নভেম্বরেও চোখ রাঙাচ্ছে ডেঙ্গু, শীতেও থাকছে ঝুঁকি
মাহফুজ উল্লাহ হিমু
প্রকাশ: ২৪ নভেম্বর ২০২৫, ১৫:৫০
এডিস মশা, যেটি ডেঙ্গু ও পীতজ্বরের মতো মারাত্মক দুটি রোগের বাহক।
বাংলাদেশে সাধারণত জুন–সেপ্টেম্বর ডেঙ্গুর মৌসুম হিসেবে পরিচিত। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে সে ধারা পাল্টেছে। চলতি বছরের নভেম্বরের এক-তৃতীয়াংশ পেরিয়েও ডেঙ্গুর তীব্রতা কমার কোনো লক্ষণ নেই; বরং সংক্রমণ ও মৃত্যুহার দুটোই বেড়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শীতজুড়েই ডেঙ্গুর ঝুঁকি থাকতে পারে।
তারা বলছেন, ডেঙ্গু তার আচরণ পরিবর্তন করেছে। ফলে ডেঙ্গুর সুনির্দিষ্ট সময়ের ধারণা বর্তমানে কার্যকর নয়। গত কয়েক বছরের ধারাবাহিকতায় এবারও পুরো শীত মৌসুমেই ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব থাকতে পারে। সরকার ও সংশ্লিষ্টদের এখন থেকেই আগামী বছরের জন্য প্রস্তুতি নেওয়ার আহ্বান জানাচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।
শীতের শুরুতে খারাপ হয়েছে পরিস্থিতি
চলতি বছরের ২২ নভেম্বর পর্যন্ত স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রতিবেদনে দেখা গেছে, এ সময়ে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন ১৯ হাজার ৬২৪ জন, যেখানে গত অক্টোবরের একই সময়ে আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ১৫ হাজার ৮৬৬ জন। অর্থাৎ এক মাসের ব্যবধানে আক্রান্তের সংখ্যা বেড়েছে ৩ হাজার ৭৫৮ জন, যা শতকরা হিসেবে প্রায় ২৩.৭ শতাংশ।
আক্রান্তের পাশাপাশি মৃত্যুও বেড়েছে উল্লেখযোগ্য হারে। নভেম্বরের ২২ দিনে মৃত্যু হয়েছে ৭৮ জনের, অক্টোবরের একই সময়ে যেখানে মারা গিয়েছিলেন ৫৭ জন। ফলে মৃত্যুর সংখ্যা বেড়েছে ২১ জন, যা শতকরা হিসেবে প্রায় ৩৬.৮ শতাংশ বাড়তি। সংখ্যার এই ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা স্পষ্টভাবে দেখায়, নভেম্বরের শুরু থেকেই ডেঙ্গুর তীব্রতা কমেনি বরং আক্রান্ত ও মৃত্যুর হার উভয়ই আরও দ্রুত গতিতে বাড়ছে।
নভেম্বরের পরিসংখ্যান বলছে, এ সময় আক্রান্ত হয়েছেন ১৯ হাজার ৬২৪ জন। দিন হিসেবে গড়ে প্রায় ৮৯২ জন রোগী প্রতিদিন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এই হার অক্টোবর মাসের তুলনায় বেশ বেশি। অক্টোবরজুড়ে আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ২২ হাজার ৫২০ জন, দিনে গড়ে প্রায় ৭২৬ জন।
গত মাসের আক্রান্তের মোট সংখ্যা বিবেচনায় নভেম্বর এখনও পেছনে থাকলেও সংক্রমণের দৈনিক গড় বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় ২৩ শতাংশ, যা পরিস্থিতিকে আরও উদ্বেগজনক করেছে। সংক্রমণের এমন বৃদ্ধি নির্দেশ করে, বিস্তারের গতি কমেনি বরং মাসের মধ্যভাগ থেকেই ডেঙ্গু আবার সক্রিয়ভাবে ছড়িয়ে পড়ছে।
ভর্তি বেশি বরিশালে, মৃত্যু ঢাকা দক্ষিণে
দেশজুড়ে ডেঙ্গু পরিস্থিতি বিশ্লেষণে দেখা যায়, ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন এখনও ডেঙ্গুর প্রধান কেন্দ্র। পাশাপাশি ঢাকার বাইরের জেলাগুলোতেও ছড়িয়েছে ডেঙ্গু। চলতি বছরে সবচেয়ে বেশি ২৬ হাজার ৭৯১ জন রোগী ভর্তি হয়েছে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন এলাকায়। তবে এলাকাভিত্তিক সর্বোচ্চ রোগী ছিল বরিশালে, ২০ হাজার ৭৯ জন। এছাড়া ঢাকা বিভাগের বিভিন্ন এলাকায় (সিটি করপোরেশনের বাদে) ১৫ হাজার ২৫৬ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এককভাবে ঢাকা উত্তরে ১৩ হাজার ৯৭০ জন এবং দক্ষিণে ১২ হাজার ৮২১ জন ভর্তি হয়েছেন।
জনসংখ্যা ভিত্তিক বিশ্লেষণ বলছে, আক্রান্তদের প্রায় ৬২ শতাংশই পুরুষ, আর বয়সভিত্তিক তথ্য অনুযায়ী সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন ১৬ থেকে ৩৫ বছর বয়সী তরুণ ও কর্মজীবী জনগোষ্ঠী।
কর্মস্থলে যাতায়াত, বাইরে দীর্ঘ সময় অবস্থান ও মশার প্রজননস্থানে ঘন যোগাযোগ এই গোষ্ঠীর জন্য ঝুঁকি বাড়িয়ে দিচ্ছে। যদিও বছরের মোট মৃত্যুহার প্রায় ০.৪ শতাংশ। তবে প্রথম সংক্রমণের ২৫ বছর পরেও ডেঙ্গুতে মৃত্যুকেই ব্যর্থতা বলছেন বিশেষজ্ঞরা।
থাকছে সারাবছর, নিরুত্তর স্বাস্থ্য অধিদপ্তর
অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, বছরে এ পর্যন্ত সুস্থ হয়ে ফিরেছেন ৮৬ হাজার ৩৩১ জন। সেই হিসেবে বর্তমানে চিকিৎসাধীন রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে প্রায় সাড়ে তিন হাজার। সংক্রমণের হার এমনভাবে বাড়তে থাকলে হাসপাতালের ভর্তি সক্ষমতা ও চিকিৎসা-পরিচর্যা ব্যবস্থার ওপর চাপ আরও বাড়বে বলে শঙ্কা সংশ্লিষ্টদের। বিশেষ করে, শীতের মৌসুমে অন্যান্য ভাইরাল রোগও বাড়তে শুরু করলে সামাল দেওয়া কঠিন হবে বলে মত তাদের।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সংক্রামক রোগ শাখার সাবেক পরিচাক বে-নজির আহমেদ সাম্প্রতিক দেশকালকে বলেন, “এখন যেভাবে ডেঙ্গু হচ্ছে, সেটা কমতে কমতে ডিসেম্বর মাস শেষ হয়ে যাবে। যদি এডিস মশার প্রজনন এই সময়ে আরও হয়, তাহলে এটি আগামী বছরের জানুয়ারিতেও চলতে থাকবে। এটি আমাদের জন্য চিন্তার বিষয়। কারণ সারা বছর ধরে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। এর মানে হলো যথেষ্ট কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়নি।”
এসব বিষয়ে জানতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সংক্রমক রোগ শাখায় একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও সদুত্তর পাওয়া যায়নি। শাখার উপ-পরিচালক আশরাফুন নাহার এ বিষয়ে মন্তব্য করতে অপারগতা প্রকাশ করেন। সাম্প্রতিক দেশকালকে তিনি বলেন, “যে কোনো বিষয়ে রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক অথবা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক কথা বলবেন। আমার এসব বিষয়ে কথা বলার অনুমিত নেই।”
তবে একাধিকবার মুঠোফোন ও খুদে বার্তায় রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক অধ্যাপক ফরহাদ হোসেন সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তার মন্তব্য পাওয়া যায়নি।
মৃত্যু ও করণীয়
বে-নজির বলেন, “এটি সত্যিই দুঃখজনক। আমরা ইতোমধ্যেই সাড়ে তিন শ মানুষ হারিয়েছি এবং প্রতিদিন রোগী মারা যাচ্ছেন। আমরা ২৫ বছর ধরে এই রোগটির মোকাবিলা করছি। এ অবস্থায় ৩৫০ জন মানুষের মৃত্যুর বিষয়টি মেনে নেওয়া যায় না। এটি আমাদের ব্যর্থতা এবং সংশ্লিষ্ট বিভাগের দায়িত্বশীলতার ঘাটতি।
তিনি বলেন, “এখন গুরুত্বপূর্ণ হলো, আগামী বছরে যেন অনুরূপ ঘটনা না ঘটে।”
আগামী বছরের জন্য করণীয় কী জানতে চাইলে এই সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ বলেন, “ব্যবস্থা একটাই। এডিস মশা নিয়ন্ত্রণ করা। এডিস মশার ঘনত্ব পরিমাপ করতে হবে, ঝুঁকি নিরূপণ করতে হবে এবং ঝুঁকিগুলো দূর করার ব্যবস্থা নিতে হবে। পদ্ধতিটি সহজ, কিন্তু যদি গ্রহণ না করা হয়, সহজ জিনিসও কঠিন হয়ে যাবে।”
“এই পরিস্থিতিতে পুরো বছরই ডেঙ্গুর ঝুঁকির মধ্যে থাকতে পারে। গতবারও পুরো বছর এমনটা হয়েছিল, মাঝখানে সামান্য কম দেখা গেছে”—বলেন তিনি।
