Logo
×

Follow Us

প্রচ্ছদ প্রতিবেদন

রাজনীতিতে শেখ হাসিনার উত্থান ও পতন যেভাবে

Icon

নিউজ ডেস্ক

প্রকাশ: ১৮ নভেম্বর ২০২৫, ১৭:২৭

রাজনীতিতে শেখ হাসিনার উত্থান ও পতন যেভাবে

৪৪ বছর ধরে শীর্ষ নেতৃত্বে থাকা শেখ হাসিনার সবশেষ শাসনামলে নেওয়া নানা সিদ্ধান্তের কারণেই হুমকির মুখে পড়েছে আওয়ামী লীগ। ছবি: সংগৃহীত

যে ভারতে থাকা অবস্থায় হয়েছিলেন আওয়ামী লীগের সভানেত্রী, সে ভারতে বসেই জেনেছেন দলের কার্যক্রম নিষিদ্ধ হওয়ার কথা, পেয়েছেন মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ডের সাজা। পৃথিবীর ইতিহাসে সরকার প্রধান হিসেবে 'দীর্ঘতম সময় ক্ষমতায় থাকা নারী' শেখ হাসিনা, রাজনীতিতে যার উত্থান-পতন দুই'ই ছিল নাটকীয়তায় মোড়া।

বিশ্লেষকদের মতে, প্রায় ৪৫ বছর ধরে বাংলাদেশের রাজনীতিতে 'প্রবল প্রতাপের' সাথে নিজেকে দৃশ্যমান রেখেছেন শেখ হাসিনা – কখনো আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে, কখনো বিরোধী দলীয় নেত্রী, আবার কখনো প্রধানমন্ত্রী হিসেবে।

"সাড়ে চার দশকে দেশটির রাজনীতির মাঠে অন্যতম কেন্দ্রীয় চরিত্র তিনি। বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে কথা বলতে হলে শেখ হাসিনার নামটা আসবেই," বলছিলেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ।

সমালোচকদের মতে, ৭৬ বছর বয়সী রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগে ৪৪ বছর ধরে শীর্ষ নেতৃত্বে থাকা শেখ হাসিনার সবশেষ শাসনামলে নেওয়া নানা সিদ্ধান্তের কারণেই হুমকির মুখে পড়েছে দলটি। ইতোমধ্যেই কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা আওয়ামী লীগের ওপর পুরোপুরি নিষেধাজ্ঞা আরোপের দাবিও তুলেছেন বিরোধীদের অনেকে।

ভারতে থাকা অবস্থায় আওয়ামী লীগের সভাপতি

১৯৭৫ সালের এক সামরিক অভ্যুত্থানে সপরিবারে নিহত হন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি শেখ মজিবুর রহমান। দেশের বাইরে থাকার কারণে প্রাণে বেঁচে যান তার দুই মেয়ে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা।

কোণঠাসা হয়ে পড়ে আওয়ামী লীগ। ১৯৭৬ সালে সামরিক সরকারের সময় পলিটিক্যাল পার্টিজ রেগুলেশনের (পিপিআর) আওতায় নতুন করে নিবন্ধন নিয়ে রাজনীতির মাঠে দৃশ্যমান হতে শুরু করে আওয়ামী লীগ।

তবে নেতৃত্ব নিয়ে কোন্দলে দলের মধ্যে ভাঙন দেখা দেয়। পরে দলটির নেতা আব্দুর রাজ্জাক, ড. কামাল হোসেন এবং বেগম জোহরা তাজউদ্দিনের উদ্যোগে শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে দলের হাল ধরার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

১৯৮১ সালের ফেব্রুয়ারিতে আয়োজিত এক সম্মেলনে শেখ মুজিবুর রহমানের মেয়ে শেখ হাসিনাকে দলের সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। এই ঘোষণার সময়ও শেখ হাসিনা ভারতে স্বেচ্ছানির্বাসনে ছিলেন। দলীয় নেতা হওয়ার দুই মাস পর দেশে ফেরেন শেখ হাসিনা।

"বঙ্গবন্ধুর কন্যা, এই কারণে দলের মধ্যে তার একটা সর্বজনীন গ্রহণযোগ্যতা ছিল। সেই আবেগ কাজে লাগিয়ে তাকে সভাপতি করা হয়। তারমধ্যে স্বাভাবিক কিছু গুণ ছিল নেতৃত্বের, যার ফলে সভাপতি হওয়ার পরে দলের ওপরে তিনি তার প্রভাব স্ট্যাব্লিশ (প্রতিষ্ঠিত) করতে পেরেছিলেন," বলেন মি. আহমদ।

এরশাদ সরকারের আমলে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা এবং জনসাধারণের সাথে মিশে যেতে পারার মতো দিকগুলো দলের বাইরেও তাকে গ্রহণযোগ্যতা এনে দেয় বলেও মনে করেন অনেকে।

প্রথম বিরোধী দলীয় নারী নেত্রী, গ্রেনেড হামলা ও গ্রেফতার

১৯৯১ সালের নির্বাচনি প্রচারণায় জয়ের বিষয়ে বেশ আত্মবিশ্বাসী ছিলেন শেখ হাসিনা। কিন্তু নির্বাচনে ৮৪টি আসন পেয়ে দ্বিতীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে সংসদে যান তিনি, হন দেশটির প্রথম বিরোধী দলীয় নারী নেত্রী।

১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে আয়োজিত নির্বাচনে কারপচুপির অভিযোগ এনে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলনে নামে আওয়ামী লীগ।

একই বছর জুনে আয়োজিত নির্বাচনে ১৩৩টি আসন পায় আওয়ামী লীগ। প্রথমবারের মতো প্রধানমন্ত্রী হন শেখ হাসিনা। তার সরকার পাঁচ বছরের মেয়াদ পূর্ণ করে ২০০১ সালে বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবার সংঘাতহীনভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন।

অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জোটবদ্ধ হয় বিএনপি-জামায়াত। হেরে যায় আওয়ামী লীগ। সংসদের বিরোধী দলীয় নেত্রী থাকার সময় ২০০৪ সালে আওয়ামী লীগের এক সমাবেশে গ্রেনেড হামলার শিকার হন শেখ হাসিনা। সেই হামলায় নিহত হন ২৪ জন, আর আহত হয় আরও অনেকে।

এই ঘটনার দুই বছর পর বিএনপি সরকারের মেয়াদ ফুরিয়ে এলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধানের পদ নিয়ে অনড় অবস্থান নেয় আওয়ামী লীগ। এর ফলে সৃষ্ট রাজনৈতিক সহিংসতার জের ধরে ২০০৭ সালে জারি করা হয় জরুরি অবস্থা।

সেসময় আলোচনায় আসে 'মাইনাস টু' ফর্মুলা। চাঁদাবাজির এক মামলায় দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে প্রথম এবং সেই একবারই গ্রেফতার হয়ে জেলে যান শেখ হাসিনা।

ক্ষমতায় টানা সাড়ে ১৬ বছর ও পতন

২০০৮ সালে আয়োজিত নবম জাতীয় নির্বাচনে দুই-তৃতীয়াংশ আসন নিয়ে সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ। দ্বিতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী হন শেখ হাসিনা।

তবে তার দায়িত্ব নেওয়ার কয়েক মাস পরই ঘটে যায় বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে আলোচিত একটি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা- বিডিআর বিদ্রোহ, যেখানে হত্যা করা হয় ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তাকে। ওই ঘটনায় সরকার ও তৎকালীন ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের কয়েকজন শীর্ষ নেতার ভূমিকা নিয়ে নানা বিতর্ক রয়েছে।

এরই মধ্যে আওয়ামী লীগ সরকার তাদের নির্বাচনি প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ১৯৭১ সালে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারকাজ শুরু করে। অভিযুক্তদের মধ্যে আলোচিত ছিলেন জামায়াতে ইসলামীর তৎকালীন শীর্ষ নেতারা।

২০১৩ সালের পাঁচই মে ১৩ দফা দাবিতে রাজধানীর শাপলা চত্বরে অবস্থান নিয়ে ঢাকা অবরোধ করে হেফাজতে ইসলাম। যৌথ বাহিনীর অভিযানে বলপ্রয়োগে খালি করা হয় সে এলাকা। দুইদিনব্যাপী সহিংসতায় ২৮ জনের মৃত্যুর কথা জানায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

যদিও পরবর্তীতে বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনের প্রতিবেদনে এ সংখ্যা আরো বেশি বলে উঠে এসেছে। এছাড়াও ২০১৮ সালে দমন করা হয় ছাত্রদের নিরাপদ সড়ক ও সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের আন্দোলন।

"এই সবগুলো আন্দোলনই শেখ হাসিনাকে দমন করেন তার পেটোয়া হেলমেট বাহিনী দিয়ে- যুবলীগ, ছাত্রলীগ এদের দিয়ে," বলেন মহিউদ্দিন আহমদ।

বিশ্লেষকদের মতে, ২০২৪ সালে দ্বিতীয় দফায় সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের আন্দোলনেও একই প্রক্রিয়া অনুসরণের চেষ্টা করে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার।

আন্দোলন দমনে নির্বিচারে চালানো হয় গুলি। সরকারি হিসাবে, নিহতের সংখ্যা ৮৪৪ জন। তবে পহেলা জুলাই থেকে ১৫ই অগাস্টের মধ্যে এক হাজার ৪০০ মানুষ প্রাণ হারান বলে এক প্রতিবেদনে জানায় জাতিসংঘ।

সহিংসতার মধ্যে কোটাসংস্কার আন্দোলন রূপ নেয় সরকার পতনের আন্দোলনে। পাঁচই অগাস্ট গণঅভ্যুত্থানের মুখে দেশ ছেড়ে ভারতে চলে যান শেখ হাসিনা।

মি. আহমদের দৃষ্টিতে, শেখ হাসিনা দলের সবাইকে 'বাঘের মুখে' ফেলে দিয়ে গুটিকয়েক সঙ্গী ও আত্মীয়দের দেশের বাইরে পাঠিয়ে দিয়ে নিজেকে নিরাপদ করেছেন।

তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল ও 'রাতের' ভোট

শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে সমালোচকদের সবচেয়ে বড় অভিযোগ হলো, তিনি বাংলাদেশের নির্বাচনী ব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন। আর তা করার প্রথম ধাপ ছিল – তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল।

মহিউদ্দিন আহমদ মনে করেন, শেখ হাসিনার "ক্ষমতায় থাকার চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত" করার ইচ্ছে ছিল। তিনি "অ্যাবসোল্যুট (নিরঙ্কুশ) ক্ষমতা" চাইতেন, যা শেখ হাসিনা প্রকাশ্যে বলতেন বলেও দাবি করেন এই রাজনৈতিক বিশ্লেষক।

"সেভাবে ক্ষমতা নিরঙ্কুশ করতে গেলে এই তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থাকে তিনি অনুকূল মনে করেন নাই। সুতরাং তিনি উচ্চ আদালতের ঘাড়ে বন্দুক রেখে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বাতিল করে দেন," বলেন মি. আহমদ।

তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের পর বাংলাদেশে আয়োজিত তিনটি নির্বাচন নিয়েই ছিল তুমুল সমালোচনা ও বিতর্ক।

২০১৪ সালের একতরফা নির্বাচন, ২০১৮ সালে নির্বাচনের আগের রাতেই ব্যালট পেপারে সিল মারা এবং সবশেষ ২০২৪ সালে ডামি প্রার্থী দাঁড় করিয়ে নির্বাচন করার অভিযোগ রয়েছে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে, যখন সরকার ও দলের নেতৃত্বে ছিলেন শেখ হাসিনা।

এছাড়াও বিচারবহির্ভূত গুম-খুন, বিরোধী মত ও রাজনৈতিক দলের ওপর দমনপীড়নের নানা অনেক অভিযোগ উঠেছে শেখ হাসিনাসহ সেসময়কার ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে।

একদিকে এসব বিষয়ে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে দেশটির মানুষের মধ্যে যেমন ক্ষোভ জমেছে, অন্যদিকে পদ্মা সেতু এবং মেট্রোরেলের মতো অবকাঠামোগত উন্নয়নের জন্যে অনেক প্রশংসাও পেয়েছেন তিনি। যদিও এসব প্রকল্পসহ বিভিন্ন খাতে ব্যাপক দুর্নীতিরও অভিযোগ রয়েছে তার সরকারের বিরুদ্ধে।

শেখ হাসিনার কি আবার রাজনীতিতে ফেরার সুযোগ আছে?

শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ থাকলেও সবশেষ যে মানবতাবিরোধী অপরাধে তিনি দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন, তার মৃত্যুদণ্ডের রায় দেওয়া হয়েছে, সেখান থেকে তার রাজনীতিতে ফেরার কোনো সুযোগ আছে কি না–– উঠছে এমন প্রশ্নও।

বিশ্লেষকরা বলছেন, এর উত্তর নির্ভর করবে সামনের দিনগুলোতে কারা আসবে এবং তারা কী কাজ করবে। "তারা যদি হাসিনার চেয়ে খারাপ কাজ করে বা হাসিনার মতোই করে, তাহলে হাসিনার কামব্যাক করার একটা পরিস্থিতি তৈরি হবে," বলেন মি. আহমদ।


তথ্যসূত্র: বিবিসি বাংলা

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫