপদেষ্টা যে গণভোটের কথা বলছেন, তাতে ‘হ্যাঁ’ জয়যুক্ত হলে সংসদ নির্বাচনে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি সংবিধান সংস্কার পরিষদ গঠিত হবে। এই প্রতিনিধিরা একই সঙ্গে জাতীয় সংসদের সদস্য হিসেবেও দায়িত্ব পালন করবেন। কিন্তু গত ১৭ অক্টোবর সই হওয়া জুলাই সনদে এই বিষয়টির উল্লেখ ছিল না।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, “সংবিধান সংস্কার পরিষদ নতুন ধারণা। ঐকমত্য কমিশনে এই বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়নি। প্রধান উপদেষ্টা নিজেই জুলাই সনদ থেকে দূরে সরে গেছেন।”
আরও পড়ুন: রাষ্ট্র বনাম শহিদুল মামলা: ৫৭ ধারায় তদন্তাধীন মামলা বাতিলের পথ খুলল
আগে গণভোটের দাবি পূরণ না হওয়ায় জামায়াত তার অসন্তুষ্টি গোপন রাখেনি। তার সঙ্গে আছে আরও সাতটি দল, যারা দাবি আদায়ে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন ‘যমুনা’র সামনে অবস্থান নেওয়ার ঘোষণা দিয়ে রেখেছে।
এখন কী করা হবে, সেই সিদ্ধান্ত নিতে রবিবার বৈঠকে বসতে যাচ্ছে দলগুলো।
প্রশ্ন এক, প্রসঙ্গ অনেক
প্রধান উপদেষ্টা চারটি সংস্কার ক্ষেত্র উল্লেখ করেছেন, যা একটি যৌথ প্রশ্নের অধীনে গণভোটের ব্যালটে থাকবে। ভোটারদের জিজ্ঞাসা করা হবে:
“আপনি কি জুলাই ন্যাশনাল চার্টার (সাংবিধানিক সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ, ২০২৫ এবং নিচের প্রস্তাবগুলোর সঙ্গে একমত?”
চারটি প্রস্তাব হলো—
ক) নির্বাচনকালীন সময়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার, নির্বাচন কমিশন এবং অন্যান্য সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান জুলাই সনদের কাঠামোর আলোকে গঠন করা হবে।
খ) সংসদ দ্বিকক্ষবিশিষ্ট হবে। ১০০ সদস্যের একটি উচ্চকক্ষ গঠন করা হবে, এবং সাংবিধানিক সংশোধনের জন্য এই উচ্চকক্ষের অনুমোদন বাধ্যতামূলক হবে। জাতীয় ভোটশেয়ারের ভিত্তিতে দলগুলো উচ্চকক্ষে প্রতিনিধিত্ব পাবে।
গ) বিজয়ী দলগুলোকে জুলাই চার্টারের ৩০টি ঐকমত্য পয়েন্ট বাস্তবায়ন করতে হবে। এর মধ্যে রয়েছে—নারীর অধিক প্রতিনিধিত্ব, বিরোধী দলের নির্বাচিত ডেপুটি স্পিকার, প্রধানমন্ত্রীর পদে মেয়াদসীমা, রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা বৃদ্ধি, মৌলিক অধিকার সম্প্রসারণ, বিচার বিভাগ ও স্থানীয় সরকারের স্বাধীনতা জোরদার করা।
ঘ) রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিশ্রুত অন্যান্য সংস্কার প্রতিশ্রুতিগুলোও বাস্তবায়ন করা হবে।
