Logo
×

Follow Us

চিঠি

হারিয়ে যাওয়া চেনা বাড়ির স্মৃতি

Icon

সাদিয়া ইসতিয়াক

প্রকাশ: ০৭ জুলাই ২০২৩, ১২:৫৪

হারিয়ে যাওয়া চেনা বাড়ির  স্মৃতি

বর্তমানের সিলেট বিভাগ যা কিনা একসময় উত্তর পূর্ব বাংলাদেশের এক সমৃদ্ধ অঞ্চল ছিল। তৎকালীন ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনামলে ভারতের আসাম প্রদেশের অংন্তর্ভূক্ত ছিল আজকের সিলেট। আর তাই এই অঞ্চলের ঘর বাড়ির নকশায় ঐতিহাসিক আসাম টাইপ বাংলো বাড়ির প্রভাব লক্ষণীয়; যদিও শহরের দ্রুত নগরায়ণ এবং অতীতের প্রতি অজ্ঞতা এই অবশিষ্ট কাঠামোগুলোর অস্তিত্বকে আজ হুমকির মুখে ফেলেছে। আজকের চিঠিতে ১৯৫০ সালে নির্মিত এমনি এক বাড়ির কথা বর্ণিত হয়েছে। 

এই চিঠি যিনি লিখেছেন  সাদিয়া ইশতিয়াক তার দাদা বাড়িটি ১৯৫০ সালে তৈরি করেছিলেন। পেশায় ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন। চাকরির পোস্টিংয়ের কারণে তাকে দেশের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়াতে হয়েছে । সাদিয়ার বাবা-মা দুজনেই চিকিৎসক এবং তিনি তার শৈশবকাল (১৯৯৯-২০১৫) তার দাদা-দাদীর বাড়িতে কাটিয়েছেন। এখন বেশিরভাগ সময় ঘরটি  খালি পরে থাকে।

স্নেহের দাদাভাই,

আজ আমি তোমাকে আমার দাদাবাড়িতে থাকার অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে চাই।  এই বাড়িকে ঘিরে আনন্দে ভরা স্মৃতিগুলো আমার হৃদয়ে গ্রথিত আছে।  চলো সেই স্মৃতির বারান্দা হতে খানিকটা সময় ঘুরে আসি।  

আমাদের বাসা ছিল সিলেটের শেখঘাটে।  ১৯৫০ খ্রীস্টাব্দে বাড়িটা তৈরি হয়েছিল। যা এখনো মজবুত  ভিতের উপর দাঁড়িয়ে আছে।  জন্মের পর থেকেই এই বাসায় আমার জীবনকাল অতিবাহিত হয়েছে ২০১৫ সাল পর্যন্ত। আমাদের বাসাটা ছিল চারিদিকে গাছ দিয়ে ঘেরা, আমার বাবা বাগান পছন্দ করতেন। বাসার সামনে একটি ছোট বাগান ছিল যেখানে বাবা আর আমি প্রতি বছর অনেক সুন্দর সুন্দর ফুলের গাছ লাগিয়েছিলাম। আমাদের বড় বড় ফলের গাছ যেমন আম, কামরাঙ্গা, বড়ই , কাঁঠাল, নারিকেল, পেয়ারা, জাম্বুরা, লিচু ছিল।  বাবা আর আমার ছোট ভাই গাছে উঠে ফল পারতো। আমার এখনো মনে পরে যে, একবার এতো ফলন হলো যে, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব আর প্রতিবেশীদের মাঝে বিতরণ করার পরেও অনেক উদ্বৃত্ত ছিল। গাছের ফল (আম, বড়ই) দিয়ে আমরা আচার বানাতাম আর সারা বছর খেতাম। গাছ থেকে পেড়ে ফল খাওয়ার মধুর সময় গুলো আমার স্মৃতিতে এখনো জ্বলজ্বল করছে। 

একতলার বাসাটা ছিল সিলেটি ঐতিহ্যের সাক্ষ্য বহনকারী। সেখানে ছিল চারটি শোয়ার ঘর, একটি বসার ঘর, একটি খাবার ঘর, দুইটি  ষ্টোর রুম, একটি রান্নাঘর আর বাথরুম।  আগে বাথরুম বাইরে ছিল যা এখন পরিত্যক্ত।  ঘরের বাইরে ছিল বারান্দা; আমি ওই বারান্দায় সাইকেল চালাতাম।  প্রতিটি ঘরে ছিল অনেক জানালা।  দরজা, জানালা,  চৌকাঠ  সবই ছিল কাঠের তৈরি। আমার মা বাসাটা সার্বক্ষণিক পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা আর তদারকি করতেন।  প্রতিটি ঘরের উচ্চতা ছিল আধুনিক সময়ের ঘরের  চেয়ে অনেক বেশি।  

প্রতিটি ঘরের উচ্চতা ছিল প্রায় ১৮ ফুট। আমার শোয়ার ঘরের উচ্চতা ছিল ১০ ফুট এবং অর্ধ অষ্ট-কোনাকৃতির।  বাসার ছাদটি টিনের এবং ভেন্টিলেটর ছিল ১৬ ফুট উচ্চতায়।  শীতল বাতাসে আমাদের বাসার ভেতরে ছিল আরামদায়ক আবহাওয়া।  সূর্যের আলোক রশ্মি পূর্বে জানালা দিয়ে প্রবেশ করত। সেই সময় আমাদের দিনগুলো ছিল প্রাঞ্জল।  বাসার  মূল কাঠামো থেকে রান্নাঘর ছিল অসম্পূর্ণ আলাদা সেখানে যাবার পথ ছিল টিনে  ঢাকা যা আমাদের সবার জন্য এক অভিনব অভিজ্ঞতা। 

সারা বছর প্রচুর বৃষ্টি হতো;  টিনের চালে এই শব্দ আমাদের জন্য ছিল অদ্ভুত ভালোলাগার এক অনুভূতি। শীতের সময়ে বাইরের উঠোনে আমরা ব্যাডমিন্টন খেলতাম।  বসন্তকালে বাসার চারিদিক  নানা রং-বেরংয়ের ফুলের শোভায় সজ্জিত হতো। 

অথচ করোনাকালীন সময়ে আমরা সবাই ছিলাম ঘরবন্দী।  আমার শেখঘাটের  বাসাকে আজ  অনেক মনে পড়ে। সেই বাসাতে খোলা হাওয়ায়  আর খোলা উঠোনে আমরা আরো স্বাস্থ্যসম্মতভাবে দিনানিপাত করতে পারতাম।

যদি পারতাম আমি আবার ওই বাসায় ফিরে যেতাম ! বাসা টা যে আছে আমার হৃদয়ের মণিকোঠায়।  জীবনের শেষ অঙ্কে পৌঁছেও, দাদুভাই, সেই সুখের দিনগুলো  আমার জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে থাকবে। কালের বিবর্তন আর বাস্তবতার তাগিদে বাসাটা ভাঙতে হবে, তুমি তোমার জীবনে সেই বাড়িটি নিজ চোখে দেখতে পারবেনা, শুধু ছবি দেখবে হয়তো তাই  তোমাকে উদ্দেশ্য করে লেখা, কিছুটা হলেও যেন বেঁচে থাকে তোমার স্মৃতিকোঠায়।

ইতি

তোমার দাদী

(প্রেরক: সাদিয়া ইসতিয়াক)


Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫