বায়ুদূষণ ঘরেও, বছরে ঝরছে ১৬ হাজার শিশুর প্রাণ
আবুল বাসার সাজ্জাদ
প্রকাশ: ২২ নভেম্বর ২০২৫, ১৬:৩৫
রান্নাঘরের দূষণ কেড়ে নিচ্ছে শিশুদের প্রাণ। ছবি: এআই
রান্নার পরিবেশবান্ধব জ্বালানি ও প্রযুক্তি ব্যবহারে দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ায় সবচেয়ে পিছিয়ে থাকা বাংলাদেশে ঘরের ভেতরের পরিবেশও দূষিত হয়ে যাচ্ছে। আর রান্নাঘরের সেই দূষণ কেড়ে নিচ্ছে শিশুদের প্রাণ।
ঘরের ভেতরের এই পরিবেশ দূষণের কারণ অবশ্য শুধু রান্নাঘর নয়—ঘরের পর্দা, কার্পেট এমনকি কাপড় থেকেও ছড়াচ্ছে দূষক কণিকা।
সম্প্রতি প্রকাশিত একটি আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিবেদনে পরিবেশ দূষণের নতুন এই দিকটি উঠে এসেছে, যেখানে বলা হয়েছে—ঘরোয়া দূষণের কারণে ঘণ্টায় অন্তত গড়ে দুটি করে শিশুর মৃত্যু হচ্ছে; বছরে সংখ্যা দাঁড়ায় ১৬ হাজারের বেশি।
আন্তর্জাতিক গবেষণা গোষ্ঠী জিরো কার্বন অ্যানালিটিকস (জেডসিএ)-এর এই প্রতিবেদন প্রস্তুত করা হয়েছে ২০২১ সালে চালানো একটি গবেষণার ওপর ভিত্তি করে। গত কয়েক বছরে পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে—এমনটি বলছেন না গবেষকরা।
জেডসিএ মূলত জলবায়ু পরিবর্তন ও জ্বালানি রূপান্তর নিয়ে কাজ করে থাকে। তাদের গবেষণার শিরোনাম ছিল ‘স্ট্রাকচারাল ডিপেনডেন্সিস পারপেচুয়েট ডিসপ্রোপোরশনেট চাইল্ডহুড হেলথ বার্ডেন ফ্রম এয়ার পলিউশন’।
বায়ুদূষণ নিয়ে বরাবরই বাইরের দূষণের কথা গুরুত্ব পায়, কিন্তু তারা ঘরের ভেতরের এই দূষণকে সামনে এনেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে—বাংলাদেশে কাঠ, গোবর ও কয়লার মতো কঠিন জ্বালানি পুড়িয়ে রান্না করার ফলে ঘরের ভেতর ঘন ধোঁয়া তৈরি হয়। বিশেষ করে গর্ভবতী নারী ও নবজাতকেরা দিনের বড় অংশ ঘরে থাকায় তারা এই দূষণের সবচেয়ে বড় শিকার।
দেশের প্রধান প্রধান শহরে বাসাবাড়িতে পাইপলাইনের গ্যাস সংযোগ থাকলেও বেশির ভাগ জায়গায় তা নেই। শহরাঞ্চলে অনেকে সিলিন্ডারের গ্যাস ব্যবহার করলেও নিম্ন আয়ের মানুষ এখনো সনাতন পদ্ধতিতে রান্না করে।
তারা চুলায় আগুন ধরাতে দাহ্য যা কিছু পাওয়া যায় সেগুলোই ব্যবহার করে। এসব চুলার মান নিয়েও আছে প্রশ্ন। চুলার মানোন্নয়ন ও ধোঁয়া নিয়ন্ত্রণে নানা সময় প্রযুক্তি উদ্ভাবনের কথা বলা হলেও তা ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে দিতে পারেনি সংশ্লিষ্টরা।
বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) চেয়ারম্যান আহমেদ কামরুজ্জামান মজুমদার দেশকাল নিউজ ডটকমকে বলেন,“বাইরের বায়ু দূষণ যেমন আমাদের জন্য ক্ষতিকর, তেমনি ঘরের দূষণও ক্ষতিকর। ইনডোর দূষণের উৎসগুলোর অন্যতম হলো আমাদের রান্নাঘরের ধোঁয়া।
“আমাদের দৈনন্দিন ব্যবহার্য কাপড়চোপড়, পর্দা, কার্পেট থেকেও এই দূষণ হয়ে থাকে। বাসার ভেতরে যারা বেশি সময় কাটায়—শিশু, বয়স্ক ও অসুস্থ মানুষ—তারা বেশি আক্রান্ত হয়।”
ঘরোয়া দূষণ কীভাবে কমানো যায়—এই প্রশ্নে তিনি বলেন, “আমরা কয়েকটি পদক্ষেপ নিতে পারি। তার মধ্যে রয়েছে ন্যাচারাল এয়ার সার্কুলেশন নিশ্চিত করা, নিয়মিত পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা, দূষণকারী পেইন্ট ব্যবহার না করা এবং প্রয়োজনে কিছু এয়ার পিউরিফাইং ইনডোর প্ল্যান্ট ব্যবহার করা। এভাবে ঘরের ভেতরের বাতাসের মান উন্নত করতে পারলে ঘরোয়া দূষণজনিত মৃত্যুর হার কমে আসবে।”
এ ক্ষেত্রে সরকার কী করছে—জানতে পরিবেশ অধিদপ্তরের বায়ুমান শাখার পরিচালক জিয়াউল হকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, “গ্রামীণ এলাকায় যদি সৌরশক্তিচালিত চুলা, এলপিজি বা এলএনজি দেওয়া যায়—বায়ুদূষণ কমবে।”
সরকার বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় রান্নায় উন্নত চুলা প্রচলনের উদ্দেশ্যে একটি প্রকল্প হাতে নিচ্ছে। তবে এটি ২০২৮ সালের দিকে শুরু হবে বলে জানান তিনি।
গবেষণা প্রতিবেদনেও পরিবেশবান্ধব জ্বালানি ব্যবহারে জোর দেওয়া হয়েছে।
এতে বলা হয়েছে—রান্নায় পুরোপুরি পরিবেশবান্ধব জ্বালানির ব্যবহার নিশ্চিত হলে দেশে প্রতিবছর ১৬ হাজারের বেশি শিশুর মৃত্যু রোধ করা সম্ভব।
ফুসফুসের ক্ষতি সবচেয়ে বেশি
বায়ুদূষণের কারণে শিশুরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত—গবেষণা প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে এসেছে। বলা হয়েছে—দেশে নিউমোনিয়ায় পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের মৃত্যুর ৪০ শতাংশের বেশি জন্য দায়ী বায়ুদূষণ।
আইসিডিডিআর,বি–র নারী ও শিশু স্বাস্থ্য বিভাগের বিজ্ঞানী ও স্বাস্থ্য খাত সংস্কার কমিটির সদস্য আহমেদ এহসানুর রহমান সাম্প্রতিক দেশকালকে বলেন, “বায়ুদূষণ যে কোনো মানুষেরই ক্ষতি করে, কিন্তু শিশুদের তা তুলনামূলক বেশি। ফলে বাতাসের মান খারাপ হলে শিশুদের ফুসফুস ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এজন্য ঢাকার শিশুদের মধ্যে নিউমোনিয়া ও শ্বাসতন্ত্রে প্রদাহজনিত সংক্রমণ বেড়ে যাচ্ছে এবং অন্যান্য অসংক্রামক রোগের আশঙ্কাও বাড়ছে।”
সর্বনাশ করছে ইটভাটা
জেডসিএর প্রতিবেদনে ইটভাটার দূষণের ব্যাপকতাও উঠে এসেছে।
ঢাকার পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের ওপর ১০ বছরের একটি গবেষণার তথ্য উদ্ধৃত করে বলা হয়েছে—ইটভাটা থেকে নির্গত অতিক্ষুদ্র বস্তুকণা (পিএম ২.৫) শ্বাসতন্ত্রের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি।
বিশেষ করে যেসব দিনে বাইরের বাতাসে ইটভাটার দূষণ ছিল—সেসব দিনে শিশুদের নিউমোনিয়ার ঝুঁকি অনেক বেশি ছিল।
২০২০ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে ঢাকার হাসপাতালভিত্তিক একটি গবেষণার ফলাফলে বলা হয়—সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ গোষ্ঠীর মধ্যে রয়েছে চার বছরের কম বয়সী শিশুরা।
মোট পিএম ২.৫ জনিত শ্বাসতন্ত্রের সমস্যা নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি রোগীর ২৮ শতাংশই এই বয়সী।
এই সময় ঢাকার বাতাসে পিএম ২.৫–এর মাত্রা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মানদণ্ডের তুলনায় অনেক বেশি ছিল।
প্রতি ঘনমিটারে পিএম ২.৫ এর মাত্রা ১০ মাইক্রোগ্রাম বাড়লে ০–৪ বছর বয়সী শিশুদের শ্বাসতন্ত্রের সমস্যা (মূলত নিউমোনিয়া ও তীব্র ব্রংকাইটিস) নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি ৫.৯ শতাংশ বেড়ে যায়।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে—শিশুদের শরীরের আকার তুলনামূলক ছোট হওয়ায় তাদের শ্বাসপ্রশ্বাসে ক্ষতি বেশি হয়। শিশুরা সাধারণত মুখ দিয়ে শ্বাস নেয়, ফলে বাতাস পর্যাপ্তভাবে পরিশোধিত হয় না।
দীর্ঘদিন দূষিত বাতাস শ্বাস নিলে তাদের ফুসফুস ছোট হতে থাকে।
ক্ষতি হয়ে যায় গর্ভকালেই
গর্ভকালীন ও শৈশবে দূষিত বাতাসের সংস্পর্শে আসা শিশুর আচরণ, জ্ঞানক্ষমতা ও মস্তিষ্কের বিকাশেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে বলে গবেষণায় উল্লেখ করা হয়েছে।
বাইরের বায়ুদূষণ মাত্র ২০ শতাংশ কমানো গেলে শিশুদের স্মরণশক্তি ৬ শতাংশের বেশি বাড়তে পারে বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
গবেষণা অনুযায়ী—শিশুদের জীবনের জন্য যত ঝুঁকি রয়েছে, তার মধ্যে বায়ুদূষণ দ্বিতীয় সবচেয়ে প্রাণঘাতী।
২০২১ সালে বিশ্বজুড়ে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের মৃত্যুর ১৫ শতাংশের জন্য দায়ী ছিল বায়ুদূষণ।
পরিবেশ অধিদপ্তরের বায়ুমান শাখার পরিচালক জিয়াউল হক সাম্প্রতিক দেশকালকে বলেন,“শুষ্ক মৌসুমে দূষণ বেড়ে যায়। এজন্য আমরা প্রচার করছি—বৃদ্ধরা কী করবেন, শিশুদের জন্য কী সতর্কতা নেওয়া উচিত। জাতীয় দৈনিকগুলোতে গণবিজ্ঞপ্তিও দেওয়া হয়েছে।”
