
ছবি: সংগৃহীত
আজ আপনাদের শোনাব জীবন যুদ্ধে হার না মেনে শূন্য থেকে সফল হওয়া এক সংগ্রামী মানুষের কাহিনী। তাহলে চলুন শুনে আসি তার জীবন যুদ্ধের কথা তার নিজের মুখেই।
আমার বাবা ছিলেন একজন মাতাল, জুয়াড়ি। বাড়ির পাশে আমাদের ছোট্ট একটি চায়ের স্টল ছিলো। আমি আর বাবা সারাদিন চা বিক্রি করতাম। যত টাকা লাভ হতো তার অল্প কিছু টাকা বাবা সংসারে দিতো, বাকী টাকা উনি মদ খেয়ে আর জুয়া খেলে শেষ করতেন।
আমার বাবা আমার লেখাপড়ার খরচ দিতন না। উনি শুধু একবার স্কুলে ভর্তি করিয়েছিলেন। তারপর থেকে ক্লাস সিক্স পর্যন্ত খরচ আমার মা চালিয়েছেন। পড়ানোর জন্য অনেক কষ্ট করেছেন আমার মা। কিন্তু বাবার জন্য পারতেন না।
ক্লাস সিক্স এ উঠার পর আমি বাবার সাথে চায়ের দোকানে যেতাম। সেখান থেকে মাঝে মাঝে কিছু কিছু টাকা চুরি করে জমিয়ে রাখতাম। এভাবেই লেখাপড়ার খরচ চলতো। কিন্তু সমস্যা হলো যেদিন আমার বাবা মারা গেলেন। মদ খেতে খেতে কিডনি দুটো নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। তাছাড়া আমাদের চিকিৎসা করানো মত টাকা পয়সা ছিলো না। আমি তখন এসএসসি পরীক্ষা দিব। বয়স প্রায় ১৭ এর মত। বাবা মারা যাওয়ার পর আমার চাচারা মিলে আমাদের চায়ের দোকান দখল করে নেয়। তখন আমি বেকার হয়ে যাই। টাকার অভাবে পররীক্ষা দিতে পারিনি। ফলে পেলাম না আর লেখাপড়ার সুযোগ।
বাবা মারা যাওয়ার কয়েকমাস পরে মা একজন ভ্যান চালককে বিয়ে করেন। অবশ্য না করেও উপায় ছিলো না। খাওয়ার মত কিছুই ছিলো না আমাদের। মায়ের বিয়ের পরে তিনি ওই লোকের সাথে থাকতেন। আমি ওই লোকটাকে পছন্দ করতাম না, উনিও আমাকে পছন্দ করতেন না। একদিন উনার সাথে ঝগড়া করেই ঢাকা চলে আসি। ঢাকা আসার পর প্রথম ২-৩ দিন বলতে গেলে না খেয়েই কাটিয়েছি। পকেটে টাকা ছিলো না। ক্ষুধায় পেট ব্যাথা করতো, পানি খেতাম। খাবারের নেশায় ঘুরতাম সবসময়। একদিন ক্ষুধার যন্ত্রনায় আমি একটা গাছের নিচে বসে কাঁদছিলাম। তখন একজন লোক এসে আমাকে জিজ্ঞেস করে কাঁদছি কেন, আমি উনাকে সবকিছু বললে উনি আমাকে উনার গ্যারেজে নিয়ে চাকরী দেয়।
সেটা ছিল একটা ট্রাক রিপিয়ারিং গ্যারেজ। ওরা ট্রাক এর ইঞ্জিন মেরামত করতো। উনি মিস্ত্রি ছিলেন, আমি হেল্পার হিসেবে কাজ করতাম।
মাসিক বেতন ছিলো ২০০ টাকা আর থাকা খাওয়া ফ্রি। তারপর ওইখানে থেকে ১ বছরে ইঞ্জিন মেরামতের প্রায় সব কাজ শিখে ফেলি। তাড়াতাড়ি শেখার কারণ হলো অল্প লেখাপড়া করেছিলাম, সব পার্টস এর নাম সহজে মনে রাখতে ও পড়তে পারতাম। এর সঙ্গে আরও কিছু কাজ শুরু করি। মাসে প্রায় ১ হাজার টাকা আয় হত। আমার বয়স যখন ১৮ তখন মাসিক রোজগার ছিলো ১ হাজার টাকা।
বলা চলে, ওই গ্যারেজটাই ছিলো আমার জীবন পরিবর্তনের পথ প্রদর্শক। আমি ওইখানে থেকে অনেক ট্রাক ড্রাইভারের সঙ্গ লাভ করি। গ্যারেজে ৩ বছর থাকার পরে নিজের একটা গ্যারেজ খুলে সেখানে কাজ করতে থাকি। আমার পরিচিত ড্রাইভার ছিলো অনেক, তাই গ্যারেজ খোলার পর থেকেই ভালো ইনকাম শুরু হয়। তখন মাসে সব খরচ বাদ দিয়ে প্রায় ৫-৬ হাজার টাকা থাকতো। সব টাকা জমাতে শুরু করলাম। আর আগেও আমার কাছে কিছু টাকা ছিলো। এইভাবে প্রায় ১ বছর টাকা জমিয়ে আর আগের টাকা মিলিয়ে প্রায় ১ লাখ টাকা হাতে আসে। তখন বয়স প্রায় ২৩ বছর।
তার মানে প্রথম ১ লক্ষ টাকা ইনকাম করতে আমার ৬ বছর সময় লেগে গেছে।
তারপর এই টাকা দিয়ে কিস্তিতে ছোট্ট একটা ট্রাক কিনলাম। কেনার পর আমি একটা ড্রাইভার রেখে তার মাধ্যমে ট্রাকটি চালাতে শুরু করালাম আর নিজে গ্যারেজে কাজ করতাম। তখন মাস শেষে আমার আর ট্রাকের ইনকাম মিলিয়ে প্রায় ২০ হাজার টাকা হয়ে যেতো। প্রথম ট্রাকটা কেনার প্রায় ৭-৮ মাস পরেই আমি আরো একটি ট্রাক কিস্তিতে কিনে ফেলি। আর আমার গ্যারেজ ও ততদিনে অনেক বড় হয়ে যায়। তখন মাসে আয় দাঁড়ায় প্রায় ৩৫ হাজার টাকা।
প্রথম ট্রাকটা কেনার প্রায় ৫ বছর পরে যখন আমার ৮ টি ট্রাক হয়ে যায় তখন আমার মাসিক আয় ছিলো ১ লাখ টাকা। তখন আমি গ্যারেজ বাদ দিয়ে ট্রাকের দিকে মনোযোগ দিতে শুরু করি। আস্তে আস্তে আমি ছোট্ট ট্রাক বাদ দিয়ে বড় ট্রাক কিনতে শুরু করি। এভাবে আমার বয়স যখন ৩৫ তখন মোট ট্রাকের সংখ্যা হয় ১৫ টি। যা হতে মাসে আয় করতাম প্রায় ৫ লাখ টাকা। এখন আমার বয়স প্রায় ৪৮ বছর। আমার ট্রাকের সংখ্যা ২১৪ টি। আর বর্তমানে আমার আয় করি প্রতি মাসে প্রায় ১ কোটি ২০ লক্ষ টাকা।
মোজাম্মেল হক (স্বত্তাধিকারী- একতা ট্রান্সপোর্ট এজেন্সি)
ঢাকা।
(পাবলিকিয়ান পাঠশালা থেকে সংগৃহীত ও আংশিক সম্পাদিত)