ভূমিকম্পে ফাটল ধরা ভবনগুলোর ঝুঁকি কতটা গুরুতর
তানিয়া আক্তার ও আবুল বাসার সাজ্জাদ
প্রকাশ: ২৩ নভেম্বর ২০২৫, ১৫:১৯
শুক্রবার সকাল ১০টা ৩৮ মিনিটে ৫.৭ মাত্রার ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে। এর প্রভাবে রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে বেশ কিছু ভবনে ফাটল দেখা দিয়েছে।
ভূমিকম্পের পর থেকে যেসব আবাসিক ও বাণিজ্যিক ভবনে ফাটল দেখা দিয়েছে, সেগুলো নিয়ে সরকারি বা বেসরকারি পর্যায়ে এখন পর্যন্ত কোনো সিদ্ধান্ত আসেনি, যদিও এ ক্ষেত্রে অবহেলা প্রাণঘাতি হতে পারে বলে আশঙ্কার যথেষ্ট কারণ আছে। ঢাকার বাইরে হেলে পড়া একটি ভবন উপজেলা প্রশাসনের তৎপরতায় মালিকপক্ষই ভেঙে ফেলার উদ্যোগ নিলেও রাজধানীতে হেলে পড়া ভবন নিয়ে এমন কোনো সিদ্ধান্ত আসেনি।
ঢাকায় ফায়ার সার্ভিস ছাড়াও রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ সীমিত পরিসরে বিভিন্ন ভবন পরিদর্শনে যাচ্ছে, দেখছে ভবনের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কতটুকু। তবে ঢাকার বাইরে সরকারি সংস্থার তৎপরতা অতটা নেই। এর মধ্যে রবিবার ঢাকার বেশ কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সতর্কতামূলক ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক রাকিব আহসান সাম্প্রতিক দেশকালকে বলেন, “ভবনে ফাটলের গুরত্ব বোঝার জন্যও একজন দক্ষ প্রকৌশলীকে দেখানো ছাড়া বিকল্প নেই। তাই কোনো ধরনের ফাটল দেখা দিলেই প্রকৌশলীর পরামর্শ নেওয়া উচিত।”
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সভাপতি পরিকল্পনাবিদ আদিল মুহাম্মদ খান বলেছেন, “সরকারি সংস্থাগুলোর এগিয়ে আসা প্রয়োজন। ভবনমালিকদেরও দায়িত্ব রয়েছে। অনেক সময় দেখা যায়, মালিকরা ফাটল ঢেকে রাখার চেষ্টা করেন, প্লাস্টার করে লুকিয়ে ফেলেন। এতে সমস্যা কমে না, বরং ঝুঁকি বাড়ে।” ২০১৩ সালে সাভারের রানা প্লাজায় ফাটল ধরা পড়ার পর মালিকপক্ষ বা সেখানে থাকা তৈরি পোশাক কারখানার মালিকরা গা করেনি। ঝুঁকিপূর্ণ ভবনেই কাজ চালিয়ে যায় শ্রমিকরা। ভবনটি যখন ধসে পড়েছে, সে সময় এতে কাজ করছিল কয়েক হাজার পোশাক শ্রমিক, যাদের মধ্যে সরকারি হিসাবে ১,১৭৫ জন মারা গেছে।
নিখোঁজ আছে আরও অনেকে। গত শুক্রবারের ৫.৭ মাত্রার ভূমিকম্পের পর ছোট ছোট আরও অন্তত তিনটি ভূকম্পন অনুভূত হয়েছে, যেগুলো দেশবাসীকে আতঙ্কিত করছে। এই ভূমিকম্পে সারাদেশে অন্তত ১০ জনের মৃত্যুর নিশ্চিত তথ্য পাওয়া যায়, যার মধ্যে সবচেয়ে প্রাণঘাতি ঘটনাটি ছিল পুরান ঢাকার বংশাল থানার কেপি ঘোষ স্ট্রিটে। সেখানে একটি পাঁচ তলা ভবনের রেলিং ভেঙে তিন জনের মৃত্যু হয়। এর বাইরে অনেকগুলো ভবসের হেলে পড়া, ফাটল ধরা বা পলেস্তরা খসে পড়ার খবর পাওয়া গেছে। কিন্তু সেগুলোর বিষয়ে গুরুত্ব দিয়ে কোনো পদক্ষেপ চোখে পড়েনি।
ফায়ার সার্ভিসের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ করে দেশকাল নিউজ ডটকমকে বলেন, “যে ভবনগুলোতে বড় ফাটল দেখা গেছে, সেগুলোতে এখনই প্রবেশ না করাই ভালো। আফটারশকে দুর্বল ভবন বিপজ্জনক হয়ে ওঠে।” ঢাকার নিউ মার্কেট থানা ভবনের তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম তলায় ফাটল ধরেছে। ওসি এ কে এম মাহফুজুল হক সাম্প্রতিক দেশকালকে বলেন, “ফাটলের বিষয়ে আমরা ডিএমপি সদর দপ্তরে জানিয়েছিলাম। সঙ্গে সঙ্গে আমাদের বিভাগের ডিসি স্যার, এডিসি স্যারসহ সকল ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা এসে ভিজিট করেছেন। ডিএমপি সদরদপ্তর থেকেও কর্মকর্তারা থানায় এসেছিলেন। আগামীকাল ডিএমপির পক্ষ থেকে থানা মেরামতে প্লাস্টারসহ সকল ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।” ধানমন্ডি ও বাড্ডার একাধিক এলাকায় ভবনে ফাটল ধরার ছবি প্রকাশ পেয়েছে। বেশ কিছু ভবনের পলেস্তরা খসে পড়েছে। পুরান ঢাকার আরমানিটোলার কসাইটুলিতেও একটি বহুতল ভবনে পলেস্তরা খসে পড়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছেলেদের একাধিক হলে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। হাজী মুহম্মদ মুহসিন হল, কবি জসীমউদ্দিন হল, স্যার এ এফ রহমান, মোকাররম ভবন, শেখ ফজলুল হলসহ বেশ কয়েকটি জায়গায় পলেস্তরা খসে পড়েছে। সার্জেন্ট জহুরুল হক হলে বেশ কিছু ফাটল দেখা দেওয়ায় শিক্ষার্থীদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়েছে। হল সংসদের সমাজসেবা সম্পাদক মো. জহির রায়হান সাম্প্রতিক দেশকালকে বলেন, “হলগুলোর গঠনগত দুর্বলতা এখনই চিহ্নিত করে ব্যবস্থা না নিলে যেকোনো সময় বড় ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটতে পারে।” তিনি দ্রুত সময়ের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৮টি হলের সবগুলো এবং ক্যাম্পাসের প্রতিটি ভবনের অবস্থা পরীক্ষা নিরীক্ষার দাবি জানিয়েছেন। তবে এখন পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন হলগুলো পরীক্ষা নিরীক্ষার কোনো উদ্যোগ নেয়নি। উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) সায়মা হক বিদিশার সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, “সব কিছু পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা আমাদের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এসব সমস্যা সমাধানে কাজ করছে।” বিশেষজ্ঞরা বহু বছর ধরেই সতর্ক করে আসছিলেন যে, বাংলাদেশের ভূ-অভ্যন্তরে উচ্চ ক্ষমতার শক্তি সঞ্চয় হচ্ছে, সেটি যে কোনো সময় মাটি ফুঁড়ে বেরিয়ে আসবে।
আবার মাটির নিচে ভারতীয় ও বার্মিজ টেকটোনিক প্লেটের সংঘর্ষ হতে পারে বলেও ভূতত্ত্ববিদরা মত প্রকাশ করেছেন। এই ভূমিকম্পটি চিটাগং-সিলেট অঞ্চলের ফোল্ট লাইনের সঙ্গে সম্পর্কিত হতে পারে। এরপর শনিবার তিন দফা ছোট ছোট ভূমিকম্প হয়েছে, যা শুক্রবারের কম্পনের আফটারশক হতে পারে। এই ধরনের কম্পনের কারণে ফাটল ধরা ভবনগুলো নিয়ে আরও বেশি নজরদারি প্রয়োজন বলে মত দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। কোন ধরনের ফাটল বেশি ঝুঁকিপূর্ণ বুয়েটের অধ্যাপক রাকিব আহসান সাম্প্রতিক দেশকালকে বলেছেন, সব ধরনের ফাটল সমান গুরুত্বের নয়; তবে কলামে ফাটল সবচেয়ে মারাত্মক। “কলাম মানেই ভবনের লম্বালম্বি যে অংশগুলো ওজন বহন করে—যেগুলোকে আমরা পিলারও বলি। এই কলামের কংক্রিটে যদি ফাটল দেখা যায়, তাহলে ঝুঁকি অত্যন্ত বেশি।” অনেক সময় প্লাস্টারের উপরিভাগে ফাটল থাকে, কিন্তু কংক্রিটে থাকে না। এমন হলে ঝুঁকির তেমন কিছু নেই। তবে যদি মূল কংক্রিটে, বিশেষত কলামে, ফাটল ধরে, তাহলে তা অত্যন্ত বিপজ্জনক। এমনটি দেখা গেলে অবিলম্বে বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী দিয়ে পরীক্ষা করানো প্রয়োজন। বিম বা স্ল্যাবে ফাটল হলে তা সবসময় মারাত্মক নাও হতে পারে।
তবে যদি ভবনের ভিত্তি বা ফাউন্ডেশনে সমস্যা থাকে, সেখান থেকেও দেয়ালে ফাটল দেখা দিতে পারে, যা গুরুতর। “আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো—অনেক ভবন আছে যেগুলো প্রধানত ইট দিয়ে তৈরি, যেখানে যথেষ্ট কংক্রিটের কলাম নেই, এমন ভবনগুলো খুব ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ, এগুলোর পুরো ওজনই ইটের দেয়ালের উপর পড়ে। বিপরীতে যেসব ভবন কংক্রিটের কাঠামো দিয়ে তৈরি, সেখানে ফাটল ধরলেও অনেক সময় ঝুঁকি তুলনামূলক কম হতে পারে।” পরিকল্পনাবিদ আদিল মোহাম্মদ খান বলেন, “ফাটল মানে সম্ভাব্য বিপদের একটি ইঙ্গিত। এটা গুরুত্বের সঙ্গে দেখা উচিত।
যদি প্রয়োজন হয়, ফিটিংস মেরামত বা ভবন শক্তিশালী করার কাজ করা সম্ভব। তবে কোথাও যদি বড় ফাটল থাকে, বিশেষ করে ফাউন্ডেশন বা প্রধান কলামে, তাহলে করণীয় নির্ধারণ করবেন প্রকৌশলীরা। এখন সবচেয়ে জরুরি হচ্ছে, এসব ভবনে এসে যথাযথ মূল্যায়ন করা। এজন্য সিটি করপোরেশন, রাজউক ও ভবন-সম্পর্কিত অন্যান্য সংস্থাকে সক্রিয় হতে হবে।”
ফাটল দেখা দিলেই ভবন ছাড়তে হবে? অধ্যাপক রাকিব আহসান বলেন, “ভবনগুলো অবশ্যই স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ারদের দেখাতে হবে। যদি তারা পর্যালোচনা করে বলেন যে ফাটল ততটা ঝুঁকিপূর্ণ নয় এবং সেখানে থাকা নিরাপদ, তাহলে তাদের পরামর্শ অনুযায়ী মেরামত করে ভবনে থাকা যেতে পারে।” পরিকল্পনাবিদ আদিল মুহাম্মদ খান দেশকাল নিউজ ডটকমকে বলেন, “প্রথমেই ভিজ্যুয়াল ইনস্পেকশন প্রয়োজন। অর্থাৎ ফাটলের ধরন, আকার, অবস্থান দেখা। যদি মনে হয় ফাটলটি উদ্বেগজনক, তাহলে ডিটেইল ইনস্পেকশন দরকার। “এক জায়গায় নাকি একাধিক জায়গায় ফাটল হয়েছে কিংবা কোন কোন স্থানে হয়েছে-এসব নির্ণয় করতে হবে।
বিস্তারিত ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যাসেসমেন্টের মাধ্যমেই বোঝা যাবে ভবনটি অতি ঝুঁকিপূর্ণ, আপাত ঝুঁকিমুক্ত, নাকি মাঝামাঝি অবস্থায় আছে।” সরকার কী ভাবছে রাজউকের চেয়ারম্যান মো. রিয়াজুল ইসলাম জানিয়েছেন, ভূমিকম্পে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত বাড়িগুলো সিলগালা করে দেওয়া হবে, যারা থাকে তাদেরকে এক-দুই দিন সময় দেওয়া হবে বাড়ি ছাড়ার জন্য। তবে যেসব ভবন ফেটে গেছে, তার সবগুলোই ঝুঁকিপূর্ণ এমন সিদ্ধান্তে আগেভাগে আসতে চান না তিনি। বলেন, “অনেক সময় কিছু ভবন দেখে হয়ত মনে হয় ফেটে গেছে। কিন্তু হয়ত প্লাস্টার ফেটেছে, আরেকটায় হয়ত ইটের গাঁথুনি ফাটছে, আরেকটায় হয়ত কংক্রিট ফেটেছে। কোনোটাকে রেকটিফিকেশন করা যাবে, কোনটা যাবে না।
যেটাকে করা যাবে, সেগুলো কীভাবে হবে—এগুলো আমরা এখন অগ্রাধিকার দিয়ে কাজ করব।” রাজধানীর ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকায় ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলো চিহ্নিত করে সেগুলো নিয়ে কাজ করার কথা জানিয়েছেন করপোরেশনের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী রাজিব খাদেম। তবে ঠিক কতগুলো ভবন এখন পর্যন্ত চিহ্নিত হয়েছে এ বিষয়ে কোনো তথ্য দিতে পারেননি তিনি। ঢাকার বাসিন্দাদের একটি বড় অংশ ভাড়াটিয়া, যাদের ভবনের ফাটলের বিষয়ে বাড়িওয়ালাদের সঙ্গে বিবাদে যাওয়ার সুযোগ থাকে না।
এই ধরনের মানুষদের কথা ভেবে সরকারের পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন বলেও মনে করেন আদিল মোহাম্মদ। বলেন, “সিটি করপোরেশন বা রাজউকের জন্য হটলাইন থাকা প্রয়োজন, যাতে ভাড়াটিয়ারা সরাসরি জানাতে পারেন কোন ভবনে ফাটল দেখা গেছে।” মেট্রোরেলের কি ক্ষতি হয়েছে? শুক্রবার ভূমিকম্পের পরেই দেশের বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশ হয় যে, মেট্রোরেলের বেশ কিছু স্টেশনে ফাটল ধরেছে। এ নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে উদ্বেগ-উৎকন্ঠা ছড়িয়েছে।
তবে মেট্রোরেল পরিচালনাকারী কর্তৃপক্ষ ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল) এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফারুক আহমেদ জানিয়েছেন, এখন পর্যন্ত বড় ধরনের কোনো ক্ষতির তথ্য পাওয়া যায়নি। “ভূমিকম্পের পর মেট্রোরেল স্থাপনায় কোনো ক্ষতি হয়েছে কি না, তা খতিয়ে দেখতে অনুসন্ধান চলছে,” বলেন তিনি।
শনিবার মেট্রোরেল চলাচল স্বাভাবিক ছিল। আরও বড় ভূমিকম্পের আশঙ্কা? শুক্রবারের ৫.৭ মাত্রার ভূমিকম্পকে ‘ফোর শক’ বলে অভিহিত করেছেন অগ্নি ও দুর্যোগ বিশেষজ্ঞ এ কে এম শাকিল নেওয়াজ। তিনি বলেছেন, “এটি জাস্ট ধাক্কা দিয়েছে, আর মেইন শক বাকি আছে। তারপর আফটার শক হবে।” ২০১০ থেকে ৭০০ টির মতো ছোটখাটো ভূমিকম্প হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, “ঢাকার এত কাছাকাছি এত বড় ভূমিকম্প হবে এটা আশা করিনি আমরা।
এটার সবচেয়ে ভয়ংকর ব্যাপার হচ্ছে মাটির খুব কম নিচে এই ভূমিকম্পটা হয়েছে। ৫.৭ মাত্রায় এই অবস্থা হলো, যদি ৮ মাত্রায় হয় তাহলে কী হবে? আমরা কি মেইন শকের জন্য প্রস্তুত আছি?” ঢাকা বা দেশের অন্যান্য শহরে বাড়ি নির্মাণের সময় ভূমিকম্পের সম্ভাব্য ক্ষতির দিকটি মাথায় নেওয়া হয়নি—এটি বিশেষজ্ঞরা বারবার বলে আসছেন। তাহলে এখন কী করা উচিত—এই প্রশ্নে শাকিল নেওয়াজ বলেন, “ঢাকার যে ভবনগুলো আছে, এগুলোতে রাজউক বা অন্যান্য সংস্থার মাধ্যমে জরিপ করতে হবে যে এগুলো ৮ মাত্রার ভূমিকম্প সহনশীল কিনা।”
শক্তিশালী ভূমিকম্পের আগাম সতর্কতা দিয়েছেন বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের ভূমিকম্প পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রুবাইয়াত কবির। দেশকাল নিউজ ডটকমকে তিনি বলেছেন, “ঐতিহাসিকভাবে এ অঞ্চলে একাধিক বড় ভূমিকম্প সংঘটিত হয়েছে, যা প্রমাণ করে এটি ভূমিকম্প ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা।” আফটারশকে ক্ষতিগ্রস্ত ভবনে ঝুঁকি রয়েছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, “অবশ্যই ক্ষতি রয়েছে। এখন যদি ৫.৬ মাত্রারও ভূমিকম্প হয়, তাহলেও অনেক ভবনে মারাত্মক ঝুঁকি হতে পারে।”
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের অবসরপ্রাপ্ত মহাপরিচালক আলী আহমেদ খানকে প্রশ্ন করা হয়, রাজধানীর মতো ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় ফায়ার সার্ভিসের উদ্ধার সক্ষমতা যথেষ্ট কিনা। জবাবে তিনি ‘না’ সূচক উত্তর দিয়ে বলেন, “বিদেশে ফায়ার ডিপার্টমেন্টের গাড়ি চলাচলের জন্য আলাদা রাস্তা থাকে, তবে আমাদের দেশে নেই। ঘনবসতি এলাকায় এমনও জায়গা আছে যেখানে গাড়ি যেতেই পারবে না।
এটা অনিরাপদ শহর। যাওয়ার রাস্তা না থাকলে তারা কীভাবে সক্ষমতা দেখাবে?” ধামরাইয়ে ভাঙা হচ্ছে হেলে পড়া ভবন, ঢাকারগুলো কী হবে? ঢাকার ধামরাই উপজেলায় হেলে পড়া একটি চারতলা ভবন ইতিমধ্যেই ভেঙে ফেলার কাজ শুরু হয়েছে। শুক্রবার পাশের একটি ছয়তলা ভবনের ওপর এটি হেলে পড়েছিল। ধামরাই পৌরসভার ঢুলিভিটা এলাকায় গড়ে ওঠা ধানসিঁড়ি হাউজিং প্রকল্পের ভেতরে বাড়িটির অবস্থান। উপজেলা প্রশাসনের নির্দেশনায় ভাঙার কাজ শুরু করেছেন ভবনটির মালিক নিজেই।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) মামনুন আহমেদ অনীক বলেন, “এ ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ ভবন নিয়ে অবশ্যই আমরা দায়িত্বশীল থাকব।” ঢাকার সূত্রাপুর ও কলাবাগানে দুটি ভবন হেলে পড়ার খবর পাওয়া গেছে। তবে এই দুটি ভবন নিয়ে এখন পর্যন্ত চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।
ভূমিকম্পের পর থেকে যেসব আবাসিক ও বাণিজ্যিক ভবনে ফাটল দেখা দিয়েছে, সেগুলো নিয়ে সরকারি বা বেসরকারি পর্যায়ে এখন পর্যন্ত কোনো সিদ্ধান্ত আসেনি, যদিও এ ক্ষেত্রে অবহেলা প্রাণঘাতি হতে পারে বলে আশঙ্কার যথেষ্ট কারণ আছে।
ঢাকার বাইরে হেলে পড়া একটি ভবন উপজেলা প্রশাসনের তৎপরতায় মালিকপক্ষই ভেঙে ফেলার উদ্যোগ নিলেও রাজধানীতে হেলে পড়া ভবন নিয়ে এমন কোনো সিদ্ধান্ত আসেনি।
ঢাকায় ফায়ার সার্ভিস ছাড়াও রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ সীমিত পরিসরে বিভিন্ন ভবন পরিদর্শনে যাচ্ছে, দেখছে ভবনের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কতটুকু। তবে ঢাকার বাইরে সরকারি সংস্থার তৎপরতা অতটা নেই।
এর মধ্যে রবিবার ঢাকার বেশ কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সতর্কতামূলক ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক রাকিব আহসান সাম্প্রতিক দেশকালকে বলেন,“ভবনে ফাটলের গুরত্ব বোঝার জন্যও একজন দক্ষ প্রকৌশলীকে দেখানো ছাড়া বিকল্প নেই। তাই কোনো ধরনের ফাটল দেখা দিলেই প্রকৌশলীর পরামর্শ নেওয়া উচিত।”
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সভাপতি পরিকল্পনাবিদ আদিল মুহাম্মদ খান বলেছেন, “সরকারি সংস্থাগুলোর এগিয়ে আসা প্রয়োজন। ভবনমালিকদেরও দায়িত্ব রয়েছে। অনেক সময় দেখা যায়, মালিকরা ফাটল ঢেকে রাখার চেষ্টা করেন, প্লাস্টার করে লুকিয়ে ফেলেন। এতে সমস্যা কমে না, বরং ঝুঁকি বাড়ে।”
২০১৩ সালে সাভারের রানা প্লাজায় ফাটল ধরা পড়ার পর মালিকপক্ষ বা সেখানে থাকা তৈরি পোশাক কারখানার মালিকরা গা করেনি। ঝুঁকিপূর্ণ ভবনেই কাজ চালিয়ে যায় শ্রমিকরা। ভবনটি যখন ধসে পড়েছে, সে সময় এতে কাজ করছিল কয়েক হাজার পোশাক শ্রমিক, যাদের মধ্যে সরকারি হিসাবে ১,১৭৫ জন মারা গেছে। নিখোঁজ আছে আরও অনেকে।
গত শুক্রবারের ৫.৭ মাত্রার ভূমিকম্পের পর ছোট ছোট আরও অন্তত তিনটি ভূকম্পন অনুভূত হয়েছে, যেগুলো দেশবাসীকে আতঙ্কিত করছে।
এই ভূমিকম্পে সারাদেশে অন্তত ১০ জনের মৃত্যুর নিশ্চিত তথ্য পাওয়া যায়, যার মধ্যে সবচেয়ে প্রাণঘাতি ঘটনাটি ছিল পুরান ঢাকার বংশাল থানার কেপি ঘোষ স্ট্রিটে। সেখানে একটি পাঁচ তলা ভবনের রেলিং ভেঙে তিন জনের মৃত্যু হয়।
এর বাইরে অনেকগুলো ভবসের হেলে পড়া, ফাটল ধরা বা পলেস্তরা খসে পড়ার খবর পাওয়া গেছে। কিন্তু সেগুলোর বিষয়ে গুরুত্ব দিয়ে কোনো পদক্ষেপ চোখে পড়েনি।
ফায়ার সার্ভিসের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ করে দেশকাল নিউজ ডটকমকে বলেন, “যে ভবনগুলোতে বড় ফাটল দেখা গেছে, সেগুলোতে এখনই প্রবেশ না করাই ভালো। আফটারশকে দুর্বল ভবন বিপজ্জনক হয়ে ওঠে।”
ঢাকার নিউ মার্কেট থানা ভবনের তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম তলায় ফাটল ধরেছে। ওসি এ কে এম মাহফুজুল হক সাম্প্রতিক দেশকালকে বলেন, “ফাটলের বিষয়ে আমরা ডিএমপি সদর দপ্তরে জানিয়েছিলাম। সঙ্গে সঙ্গে আমাদের বিভাগের ডিসি স্যার, এডিসি স্যারসহ সকল ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা এসে ভিজিট করেছেন। ডিএমপি সদরদপ্তর থেকেও কর্মকর্তারা থানায় এসেছিলেন। আগামীকাল ডিএমপির পক্ষ থেকে থানা মেরামতে প্লাস্টারসহ সকল ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।”
ধানমন্ডি ও বাড্ডার একাধিক এলাকায় ভবনে ফাটল ধরার ছবি প্রকাশ পেয়েছে। বেশ কিছু ভবনের পলেস্তরা খসে পড়েছে। পুরান ঢাকার আরমানিটোলার কসাইটুলিতেও একটি বহুতল ভবনে পলেস্তরা খসে পড়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছেলেদের একাধিক হলে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। হাজী মুহম্মদ মুহসিন হল, কবি জসীমউদ্দিন হল, স্যার এ এফ রহমান, মোকাররম ভবন, শেখ ফজলুল হলসহ বেশ কয়েকটি জায়গায় পলেস্তরা খসে পড়েছে।
সার্জেন্ট জহুরুল হক হলে বেশ কিছু ফাটল দেখা দেওয়ায় শিক্ষার্থীদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়েছে। হল সংসদের সমাজসেবা সম্পাদক মো. জহির রায়হান সাম্প্রতিক দেশকালকে বলেন, “হলগুলোর গঠনগত দুর্বলতা এখনই চিহ্নিত করে ব্যবস্থা না নিলে যেকোনো সময় বড় ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটতে পারে।”
তিনি দ্রুত সময়ের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৮টি হলের সবগুলো এবং ক্যাম্পাসের প্রতিটি ভবনের অবস্থা পরীক্ষা নিরীক্ষার দাবি জানিয়েছেন।
তবে এখন পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন হলগুলো পরীক্ষা নিরীক্ষার কোনো উদ্যোগ নেয়নি।
উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) সায়মা হক বিদিশার সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, “সব কিছু পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা আমাদের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এসব সমস্যা সমাধানে কাজ করছে।”
বিশেষজ্ঞরা বহু বছর ধরেই সতর্ক করে আসছিলেন যে, বাংলাদেশের ভূ-অভ্যন্তরে উচ্চ ক্ষমতার শক্তি সঞ্চয় হচ্ছে, সেটি যে কোনো সময় মাটি ফুঁড়ে বেরিয়ে আসবে। আবার মাটির নিচে ভারতীয় ও বার্মিজ টেকটোনিক প্লেটের সংঘর্ষ হতে পারে বলেও ভূতত্ত্ববিদরা মত প্রকাশ করেছেন। এই ভূমিকম্পটি চিটাগং-সিলেট অঞ্চলের ফোল্ট লাইনের সঙ্গে সম্পর্কিত হতে পারে।
এরপর শনিবার তিন দফা ছোট ছোট ভূমিকম্প হয়েছে, যা শুক্রবারের কম্পনের আফটারশক হতে পারে। এই ধরনের কম্পনের কারণে ফাটল ধরা ভবনগুলো নিয়ে আরও বেশি নজরদারি প্রয়োজন বলে মত দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।
কোন ধরনের ফাটল বেশি ঝুঁকিপূর্ণ
বুয়েটের অধ্যাপক রাকিব আহসান সাম্প্রতিক দেশকালকে বলেছেন, সব ধরনের ফাটল সমান গুরুত্বের নয়; তবে কলামে ফাটল সবচেয়ে মারাত্মক।
“কলাম মানেই ভবনের লম্বালম্বি যে অংশগুলো ওজন বহন করে—যেগুলোকে আমরা পিলারও বলি। এই কলামের কংক্রিটে যদি ফাটল দেখা যায়, তাহলে ঝুঁকি অত্যন্ত বেশি।”
অনেক সময় প্লাস্টারের উপরিভাগে ফাটল থাকে, কিন্তু কংক্রিটে থাকে না। এমন হলে ঝুঁকির তেমন কিছু নেই। তবে যদি মূল কংক্রিটে, বিশেষত কলামে, ফাটল ধরে, তাহলে তা অত্যন্ত বিপজ্জনক। এমনটি দেখা গেলে অবিলম্বে বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী দিয়ে পরীক্ষা করানো প্রয়োজন।
বিম বা স্ল্যাবে ফাটল হলে তা সবসময় মারাত্মক নাও হতে পারে। তবে যদি ভবনের ভিত্তি বা ফাউন্ডেশনে সমস্যা থাকে, সেখান থেকেও দেয়ালে ফাটল দেখা দিতে পারে, যা গুরুতর।
“আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো—অনেক ভবন আছে যেগুলো প্রধানত ইট দিয়ে তৈরি, যেখানে যথেষ্ট কংক্রিটের কলাম নেই, এমন ভবনগুলো খুব ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ, এগুলোর পুরো ওজনই ইটের দেয়ালের উপর পড়ে। বিপরীতে যেসব ভবন কংক্রিটের কাঠামো দিয়ে তৈরি, সেখানে ফাটল ধরলেও অনেক সময় ঝুঁকি তুলনামূলক কম হতে পারে।”
পরিকল্পনাবিদ আদিল মোহাম্মদ খান বলেন, “ফাটল মানে সম্ভাব্য বিপদের একটি ইঙ্গিত। এটা গুরুত্বের সঙ্গে দেখা উচিত। যদি প্রয়োজন হয়, ফিটিংস মেরামত বা ভবন শক্তিশালী করার কাজ করা সম্ভব। তবে কোথাও যদি বড় ফাটল থাকে, বিশেষ করে ফাউন্ডেশন বা প্রধান কলামে, তাহলে করণীয় নির্ধারণ করবেন প্রকৌশলীরা। এখন সবচেয়ে জরুরি হচ্ছে, এসব ভবনে এসে যথাযথ মূল্যায়ন করা। এজন্য সিটি করপোরেশন, রাজউক ও ভবন-সম্পর্কিত অন্যান্য সংস্থাকে সক্রিয় হতে হবে।”
ফাটল দেখা দিলেই ভবন ছাড়তে হবে?
অধ্যাপক রাকিব আহসান বলেন, “ভবনগুলো অবশ্যই স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ারদের দেখাতে হবে। যদি তারা পর্যালোচনা করে বলেন যে ফাটল ততটা ঝুঁকিপূর্ণ নয় এবং সেখানে থাকা নিরাপদ, তাহলে তাদের পরামর্শ অনুযায়ী মেরামত করে ভবনে থাকা যেতে পারে।”
পরিকল্পনাবিদ আদিল মুহাম্মদ খান দেশকাল নিউজ ডটকমকে বলেন, “প্রথমেই ভিজ্যুয়াল ইনস্পেকশন প্রয়োজন। অর্থাৎ ফাটলের ধরন, আকার, অবস্থান দেখা। যদি মনে হয় ফাটলটি উদ্বেগজনক, তাহলে ডিটেইল ইনস্পেকশন দরকার।
“এক জায়গায় নাকি একাধিক জায়গায় ফাটল হয়েছে কিংবা কোন কোন স্থানে হয়েছে-এসব নির্ণয় করতে হবে। বিস্তারিত ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যাসেসমেন্টের মাধ্যমেই বোঝা যাবে ভবনটি অতি ঝুঁকিপূর্ণ, আপাত ঝুঁকিমুক্ত, নাকি মাঝামাঝি অবস্থায় আছে।”
সরকার কী ভাবছে
রাজউকের চেয়ারম্যান মো. রিয়াজুল ইসলাম জানিয়েছেন, ভূমিকম্পে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত বাড়িগুলো সিলগালা করে দেওয়া হবে, যারা থাকে তাদেরকে এক-দুই দিন সময় দেওয়া হবে বাড়ি ছাড়ার জন্য।
তবে যেসব ভবন ফেটে গেছে, তার সবগুলোই ঝুঁকিপূর্ণ এমন সিদ্ধান্তে আগেভাগে আসতে চান না তিনি। বলেন, “অনেক সময় কিছু ভবন দেখে হয়ত মনে হয় ফেটে গেছে। কিন্তু হয়ত প্লাস্টার ফেটেছে, আরেকটায় হয়ত ইটের গাঁথুনি ফাটছে, আরেকটায় হয়ত কংক্রিট ফেটেছে। কোনোটাকে রেকটিফিকেশন করা যাবে, কোনটা যাবে না। যেটাকে করা যাবে, সেগুলো কীভাবে হবে—এগুলো আমরা এখন অগ্রাধিকার দিয়ে কাজ করব।”
রাজধানীর ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকায় ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলো চিহ্নিত করে সেগুলো নিয়ে কাজ করার কথা জানিয়েছেন করপোরেশনের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী রাজিব খাদেম।
তবে ঠিক কতগুলো ভবন এখন পর্যন্ত চিহ্নিত হয়েছে এ বিষয়ে কোনো তথ্য দিতে পারেননি তিনি।
ঢাকার বাসিন্দাদের একটি বড় অংশ ভাড়াটিয়া, যাদের ভবনের ফাটলের বিষয়ে বাড়িওয়ালাদের সঙ্গে বিবাদে যাওয়ার সুযোগ থাকে না।
এই ধরনের মানুষদের কথা ভেবে সরকারের পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন বলেও মনে করেন আদিল মোহাম্মদ। বলেন, “সিটি করপোরেশন বা রাজউকের জন্য হটলাইন থাকা প্রয়োজন, যাতে ভাড়াটিয়ারা সরাসরি জানাতে পারেন কোন ভবনে ফাটল দেখা গেছে।”
মেট্রোরেলের কি ক্ষতি হয়েছে?
শুক্রবার ভূমিকম্পের পরেই দেশের বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশ হয় যে, মেট্রোরেলের বেশ কিছু স্টেশনে ফাটল ধরেছে। এ নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে উদ্বেগ-উৎকন্ঠা ছড়িয়েছে।
তবে মেট্রোরেল পরিচালনাকারী কর্তৃপক্ষ ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল) এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফারুক আহমেদ জানিয়েছেন, এখন পর্যন্ত বড় ধরনের কোনো ক্ষতির তথ্য পাওয়া যায়নি।
“ভূমিকম্পের পর মেট্রোরেল স্থাপনায় কোনো ক্ষতি হয়েছে কি না, তা খতিয়ে দেখতে অনুসন্ধান চলছে,” বলেন তিনি। শনিবার মেট্রোরেল চলাচল স্বাভাবিক ছিল।
আরও বড় ভূমিকম্পের আশঙ্কা?
শুক্রবারের ৫.৭ মাত্রার ভূমিকম্পকে ‘ফোর শক’ বলে অভিহিত করেছেন অগ্নি ও দুর্যোগ বিশেষজ্ঞ এ কে এম শাকিল নেওয়াজ। তিনি বলেছেন, “এটি জাস্ট ধাক্কা দিয়েছে, আর মেইন শক বাকি আছে। তারপর আফটার শক হবে।”
২০১০ থেকে ৭০০ টির মতো ছোটখাটো ভূমিকম্প হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, “ঢাকার এত কাছাকাছি এত বড় ভূমিকম্প হবে এটা আশা করিনি আমরা। এটার সবচেয়ে ভয়ংকর ব্যাপার হচ্ছে মাটির খুব কম নিচে এই ভূমিকম্পটা হয়েছে। ৫.৭ মাত্রায় এই অবস্থা হলো, যদি ৮ মাত্রায় হয় তাহলে কী হবে? আমরা কি মেইন শকের জন্য প্রস্তুত আছি?”
ঢাকা বা দেশের অন্যান্য শহরে বাড়ি নির্মাণের সময় ভূমিকম্পের সম্ভাব্য ক্ষতির দিকটি মাথায় নেওয়া হয়নি—এটি বিশেষজ্ঞরা বারবার বলে আসছেন। তাহলে এখন কী করা উচিত—এই প্রশ্নে শাকিল নেওয়াজ বলেন, “ঢাকার যে ভবনগুলো আছে, এগুলোতে রাজউক বা অন্যান্য সংস্থার মাধ্যমে জরিপ করতে হবে যে এগুলো ৮ মাত্রার ভূমিকম্প সহনশীল কিনা।”
শক্তিশালী ভূমিকম্পের আগাম সতর্কতা দিয়েছেন বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের ভূমিকম্প পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রুবাইয়াত কবির। সাম্প্রতিক দেশকালকে তিনি বলেছেন, “ঐতিহাসিকভাবে এ অঞ্চলে একাধিক বড় ভূমিকম্প সংঘটিত হয়েছে, যা প্রমাণ করে এটি ভূমিকম্প ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা।”
আফটারশকে ক্ষতিগ্রস্ত ভবনে ঝুঁকি রয়েছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, “অবশ্যই ক্ষতি রয়েছে। এখন যদি ৫.৬ মাত্রারও ভূমিকম্প হয়, তাহলেও অনেক ভবনে মারাত্মক ঝুঁকি হতে পারে।”
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের অবসরপ্রাপ্ত মহাপরিচালক আলী আহমেদ খানকে প্রশ্ন করা হয়, রাজধানীর মতো ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় ফায়ার সার্ভিসের উদ্ধার সক্ষমতা যথেষ্ট কিনা। জবাবে তিনি ‘না’ সূচক উত্তর দিয়ে বলেন, “বিদেশে ফায়ার ডিপার্টমেন্টের গাড়ি চলাচলের জন্য আলাদা রাস্তা থাকে, তবে আমাদের দেশে নেই। ঘনবসতি এলাকায় এমনও জায়গা আছে যেখানে গাড়ি যেতেই পারবে না। এটা অনিরাপদ শহর। যাওয়ার রাস্তা না থাকলে তারা কীভাবে সক্ষমতা দেখাবে?”
ধামরাইয়ে ভাঙা হচ্ছে হেলে পড়া ভবন, ঢাকারগুলো কী হবে?
ঢাকার ধামরাই উপজেলায় হেলে পড়া একটি চারতলা ভবন ইতিমধ্যেই ভেঙে ফেলার কাজ শুরু হয়েছে। শুক্রবার পাশের একটি ছয়তলা ভবনের ওপর এটি হেলে পড়েছিল।
ধামরাই পৌরসভার ঢুলিভিটা এলাকায় গড়ে ওঠা ধানসিঁড়ি হাউজিং প্রকল্পের ভেতরে বাড়িটির অবস্থান। উপজেলা প্রশাসনের নির্দেশনায় ভাঙার কাজ শুরু করেছেন ভবনটির মালিক নিজেই।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) মামনুন আহমেদ অনীক বলেন, “এ ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ ভবন নিয়ে অবশ্যই আমরা দায়িত্বশীল থাকব।”
ঢাকার সূত্রাপুর ও কলাবাগানে দুটি ভবন হেলে পড়ার খবর পাওয়া গেছে। তবে এই দুটি ভবন নিয়ে এখন পর্যন্ত চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।
