Logo
×

Follow Us

চিঠি

নারীর প্রতি বৈষম্য নয়

নারীই পারে বিশ্বের বুকে বাংলাকে তুলে ধরতে

Icon

প্রিয়া

প্রকাশ: ২৯ নভেম্বর ২০২৩, ১৮:০০

নারীই পারে বিশ্বের বুকে বাংলাকে তুলে ধরতে

প্রতীকী ছবি

সোহাগী (ছদ্মনাম) শেরপুর সদর উপজেলার কামারের চর ইউনিয়নের মমিন মিয়ার একমাত্র মেয়ে। চলতি বছরের মে মাসে অষ্টম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় মাত্র ১৫ বছর বয়সেই পরিবার তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে বিয়ে দিয়ে দেয় এবং এই বিষয়টা তারা সম্পূর্ণ গোপন রাখে। পরে বিষয়টি এলাকায় জানাজানি হলেও প্রশাসনের কাছে বিষয়টি পৌঁছায়নি।

সরজমিনে গিয়ে দেখা যায় যে, সোহাগীর আরো দুজন বড় ভাই আছে। তারা এখনো পড়াশোনা করছে। সোহাগীর এত তাড়াতাড়ি বিয়ে সম্পর্কে জানতে চাইলে তার মা রহিমা আক্তার বলেন, ‘মাইয়া মানুষের এত নেহাপড়া কইরে কি অবো? পোলা মানুষ বড় অয়ে (হয়ে) চাকরি করবো। মাইয়া মানুষ চাকরি-বাকরি তো আর পায়তো না। আগে পিছে বিয়ে দেওন নাগতোই। বালা জামাই পাইছি সরকারি চাকরিজীবী বিয়া দিয়া দিছি চিন্তা শেষ। আমারও তো ছোডকালে ১২ বছরে বিয়া অইছিলো কই আমার তো কিছু হয়নাই এহনো তো বালাই আছি।’

স্থানীয় এক প্রতিবেশী শিউলি বেগম জানান, ‘মেয়েটা তো ভালো ছাত্রী ছিল পিএসসি পরীক্ষায় ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পেয়েছিল। এছাড়াও স্কুলের বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করত। আমি আগে ওর প্রাইভেট শিক্ষক ছিলাম। বিয়ের সময় জানাজানি হয়নি, জানলে বিয়েটা বন্ধ করে দেওয়ার চেষ্টা করতাম। কিন্তু এখনতো মেয়ে স্বামীর বাসায় সংসার করছে। কিছুদিন আগে শুনলাম মেয়েটা গর্ভবতীও হয়েছে। এরকম কম বয়সে আমাদের এলাকায় প্রায়‌ই বিয়ে হচ্ছে।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে শেরপুর সদর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মেহনাজ ফেরদৌস জানান, ‘যখন এ সম্পর্কিত কোনো অভিযোগ আমাদের কাছে আসে তখন আমরা সেটা যাচাই-বাছাই করে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেই। অভিযোগ না পেলে তো আমরা ব্যবস্থা নিতে পারি না। কে ছেলে কে মেয়ে বিষয়টা সেটা নয়। সে একজন বাংলাদেশের নাগরিক। আর নাগরিক হিসেবে সকল ক্ষেত্রে সমানভাবে তার অংশগ্রহণের সুযোগ রয়েছে। মেয়েরা চাকরি পাবে না বিষয়টি একদম ভুল। আজ মেয়েরা দেশের অনেক উচ্চ পদে চাকরি করছে। যারা এরকম ধারণা পোষণ করে তাদের মধ্যে শিক্ষা ও সচেতনতার অভাব রয়েছে। বিশেষ করে গ্রামীণ সমাজেই মেয়েদের প্রতি বৈষম্যটা বেশি দেখা যায়। এর জন্য আমরা বিভিন্ন সময় উঠান বৈঠকে এই বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলছি, বিশেষ করে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য যা করণীয় সবই করা হচ্ছে আমাদের প্রশাসনের পক্ষ থেকে। যেন তারা অল্প বয়সে ছেলে মেয়েদের বিয়ে না দেয় বিশেষ করে মেয়েদের যেন বিয়ে না দেওয়া হয়। আর যদি বাল্যবিয়ের পর কোনো অভিযোগ আমাদের কাছে আসে তখন আইন অনুযায়ী যা যা ব্যবস্থা নেওয়া দরকার আমরা সেটা করি।’

ইউনিসেফের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে ১৮ বছর হওয়ার আগেই ৫১ শতাংশ মেয়ের বিয়ে হয়ে যায়। এছাড়াও ১৫ বছর হওয়ার আগেই ১৫ শতাংশ মেয়ের বিয়ে হয়ে যায়। বাল্যবিবাহের প্রচলন থাকা দেশগুলোর মধ্যে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান অষ্টম এবং এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি।

জাতীয় জরুরি সেবা (৯৯৯) এর বরাতে জানা যায়, গত পাঁচ বছরে বাল্যবিবাহ সম্পর্কিত মোট ফোনকল এসেছে ২৫ হাজার ১৮০টি। এ বছরের জানুয়ারি থেকে জুলাই মাস পর্যন্ত মোট কল এসেছে ৬ হাজার ৯২৪টি। এদের মধ্যে অধিকাংশ কল ভুক্তভোগী নিজেই করেছেন। তারা আরো জানান যে, যখনই তারা বাল্যবিবাহ সম্পর্কিত কোন ধরনের কল পান তখনই সাথে সাথে সেটা বন্ধ করার জন্য উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) স্থানীয় চেয়ারম্যান, মেম্বারসহ সংশ্লিষ্ট সকলকে অবহিত করেন এবং তারা যাচাই-বাছাই করে ব্যবস্থা নেন।

২০১৮ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষণা দিয়েছিলেন যে, ২০২১ সালের মধ্যে ১৫ বছরের কমবয়সীদের বিয়ের হার শূন্যে নামিয়ে আনা হবে এবং ১৫ থেকে ১৮ বছর বয়সীদের বিয়ের হার এক- তৃতীয়াংশ কমিয়ে আনা হবে। কিন্তু সেই প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে সরকার সফল হতে পারেনি বাল্যবিয়ে কমার চেয়ে বরং বেড়ে গেছে।

জাতিসংঘের জনসংখ্যা তহবিল (ইউএনএফপিএ) এর প্রকাশিত প্রতিবেদন ২০২২ এ দেখা যায়, পূর্ববর্তী বছরে তুলনায় ২০২১ সালে বাংলাদেশে বাল্যবিবাহ ১০% বেড়ে গেছে। যদিও এর পেছনের প্রধান কারণ হিসেবে কোভিড-১৯ এর প্রভাবকে দেখা হচ্ছে।

এ বিষয়ে মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের শিশু সুরক্ষা বিভাগের সমন্বয়কারী রাফিদা শাহিন জানান, ‘বাল্যবিয়ে না কমার পেছনে সামাজিক নিরাপত্তা ও সচেতনতার একটা বড় অভাব রয়েছে। এছাড়াও দুই বছর স্কুল কলেজ বন্ধ ছিল ছেলে-মেয়ে বাসায় থাকতো। ওই সময়টায় মেয়েদের প্রতি সহিংসতা এবং বাল্যবিয়ে একটু বেশি বেড়ে গিয়েছিল। সরকার কিন্তু বাল্যবিয়ে বন্ধের জন্য আইন প্রণয়ন করেছে। তবে এটা জনগণের কাছে সঠিকভাবে প্রচার করা এবং এর শাস্তি সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করার ক্ষেত্রে বড় একটা গ্যাপ রয়েছে। যার জন্য জনগণ সচেতন হচ্ছে না এবং বাল্যবিয়ে কমছে না বলে আমরা সমাজকর্মীরা মনে করি। কোনো মেয়ে বাল্যবিয়ের শিকার হলে ‌এর সাথে তার পড়াশোনাও শেষ হয়ে যায়। একটি মেয়ের বিয়ের সাথে যদি শিক্ষাজীবনটা শেষ হয়ে যায় এর থেকে জীবনে বড় ক্ষতি আর হতে পারে না। এছাড়া অনেক মেয়ে রাস্তাঘাটে বখাটে ছেলেদের দ্বারা ইভটিজিংয়ের শিকার হয়। পরিবার এসব বিষয়েও মেয়ের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত হয়ে যায় এবং উপযুক্ত বয়স হওয়ার আগেই বিয়ে দিয়ে দেয়।’

এছাড়াও আগে আইনে আঠারো বছরের আগে বিয়ে হতে পারতো না কিন্তু এখন নির্দিষ্ট কারণ দেখিয়ে ১৬ বছরেও বিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এখানে আইনের কিছুটা ত্রুটি রয়েছে। এই বাল্যবিয়ে কমানোর জন্য সরকারকে এ সম্পর্কিত প্রত্যেকটা বিষয়ে গুরুত্ব সহকারে কাজ করতে হবে। সচেতনতা বাড়াতে হবে, সর্বজনীন শিক্ষা ব্যবস্থা করতে হবে যেন কেউ শিক্ষা থেকে বঞ্চিত না হয়। শিক্ষা খাতে বাজেট বাড়াতে হবে। উল্লেখ্য আমাদের দেশে শিক্ষা খাতে বাজেটের যতটুকু অংশ ব্যয় করা হয় তা প্রতিবেশী দেশ নেপাল ও ভুটানের চেয়েও কম। এছাড়াও স্কুল কলেজের পাঠ্যপুস্তকে এই বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে তুলে ধরতে হবে। এতে করে শিশুরাও সচেতন হবে, প্রতিবাদী হবে এবং বাল্যবিয়ের ঘটনাও ঘটবে না বলে আশা করছি।

বিশ্ব পরিসংখ্যান পরিস্থিতি ২০২৩ প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের প্রতি ১ হাজারে ৭৪টি শিশু জন্ম দিচ্ছে ১৫ থেকে ১৯ বছর বয়সী মেয়েরা। যার ফলে বাড়ছে মা ও নবজাতকের মৃত্যুঝুঁকি।

ইউনিসেফের তথ্য বলছে, দেশে বাল্যবিয়ের শিকার হওয়া মেয়েদের মধ্যে ২৪ শতাংশই ১৮ বছর হওয়ার আগেই সন্তান জন্ম দিচ্ছে। ইউনিসেফের আরেকটি তথ্য বলছে, ২০ বছরের আগে মেয়েরা সন্তান জন্ম না দিলে বাংলাদেশে প্রতি বছর ২৩ হাজার শিশুর জীবন রক্ষা পাবে।

ইউনিসেফের দ্য স্টেট অফ দ্য ওয়ার্ল্ডস চিলড্রেন ২০২৩ নামের এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, জীবন রক্ষাকারী টিকা থেকে বঞ্চিত বিশ্বের ৭ কোটি শিশু। বাংলাদেশের ৮৩ শতাংশ শিশু সঠিক সময়ে টিকা পেলেও বাকি ১৭ শতাংশ শিশু পায় না। এর মধ্যে মান্তা শিশুরা আছে, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর শিশুরা আছে এবং প্রান্তিক অঞ্চলের অসচেতন পরিবারের শিশুরাও আছে।

বাংলাদেশ জনমিতি ও স্বাস্থ্য জরিপ ২০২২ এ দেখা যায়, পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের মধ্যে ২৪ শতাংশই পুষ্টিহীনতায় ভোগে। এর স্পষ্ট প্রভাব লক্ষ্য করা যায় শিশুদের ওজন এবং উচ্চতায়।

জাতীয় জনসংখ্যা গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইন্সটিটিউট (নিপোর্ট) পরিচালিত বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক অ্যান্ড হেলথ সার্ভে-২০২২ (বিডিএইচএস) এর জরিপ বলছে, বাংলাদেশে এক লাখ সন্তান প্রসব করার সময় মারা যাচ্ছেন ১৬৮ জন মা। প্রতি ১ হাজারে এক বছরের কম বয়সী ২৫ টি শিশু মারা যাচ্ছে এবং পাঁচ বছরের কম বয়সী ৩১টি শিশু মারা যাচ্ছে। এর পেছনে কম বয়সে গর্ভধারণ এবং এর ফলে শিশুর অপরিণত জন্ম ও জন্মের সময় ওজন কম হওয়াকে প্রধান কারণ হিসেবে বলা হয়েছে।

এ বিষয়ে কুমুদিনী মহিলা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের শিশু বিশেষজ্ঞ ডাক্তার আলী হাসান জানান, ‘বাল্যবিয়ের পর এবং ২০ বছর হওয়ার আগে যদি কোনো মেয়ে গর্ভধারণ করে সেক্ষেত্রে যে সন্তান হয় সেটা অপরিণত কিংবা প্রতিবন্ধী হতে পারে। যেমন : কানে কম শোনা, ফুসফুসে সমস্যা, ঠিকমতো বেড়ে না ওঠা, রোগাপাতলা, খিঁচুনিসহ আরো অনেক সমস্যা হতে পারে। যত কম বয়সে গর্ভধারণ করবে এর ঝুঁকি ততই বেশি থাকবে। বাংলাদেশে মাতৃমৃত্যু এবং শিশু মৃত্যুর হার বেশি হওয়ার পিছনে অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে কম বয়সে গর্ভধারণ করা। সন্তান প্রসবের সময় দেখা যায় অল্প বয়সী মায়েদের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হয়, পেলভিস ছোট হওয়ার কারণে মূত্রথলিতে সমস্যা হতে পারে এবং প্রসবের পর দীর্ঘ সময় অপুষ্টিতে ও রক্ত শূন্যতায় ভোগে মায়েরা। এর ফলশ্রুতিতে দেখা যায় যে অল্প বয়সী মায়েদের শরীরে দীর্ঘমেয়াদি রোগ তৈরি হয়।’

’এছাড়াও অল্প বয়সী মায়েদের মানসিক স্বাস্থ্যে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। এর পেছনের একটি বড় কারণ হচ্ছে পারিবারিক চাপ। পরিবারের বিভিন্ন সদস্য আছে যারা এটিকে ভালোভাবে বুঝতে পারে না এবং শিশুর কিছু শারীরিক সমস্যা হলে পরোক্ষভাবে কিংবা প্রত্যক্ষভাবে মাকেই দায়ী করে তারা। এর জেরে আবার দেখা যায় মায়ের উপর শারীরিক মানসিক নির্যাতন শুরু হয়।’

তাছাড়া অল্প বয়সে বিয়ে হলে মা নিজের স্বাস্থ্য সম্পর্কেই সচেতন থাকে না তবে সন্তানের স্বাস্থ্য নিয়ে কতটুকু সচেতন হতে পারে? অল্প বয়সী মা ও শিশুদের এই সমস্যাগুলো থেকে উত্তরণের জন্য তৃণমূল পর্যায় থেকে শুরু করে একদম জাতীয় পর্যায় পর্যন্ত প্রত্যেকটা ক্ষেত্রেই স্বাস্থ্যবিষয়ক বেশি বেশি সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। যেন মেয়েদের ১৮ বছরের আগে বিয়ে না হয় এবং কেউ ২০ বছরের আগে কেউ যেন গর্ভধারণ না করে। কারণ সাধারণত মেয়েদের ১০ থেকে ১৯ বছর বয়স পর্যন্ত বয়ঃসন্ধিকাল চলে এবং এই সময়ে মেয়েদের শরীরে প্রজনন স্বাস্থ্য সুগঠিত হয়। এছাড়াও এই সময় নানা ধরনের শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তন হয় যেমন বেশি বেশি সাদাস্রাব বা হোয়াইট ডিসচার্জ হয় এবং বিভিন্ন কারণে শারীরিকভাবে দুর্বল থাকে যা বিয়ের জন্য অনুপযুক্ত সময়। ১৮ বছরে বিয়ে হলেও ২০ বছরের আগে যেন কেউ গর্ভধারণ না করে এবিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। এজন্য আমি বলবো বাল্যবিয়ের বিষয়ে বেশি বেশি সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে এর কুফল তুলে ধরতে হবে । এতে করে দেখা যাবে বাল্যবিয়ের ঘটনাও ঘটবে না এবং উপযুক্ত সময়ে গর্ভধারণ করলে মা ও শিশু উভয়ই ভালো থাকবে।’

শিক্ষাক্ষেত্রে মেয়েরা

ইউনিসেফের প্রতিবেদন বলছে, বাংলাদেশের মেয়েদের ১৮তম জন্মদিনের আগেই অর্থাৎ ১৭ বছর বয়সেই ৫১ শতাংশ মেয়ে বাল্যবিবাহের শিকার হয়। সাধারণত এই বয়সে মেয়েরা মাধ্যমিক এবং উচ্চমাধ্যমিকে পড়াশোনা করে। বিয়ের পর তাদের বেশির ভাগই পড়াশোনার সুযোগ পায় না ফলে স্কুল কলেজেও আর যাওয়া হয় না। আবার অনেকের দারিদ্রসহ নানা পারিবারিক সমস্যার কারণে পড়াশোনা করার সুযোগ হয় না তাদের মধ্যে আরো তাড়াতাড়ি বিয়ে হয়ে যায়। জীবিকার প্রয়োজনের জন্য অনেকে আবার পোশাকশিল্পের দিকে ঝুঁকে যায় এবং কেউ কেউ ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমের সাথেও জড়িত হয়ে যায়। ফলে তারা শিক্ষা বিমুখী হয়ে পড়ে।

বাংলাদেশ শিক্ষাতথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) তথ্য অনুযায়ী প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকে ছেলে ও মেয়েদের শিক্ষার সমতা মোটামুটি বজায় থাকলেও তবে উচ্চশিক্ষা কিংবা বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে মেয়ে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণের হার মাত্র ৩৬ শতাংশ। উচ্চশিক্ষায় মেয়েদের এই কম অংশগ্রহণের পিছনে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষের বিভিন্ন ধরনের বৈষম্যও আছে বলে ধারণা করা হয়।

প্রতি বছর মেয়েরা পাশের হার ও জিপিএ-৫ এ ছেলেদের তুলনায় এগিয়ে থাকলেও কিছু কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মেয়েদের জন্য কম আসন এবং ছেলেদের জন্য বেশি আসন নির্দিষ্ট করা থাকে।

এছাড়াও দেশের বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আবাসিক হলের বৈষম্য রয়েছে। ভর্তি হওয়ার পর দেখা যায় অনেক মেয়ে আবাসিক হল পায়না। অনেক পরিবারই মেয়েকে হোস্টেলে রেখে পড়ানোর ক্ষেত্রে অর্থের অভাবে পিছিয়ে যান এবং নিরাপত্তা নিয়েও দ্বিধায় থাকেন। এর ফলস্বরূপ অনেক মেয়ে শিক্ষার্থী স্বপ্নের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পেলেও স্বপ্নটা অপূর্ণ থেকে যায় এবং তারা পিছিয়ে পড়ে।

দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছেলেদের জন্য ১৪টি আবাসিক হল রয়েছে এবং মেয়েদের জন্য মাত্র ৫টি আবাসিক হল রয়েছে।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছেলেদের জন্য ১১টি আবাসিক হল রয়েছে এবং মেয়েদের জন্য ৬টি আবাসিক হল রয়েছে।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ছেলেদের জন্য ৮টি আবাসিক হল রয়েছে এবং মেয়েদের জন্য ৪টি আবাসিক হল রয়েছে।

শুধু তাই নয়, যে সকল মেয়েরা বিবাহিত এবং অন্তঃসত্ত্বা তারা হলে থাকতে পারবে না এমন নিয়ম করা হয়েছে। কিন্তু বিবাহিত ছেলেদের ক্ষেত্রে সেই নিয়মের কোনো প্রয়োগ নেই। 

দেশের সর্বোচ্চ পর্যায়ের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে যদি এরকম বৈষম্য হয় তাহলে অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে তা কেমন বলার অপেক্ষা রাখে না। 

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. আবুল মনসুর আহমেদ জানান, ‘উচ্চশিক্ষায় মেয়েদের অংশগ্রহণের হার কম কিন্তু পূর্বের যেকোনো সময়ের তুলনায় বর্তমান সময়ে মেয়েদের অংশগ্রহণ বেড়েছে। এটা ক্রমান্বয়ে বাড়ছে এবং ধীরে ধীরে আরো বাড়বে। প্রতি বছর ভর্তি প্রক্রিয়ার সময় আমরা খেয়াল করি পূর্ববর্তী বছরের তুলনায় নতুন বছরে মেয়ে শিক্ষার্থীদের সংখ্যা বাড়ছে। এটা এমন একটা প্রক্রিয়া যা রাতারাতি পরিবর্তন করা সম্ভব না। তবে আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নারী শিক্ষার্থীদের প্রতি খুবই আন্তরিক। তিনি নারী শিক্ষার্থী বাড়ানোর জন্য অনেক উদ্যোগ নিয়েছেন।’

‘পূর্বে নারী শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার ক্ষেত্রে পারিবারিক অনেক সমস্যা বেশি ছিল যেমন দারিদ্রতা ছিল, বাল্যবিয়ে হতো, নিরাপত্তা ঝুঁকি ছিল বর্তমানে সমস্যাগুলো অনেক কমে এসেছে। এখন প্রান্তিক অঞ্চলের মানুষগুলোও সচেতন হচ্ছে এবং সেসব অঞ্চলের শিক্ষার্থীদের সংখ্যাও উচ্চ পর্যায়ে বাড়ছে। যখন বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যাত্রা শুরু করেছিল তখন নারী শিক্ষার্থীদের সংখ্যা খুবই কম ছিল এবং ছেলে শিক্ষার্থীদের সংখ্যা বেশি ছিল যা বর্তমানে সমতার দিকে আসছে। যেহেতু আগের তুলনায় মেয়ে শিক্ষার্থীদের সংখ্যা প্রতিনিয়ত বাড়ছে তাই নতুন হল তৈরি করার জন্যও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ প্রকল্প হাতে নিয়েছেন। এছাড়াও হল তৈরি করার আগে বিভিন্ন নিয়ম অনুসরণ করতে হয়, প্রয়োজনীয় জায়গা লাগে এবং সরকারের আর্থিক সাহায্য সহযোগিতা লাগে। যেহেতু বাংলাদেশ একটি অধিক জনসংখ্যার দেশ চাইলেও তো সব সমস্যার সমাধান করা সম্ভব হয় না। মেয়ে শিক্ষার্থীদের হল কমের কারণে কিছুটা সমস্যা হচ্ছে তবে সেটা থেকে উত্তরণের জন্য নানা ধরনের কাজ করা হচ্ছে।’

‘প্রাথমিক মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিকের পাশাপাশি কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ও শিক্ষার হার বৃদ্ধির জন্য সরকার বিভিন্ন ধরনের স্কলারশিপ দিচ্ছে যেমন বঙ্গবন্ধু স্কলারশিপসহ আরো অনেক ধরনের স্কলারশিপ।’

‘ফলে নারী শিক্ষার্থীরা আরো সুযোগ পাচ্ছে উচ্চ শিক্ষার জন্য। যেসব শিক্ষার্থী উচ্চ শিক্ষার জন্য দেশের বাইরে যাচ্ছে তাদের মধ্যে কিন্তু নারী শিক্ষার্থীদের সংখ্যা আগের তুলনায় আরো বেড়েছে।’

‘আমি বলবো শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে শুরু করে শিক্ষা প্রশাসনে যারা আছেন তারা সকলে যেন নারী শিক্ষার্থীদের প্রতি অগ্রাধিকার দেন। আর ছেলে কিংবা মেয়ে হিসেবে নয় সন্তান হিসেবে পরিবারকে দেখতে হবে। কারণ আমাদের সমাজে এখনো নারীরা বিভিন্নভাবে শোষিত-অবহেলিত-বঞ্চিত। এগুলো থেকে উত্তরণের জন্য সকলকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে।’

খেলাধুলায় মেয়েরা

ক্রিকেট কিংবা ফুটবল খেলার নাম শুনলেই আমাদের মনে আসতেই পারে এগুলো ছেলেদের খেলা। সকলেই প্রায় ছোট থেকে সেটাই দেখে এসেছি। কারণ আমাদের দেশে খেলাধুলায় ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের অংশগ্রহণ খুবই কম। অনেকেই মনে করেন খেলাধুলায় মেয়েদের কম অংশগ্রহণ করার পেছনের কারণগুলো হতে পারে সামাজিক রীতিনীতির প্রভাব, নিরাপত্তাহীনতা, দারিদ্রতা ও লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্য ইত্যাদি। তারপরও বাংলাদেশের মেয়েরা পিছিয়ে যায়নি তারা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে খেলাধুলায় অসামান্য সাফল্য অর্জন করেছে। ক্রিকেট , ফুটবল সহ অন্যান্য খেলাতেও আন্তর্জাতিক রেকর্ড করেছে বাংলাদেশের মেয়েরা। 

সর্বশেষ চলতি বছরের ৯ ফেব্রুয়ারি সাফ অনূর্ধ্ব- ২০ মহিলা চ্যাম্পিয়নশিপে নেপালকে ৩-০ গোলের ব্যবধানে হারিয়ে শিরোপা জিতে বাংলাদেশ মহিলা ফুটবল দল। এর আগে ২০২২ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর সাফ মহিলা চ্যাম্পিয়নশিপে নেপালকে ৩-১ গোলের ব্যবধানে হারিয়ে প্রথমবারের মতো শিরোপা অর্জন করে বাংলাদেশ মহিলা ফুটবল দল। ২০২১ সালের ২২ ডিসেম্বর সাফ অনূর্ধ্ব ১৯ মহিলা ফুটবল দলের ফাইনালে ১-০ গোলের ব্যবধানে ভারতকে হারিয়ে অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হয় বাংলাদেশ মহিলা ফুটবল দল। এছাড়াও পূর্বে বাংলাদেশ মহিলা ফুটবল দলের নানা সাফল্য রয়েছে। ফুটবলের পাশাপাশি একই সাথে বাংলাদেশ মহিলা ক্রিকেট দলেরও জাতীয় আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নানা ধরনের সুনাম ও সাফল্য রয়েছে।

চলতি বছরের গত ২৫ সেপ্টেম্বর এশিয়ান গেমসে পাকিস্তানকে ৫ উইকেটে হারিয়ে ব্রোঞ্জ পদক জিতে বাংলাদেশ মহিলা ক্রিকেট দল। ২০১৮ সালে ভারতকে ৩ উইকেটে হারিয়ে মহিলা টি-টোয়েন্টি এশিয়া কাপ চ্যাম্পিয়ন হয় বাংলাদেশ মহিলা ক্রিকেট দল। এছাড়াও ২০১৮ ও ২০১৯ সালে আইসিসি নারী টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের বাছাই পর্বে টানা দুইবার চ্যাম্পিয়ন হয় মহিলা ক্রিকেট দল । এছাড়াও হ্যান্ডবল, ভলিবল, ব্যাডমিন্টন, আর্চারি, ভারোত্তোলন, বাংলাদেশের মেয়েরা সব খেলাতেই এখন আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ছাপ রাখছে।

খেলাধুলার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের মেয়েদের সুযোগ- সুবিধা কম হওয়ায় এবং মেয়েদের খেলাধুলায় অন্তর্ভুক্ত করতে ইউনিসেফ বাংলাদেশ ও বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন (বিএফএফ) যৌথভাবে ১২ থেকে ১৬ বছর বয়সী মেয়েদের জন্য একটি উচ্চবিলাসী দেশব্যাপী ফুটবল প্রতিভা অন্বেষণ অভিযান চালু করেছে। জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ে যারা বিজয়ী হয়ে জাতীয় পর্যায়ে বিজয়ী হবে তাদেরকে তাদের আরো প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে এবং একসময় তাদেরকে জাতীয় মহিলা ফুটবল দলে খেলার সুযোগ পাবেন বলে জানানো হয়েছে।

এছাড়াও দেশে স্থানীয় পর্যায়ে কিছু ক্রীড়া সংগঠন আছে যারা মেয়েদেরকে বাল্যবিয়ের হাত থেকে বাঁচাতে এবং তাদের ক্ষমতায়নের জন্য খেলাধুলায় অংশগ্রহণ করায় এবং বিনামূল্যে প্রশিক্ষণ দেয়।

এরকম একটি সংগঠন হচ্ছে রংপুর উইমেনস ক্রিকেট একাডেমি। খেলাধুলায় মেয়েদের অংশগ্রহণ কম সম্পর্কে জানতে চাইলে এ বিষয়ে সাম্প্রতিক দেশকালকে জয়বাংলা ইয়ুথ অ্যাওয়ার্ড প্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান ‘উইমেনস ক্রিকেট একাডেমীর’ প্রতিষ্ঠাতা আরিফা জাহান বিথি জানান, অন্যান্য পেশার মতো ক্রিকেট খেলাটাও একটা পেশা প্রায় শতকরা ৯০ ভাগ মানুষ এটা বিশ্বাস করে না। তারা মনে করে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার কিংবা সরকারি চাকরির মতো এটার কোন ভবিষ্যৎ নেই। তবুও আগের তুলনায় মেয়েরা খেলাধুলায় অনেক এগিয়ে গেছে। আগের তুলনায় বেতন-ভাতায় বৈষম্যও অনেকটুকু কমেছে। পারিবারিক ও সামাজিক অসচেতনতার অভাবে অনেক মেয়েরা খেলাধুলায় পিছিয়ে আছে। কোন মেয়ে যদি নিজে থেকেও কোনো খেলায় অংশগ্রহণ করলেও পরিবার থেকে তেমন একটা সাপোর্ট পায় না। তখন স্বাভাবিক ভাবেই মেয়েটা হাল ছেড়ে দেয়। আমরা যখন কোন গ্রামে মেয়েদের ক্রিকেট প্রশিক্ষণ দিতে যায় তখন দেখা যায় অনেকে মেয়েদের ক্রিকেট খেলার বিষয়টি জানেই না।’

‘অনেকেই বলে ‘ওইটা তো ছেলেদের খেলা মেয়েরাও খেলে নাকি’ আমি মনে করি এ বিষয়ে সরকারকে আরো সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টির পাশাপাশি বেশি বেশি প্রচার-প্রচারণা চালানো উচিত । দেখা যায় বছরের বিভিন্ন সময় ছেলেদের জন্য আইপিএল, বিপিএল সহ বিভিন্ন ধরনের টুর্নামেন্টের আয়োজন করা হয় কিন্তু মেয়েদের ক্ষেত্রে সেটা হয়না। এছাড়াও ছেলেদের খেলার সময় বিভিন্ন টিভি চ্যানেল গুলো লাইভ প্রচার করে মেয়েদের ক্ষেত্রে এগুলো খুব কম দেখা যায়। মেয়েদের খেলাধুলা সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি করলে এবং যথেষ্ট সুযোগ-সুবিধা দিলে মেয়েরাও খেলায় অংশগ্রহণ করবে এবং স্বনির্ভর হয়ে উঠবে। যা সমাজে নারীর ক্ষমতায়নে যথেষ্ট ভূমিকা রাখবে বলে মনে করি।’

কর্মক্ষেত্রে ও বেতন বৈষম্যে মেয়েরা

বিশ্বের যেসব দেশ উন্নত দেশের কাতারে দাঁড়িয়েছে তারা প্রত্যেকেই নারী-পুরুষের সমতা নিশ্চিত করেছে। নারী ও পুরুষের সমতা ছাড়া একটি দেশের উন্নয়ন সম্ভব নয়। ২০২০ সালের ৮ ই মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবসে বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০৪১ সালের মধ্যে সকল কর্ম ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের অংশগ্রহণ ৫০-৫০ এ উন্নীত করার ঘোষণা দেন। এছাড়াও জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা সমূহের অন্যতম একটি লক্ষ্যমাত্রা হচ্ছে লিঙ্গ সমতা। বাংলাদেশসহ বিশ্বের প্রায় সকল দেশকে ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রাগুলো অর্জনের জন্য জাতিসংঘ থেকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। তবে লক্ষ্যমাত্রাগুলো অর্জনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে রয়েছে। বাংলাদেশে নারী-পুরুষের মধ্যে এখনো অনেক বৈষম্য রয়েছে।

জনশুমারি ও গৃহগণনা ২০২২ অনুযায়ী, দেশে মোট নারীর সংখ্যা ৮ কোটি ৫৬ লাখ যা মোট পুরুষের তুলনায় ১৬ লাখ বেশি। কিন্তু সেই তুলনায় কর্মক্ষেত্রে বাড়েনি নারীর অংশগ্রহণ। 

স্ট্যাটিসটিকস অব সিভিল অফিসার্স অ্যান্ড স্টাফস ২০২১ প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশের সরকারি চাকরিজীবীর সংখ্যা ১৫ লাখ ৫৪ হাজার ৯২৭ জন। তাদের মধ্যে নারী ৪ লাখ ৪ হাজার ৫৯১ জন, যা মোট চাকরিজীবীর প্রায় ২৬ শতাংশ।

শিক্ষকতা: বাংলাদেশের একটি অন্যতম পেশা হচ্ছে শিক্ষকতা। বাংলাদেশের সম্মানজনক পেশাগুলার মধ্যে শিক্ষকতা একটি। এই পেশাটি প্রায় অধিকাংশ মানুষের কাছে প্রিয় বিশেষ করে মেয়েদের কাছে।

প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রকাশিত বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী দেশের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মোট শিক্ষকের সংখ্যা ৬ লাখ ৫৭ হাজার ১৯৩ জন। এরমধ্যে নারী শিক্ষাগত সংখ্যা ৪ লাখ ৩ হাজার ১৮১ জন এবং পুরুষ শিক্ষকের সংখ্যা ২ লাখ ৫৪ হাজার ১২ জন। যা মোট শিক্ষকের ৬৪ শতাংশই নারী। তবে মাধ্যমিকে নারী শিক্ষকের হার ২৮ শতাংশ এবং কলেজ পর্যায়ে ২৬ শতাংশ। 

ব্যাংক খাত : বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত দেশের মোট ৬১টি ব্যাংক মোট জনবল রয়েছে ১ লাখ ৯৯ হাজার ৫০৬ জন। এর মধ্যে নারী কর্মীর সংখ্যা সংখ্যা ৩২ হাজার ৫৬৭ জন। যা মোট জনবলের ১৬. ৮৬ শতাংশ।

পুলিশ: পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) এর ২০২২ সালে ৩০ নভেম্বর দেওয়া এক বক্তব্য অনুযায়ী দেশে মোট পুরুষের সংখ্যা ১ লাখ ৮৯ হাজার ৭৯৯ জন। এদের মধ্যে নারী পুলিশের সংখ্যা মাত্র ১৫ হাজার ৫৬১ জন। যা মোট পুলিশের মাত্র ৮.১৯ শতাংশ। কিন্তু জাতিসংঘ সদস্যভুক্ত দেশগুলোকে শান্তিরক্ষা মিশনের জন্য কমপক্ষে ৪০ শতাংশ নারী পুলিশ পাঠানোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। সে অনুযায়ী বাংলাদেশ নারী পুলিশ সদস্যের সংখ্যা খুবই কম।

পোশাক শিল্প: দেশে মোট রেমিট্যান্সের একটি অন্যতম উৎস আছে পোশাক শিল্প থেকে। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) এর তথ্য অনুযায়ী, রপ্তানি আয়ের প্রায় ৮২ শতাংশ রেমিট্যান্স আসে পোশাক শিল্প থেকে।

ব্রেক ইউনিভার্সিটির সেন্টার ফর এন্টারপ্রেণারশিপ ডেভেলপমেন্ট বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, দেশে মোট পোশাক শিল্পে কর্মরত আছেন ২৫ লাখ নারী পুরুষ। এর মধ্যে ১৫ লাখ নারী আছেন যা মোট সংখ্যার ৫৮ শতাংশ এবং দশ লাখ পুরুষ আছেন যা মোট সংখ্যার ৪২ শতাংশ।

একই চাকরিতে একজন পুরুষ যত টাকা বেতন পান একজন মহিলারাও ততো টাকা বেতন পাওয়ার কথা। কিন্তু দেশে সরকারি চাকরি ব্যতীত প্রায় সকল ধরনের বেসরকারি চাকরিতে বেতন বৈষম্য লক্ষ্য করা যায় মেয়েদের ক্ষেত্রে। 

আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) এর প্রকাশিত প্রতিবেদন ২০২২ এ দেখা যায় কর্মক্ষেত্রে পুরুষের তুলনায় ২০ শতাংশ কম বেতন পান নারীরা। শিক্ষাগত যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও কম বেতন পাওয়া নারীদের মধ্যে ৯৮শতাংশই লিঙ্গ বৈষম্যের কারণে কম বেতন পান। প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, শুধু লিঙ্গ বৈষম্যের কারণে কর্মক্ষেত্রে নারী ও পুরুষের মধ্যে বড় ধরনের বৈষম্য তৈরি হয়েছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন নারী বালুশ্রমিক সাম্প্রতিক দেশকালকে জানান, সারাদিন পুরুষের সমান কাজ করেও তিনি পান ৪০০ টাকা আর একজন পুরুষ শ্রমিক পান ৫০০ টাকা। বিভিন্ন সময় খারাপ কথা-বার্তা তো আছেই। জীবিকার প্রয়োজনে এক প্রকার বাধ্য হয়ে কাজ করতে হয় বলে জানান।

শুধু কর্মক্ষেত্রেই নয় সরকারি- বেসরকারি ক্রীড়া প্রতিষ্ঠানগুলোতেও রয়েছে নারী-পুরুষের মধ্যে বেতন বৈষম্য। ক্লাব বেদে যেখানে জাতীয় দলের একজন পুরুষ ফুটবলার বাৎসরিক আয় করেন ৩০ থেকে ৯০ লাখ টাকা। সেখানে একজন নারী ফুটবলার বাৎসরিক আয় করেন ৩ থেকে ৮ লাখ টাকা। নারী ফুটবলারের ক্ষেত্রে এই টাকাও পাচ্ছে উপরের স্তরের নারী ফুটবলাররা।

নারী ফুটবলারদের থেকেও বেশি বেতন বৈষম্য লক্ষ্য করা যায় নারী ক্রিকেটারদের ক্ষেত্রে। এ 'প্লাস' ক্যাটাগরির একজন পুরুষ ক্রিকেটার মাসিক বেতন ১০ লাখ টাকারও বেশি। কিন্তু সেই তুলনায় একজন নারী ক্রিকেটার পান সর্বসাকুল্যে ৮০ হাজার টাকা। দেশের উচ্চ পর্যায়ের ক্রীড়া প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্ষেত্রেই যে বেতন বৈষম্য দেখা যায় নিচের পর্যায়ের সংস্থাগুলোর ক্ষেত্রে এবং বেসরকারি কর্মক্ষেত্রগুলোতে কি ধরনের বৈষম্য রয়েছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। 

এ বিষয়ে কর্মজীবী নারী ফাউন্ডেশনের পরিচালক সানজিদা সুলতানা জানান, যেখানে বৈষম্য হবে সেখানেই নারীকে প্রতিবাদীর ভূমিকা পালন করতে হবে। বাংলাদেশের যেসব নারী কর্মজীবী আছে তাদের মধ্যে প্রায় ৯২ শতাংশ নারী অনানুষ্ঠানিক খাতে চাকরি করেন। সরকারি খাতে কিংবা আনুষ্ঠানিক খাতে কিন্তু বৈষম্যটা নেই এই বৈষম্যটা অনানুষ্ঠানিক খাতেই রয়েছে। সেখানেই দেখা যায় নারীরা বেতন বৈষম্যের শিকার হচ্ছে, পদোন্নতি হচ্ছে না ইত্যাদি ইত্যাদি নানা সমস্যা রয়েছে। আর যদি সরকারি প্রতিষ্ঠানে এসব বৈষম্য হয় আমি বলবো এটা সরকারের বড় ব্যর্থতা।

শুধু কিন্তু নারীরা নয় পুরুষও কিন্তু বেতন বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। তাদের ক্ষেত্রেও বেতন কম দেওয়া হয়, এক মাসেরটা আরেক মাসে দেওয়া হয়। তবে নারীদের ক্ষেত্রে বৈষম্যটা বেশি হয়। সরকার যদি এসব বিষয় নিয়ে সচেতন হতো তাহলে কিন্তু সহজেই এই সমস্যাগুলোর সমাধান করতে পারতো। প্রায় প্রায় বলা হয় যে চাকরির জন্য দক্ষ জনশক্তি পাওয়া যায় না। আসলে মেয়েদের প্রশিক্ষণের সুযোগটাই দেওয়া হচ্ছে না। আগেই তাদের বলা হয় মেয়ে মানুষ এটা পারবে না, ওটা পারবে না। তাহলে মেয়েরা দক্ষ হয়ে উঠবে কিভাবে? আবার অনেকেই মনে করে মেয়ে মানুষ সন্তান জন্ম দিবে, স্কুলের শিক্ষক, নার্স এগুলো হবে এগুলো ছাড়া ভাবতেই পারে না যে মেয়ে একজন পাইলট হতে পারে, একজন ইঞ্জিনিয়ার হতে পারে, একজন ডাক্তার হতে পারে,একজন সচিব হতে পারে। আমাদের সমাজে এই ভাবনাগুলো এখনো অনেকের মধ্যেই আছে। আর সেই ভাবনাগুলো মেয়েদের সামনে এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

সরকার সকল কর্মক্ষেত্রে নারী-পুরুষের অনুপাত ৫০-৫০ করার ঘোষণা দিয়েছে। এজন্য সরকার বিভিন্ন ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছে এবং তা বাস্তবায়নের জন্য কাজ করছে। এখন দেখা যাক সরকার কতটুকু সফল হতে পারে। একই সাথে আমি ওটা পারিনা, আমি ওটা পারবোনা মেয়েদেরকে এসব চিন্তা-ভাবনা বাদ দিতে হবে এবং এগিয়ে আসতে হবে।

যৌন নির্যাতনের শিকার মেয়েরা

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সম্প্রতি প্রকাশিত ২০২২ সালের শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী, দেশে মোট কর্মজীবী মানুষের সংখ্যা ৭ কোটি ৩৪ লাখ ১০ হাজার। এরমধ্যে কর্মজীবী নারীর সংখ্যা ২ কোটি ৫৯ লাখ ৩ হাজার। তারা প্রত্যেকেই সরকারি এবং বেসরকারি কর্মক্ষেত্রের নানা শাখায় জড়িত। তাদের মধ্যে বেশিরভাগ কর্মজীবী নারী কোনো না কোনোভাবে তাদের কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি ও যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। অনেকেই যৌন নির্যাতন বিষয়টা বোঝে না এ বিষয়ে তাদের অনেক অজ্ঞতা রয়েছে। তারা যৌন নির্যাতন বলতে শুধু নারীর যৌনাঙ্গে নির্যাতন কিংবা ধর্ষণকে বোঝেন। আবার কিছু মানুষের এ বিষয়ে ধারণা থাকলেও অনেক সময় চাকরি হারানোর ভয়ে প্রতিবাদ করতে ভয় পায়।

ব্র্যাক ইন্সটিটিউট অব গভর্নেন্স এন্ড ডেভেলপমেন্ট (বিআইজিডি) এর প্রকাশিত ২০২২ সালের জরিপ অনুযায়ী, কারখানায় নারীকর্মীদের শতকরা ২০ শতাংশ যৌন নির্যাতন ও হয়রানির শিকার হন এবং গৃহকর্মে সেটা ৩০ শতাংশ। নির্যাতনের শিকার এসব নারীদের প্রায় ৯০ শতাংশ কোনো প্রতিবাদ করছে না এবং আইনি ব্যবস্থা নিচ্ছে না।  

বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন বলছে, কর্মক্ষেত্র আইনের সুরক্ষায় ১৯০ টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৭১ তম।

সরকারি বেসরকারি কর্মক্ষেত্রের পাশাপাশি পারিবারিকভাবেও নারীরা যৌন হয়রানি ও যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। 

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের তথ্য বলছে, বিয়ের পর যেসব নারী নির্যাতনের শিকার হচ্ছে তাদের মধ্যে ৮৩ শতাংশই যৌতুকের জন্য নির্যাতিত হচ্ছে।

বিয়ের পর ছেলে সন্তান জন্ম নিলে শুধু গ্রাম অঞ্চলের পরিবার নয় বরং শহর অঞ্চলের অনেক পরিবারও খুশি হয় এবং গর্ববোধ করে। আর কন্যা সন্তান হলেই মায়ের প্রতি নেমে আসে মানসিক ও শারীরিক নানা নির্যাতন। তবে সকল পরিবারে নয়। 

বছর দুয়েক আগের ঘটনা, বিয়ের পর এক এক করে তিনটি কন্যা সন্তান জন্ম দেওয়ায় বরিশালের মেহেন্দিগঞ্জে পারভিন আক্তার নামে একজন গৃহবধূকে যৌনাঙ্গে নির্যাতন করে হত্যা করা হয়। এসব ঘটনা আরো ঘটেছে এবং এখনো ঘটছে। অনলাইন নিউজ পোর্টালে প্রবেশ করলেই এসব ঘটনা প্রায়ই দেখা যায়।

যৌন নির্যাতনের হাত থেকে বাঁচতে পারছে না ছোট ছোট শিশুরাও।

চলতি বছরের ১৭ ই সেপ্টেম্বর চট্টগ্রামে ৭ বছর বয়সী প্রথম শ্রেণীর এক মাদ্রাসা ছাত্রীকে বাসায় ঢুকে ধর্ষণের পর শ্বাসরোধ করে হত্যা করে রাকিবুল ইসলাম মুন্না নামে এক যুবক।

গত বছরের ১৮ ই নভেম্বর নাটোরের গুরুদাসপুর এর ১১ বছর বয়সী চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্রীকে খালি বাসায় ৬৩ বছর বয়সী প্রতিবেশী কথিত দাদা জাহিদুল ইসলাম ধর্ষণ করে এবং পরে মেয়েটি অন্তঃসত্ত্বা হয়ে যায়। 

জাতীয় কন্যা শিশু অ্যাডভোকেসি ফোরাম এর তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে আগস্ট মাস পর্যন্ত ধর্ষণের শিকার হয়েছে ৪৯৩ জন কন্যা শিশু।

সবথেকে বেশি কষ্টের কথা হচ্ছে যৌন নির্যাতনের হাত থেকে নারীর মৃত লাশটিও মাঝে মাঝে রক্ষা পায় না। গত বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে ৩২ বছর বয়সী মা ও ১২ বছর বয়সী মৃত মেয়েকে ময়নাতদন্তের জন্য চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের লাশ ঘরে রাখা হয়। সেখানে মো. সেলিম নামের এক পাহারাদার সেই লাশগুলোর সাথে শারীরিক সম্পর্ক করে। পরে পুলিশ তাকে গ্রেফতার করলে তিনি অভিযোগ স্বীকার করেন।

একই ঘটনা ঘটেছিলো ২০২০ সালেও রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের লাশ কাটাঘরের ডোম মুন্না নামে এক যুবক ৬ জন মৃত নারীকে ধর্ষণ করে। ডিএনএ টেস্ট করার পর সত্যতা খুঁজে পেলে সিআইডি পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে। 

চলতি বছরের ১৬ ই জুন ময়মনসিংহের ভালুকায় ধর্ষকদের হাত থেকে বাঁচতে চলন্ত বাস থেকে লাফ দেয় এক গার্মেন্টস কর্মী। পরে আহত হয়ে দুদিন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। এসব ঘটনার আরো অনেক নজির রয়েছে।

বাংলাদেশ পুলিশ সদর দপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, ২০২২ সালে সারাদেশে ধর্ষণের মামলা হয়েছে ৪ হাজার ৭৬২টি এবং নারীর প্রতি বিভিন্ন ধরনের নির্যাতনের মামলা হয়েছে ৯ হাজার ৭৬৮ টি। এর মধ্যে ঢাকায় ধর্ষণ মামলা হয়েছে ৫২৩টি এর মধ্যে ৯৩ জন শিশু।

আইন ও সালিশ কেন্দ্রে তথ্য সংরক্ষণ ইউনিটের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২২ সালে সারাদেশে ধর্ষণ ও সঙ্ঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছে ৯৩৬ জন নারী ও ৫৬০ জন শিশু। এর মধ্যে ধর্ষণ পরবর্তী হত্যার শিকার হয়েছেন ৪৭ জন নারী এবং আত্মহত্যা করেছেন ৭ জন নারী। 

কর্মক্ষেত্রে ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের যৌন হয়রানি প্রতিরোধে ২০০৯ সালে বেশ কিছু নির্দেশনা দেয় হাইকোর্ট। এতে প্রতিষ্ঠানগুলো এই বিষয়ে প্রচারণা চালানো, অভিযোগ কমিটি গঠনসহ বেশ কিছু পদক্ষেপের কথা বলা হয়। কিন্তু প্রায় ১৪ বছর পার হয়ে গেলেও অনেকেই এই বিষয়ে কিছুই জানে না।  

অ্যাকশন এইডের তথ্য বলছে, শিক্ষার্থীদের ৮৭ শতাংশ এবং কর্মজীবী মানুষের ৬৪.৫ শতাংশ হাইকোর্টের এসব নিদর্শনা বিষয়ে কিছুই জানেনা।

এ বিষয়ে সাম্প্রতিক দেশকালকে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক অ্যাড. মাসুদা রেহানা বেগম জানান, দুই- তৃতীয়াংশ মেয়ে প্রথমবার কিন্তু তার পরিবার কিংবা কাছের মানুষদের দ্বারায় যৌন নির্যাতনের শিকার হয়। কিন্তু মেয়েটি এই কথাটা কারোর সাথে বলতে পারেনা কারণ তার মা নিজেই তাকে মুখ বন্ধ রাখতে বাধ্য করে। অনেক মা ভাবে কথাটি বললে কলঙ্ক হবে কোথাও বিয়ে হবেনা। এখানে মেয়েদের কলঙ্ক কেন হবে? কলঙ্ক হবে সেই অমানুষটার যে বাজে কাজটা করে।

রাস্তাঘাটে মেয়েরা যদি ইভটিজিং এর শিকার হয় সেটাও যদি বাবা মাকে বারবার বলে তাহলে তখন বাবা- মারাও একসময় বিরক্ত হয়ে যায় তখন মেয়েকেই দোষারোপ শুরু করে। এটা যে এক ধরনের অন্যায় এটা কিন্তু অনেক পরিবারই ভাবছে না। প্রতিবাদ না করায় এসব অপরাধ আরো বেড়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ সবসময় বিশ্বাস করে যে, নারী নির্যাতন বা নারীর প্রতি যেকোনো ধরনের সহিংসতা প্রতিরোধ করার জন্য নিজেকে সচেতন হতে হবে,পরিবারকে সচেতন হতে হবে, সমাজকে সচেতন হতে হবে এবং রাষ্ট্রকে এগিয়ে আসতে হবে। এছাড়া স্কুল-কলেজে এবং সকল ধরনের প্রতিষ্ঠানে এটা নিয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে।

নারীও যে একজন মানুষ এই বোধটাকে এই সমাজে জাগ্রত করতে হবে। এখনো আমাদের সমাজব্যবস্থায় নারীকে পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে না তাদের অর্ধ মানুষ হিসেবে দেখা হচ্ছে। কোন মেয়ে যদি ধর্ষণের শিকার হয় তখন যদি পরিবার তাকে বিয়ে দিয়ে দেয় তাহলে কি মেয়েটা স্বাভাবিকভাবে জীবন যাপন করতে পারবে? উত্তর না তার মনের মধ্যে সবসময় এক ধরনের ভয় কাজ করবে। যারা ফুলের মতো পবিত্র শিশুদের ধর্ষণ করে মৃত লাশকেও রেহাই দেয়না তারা আর যাইহোক মানুষ হতে পারে না। বিবেকহীন মানুষকে পশুর সাথে তুলনা করা হয় আমি বলবো যারা এসব কাজ করে তারা জানোয়ারের চেয়েও নিকৃষ্ট।

দেশে আইন আছে আইনের দুর্বলতা নেই কিন্তু আইন প্রয়োগের দুর্বলতা আছে। যার ফলে সুশাসনের অভাব দেখা দিচ্ছে। এখন যদি একটি মেয়ে ধর্ষণের শিকার হওয়ার পর আত্মহত্যা করে তার জীবনটাও নষ্ট হলো সেই সাথে তার পরিবারে যে দুঃখ - কষ্ট নেমে আসে একমাত্র সেই পরিবারই জানে। যতদিন না পর্যন্ত পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র মেয়েদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল না হবে পুরুষের মত একজন পরিপূর্ণ মানুষ না ভাববে ততদিন পর্যন্ত নারীর প্রতি এই অত্যাচার- সহিংসতা কমানো যাবে না।

এছাড়াও আমি বলবো আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে এসব বিষয়ে সবোর্চ্চ গুরুত্বসহকারে কাজ করতে হবে। যেন মেয়েরা তাৎক্ষণিক বিচার পায়। মেয়েদের ক্ষেত্রে পরিবারকে সম্পদের সমান ভাগ করে দিতে হবে। কেননা মেয়েরা অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী না হলেও অবহেলিত, শোষিত, বঞ্চনার শিকার হয়। তারা যদি অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হয় তাহলে তারা প্রতিবাদ করার সাহস পাবে অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে।

নারীকে মানুষ হিসেবে সমাজের প্রতিষ্ঠা করার জন্য সকল প্রকার কর্মসূচিতে নারীকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। প্রতিবাদ করলেই চাকরিটা চলে যায় বিষয়টা এমন নয়। কারণ চাকরি যাওয়াটা এত সোজা না এর জন্য একটা বড় শক্তিশালী আইন আছে। এই আইন সম্পর্কে অনেকেই জানেনা। কর্মক্ষেত্র হোক কিংবা অন্যান্য ক্ষেত্রে যেকোনো জায়গায় নারীরা নির্যাতন, বৈষম্যের শিকার হলে মুখ বন্ধ করে থাকা যাবে না কঠোর প্রতিবাদীর ভূমিকা পালন করতে হবে। আর পরিবার থেকেই এই শিক্ষাটা দিতে হবে। মনে রাখতে হবে, নারী-পুরুষের মধ্যে সমতা যদি না হয় তাহলে আমাদের সমাজ এগুবে না আর সমাজ না এগোলে আমাদের রাষ্ট্র এগুবে না।

অদম্য বাংলার মেয়েরা

বিশ শতকের শুরুর দিকে নারী শিক্ষার অগ্রদূত বেগম রোকেয়ার হাত ধরে বাংলায় নারী শিক্ষার প্রচলন শুরু হয়েছিল। এই নারী শিক্ষা ক্রমান্বয়ে বাড়ছেই যার ফলে আজ নারীদের ক্ষমতায়ন হচ্ছে। বাংলার ইতিহাসে প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার প্রথম নারী যিনি আমাদের শিখিয়েছিলেন নারীরাও দেশের জন্য আত্মাহুতি দিতে পারে। মাত্র ২১ বছর বয়সে তিনি পটাশিয়াম সায়ানাইড সেবন করে আত্মত্যাগ করেছিলেন তবুও ব্রিটিশদের কাছে আত্মসমর্পণ করেননি। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে ২ লক্ষ মা বোন সম্ভ্রম হারিয়েছিলেন। তারা প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য-সহযোগিতা করতেন। তাদের দেশপ্রেম, আদর্শ, স্বাধীনতার জন্য অসীম এই ত্যাগ বাংলার মানুষ চিরকাল শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবে। আগে যেসব নারী অত্যাচার, বঞ্চিত ও অবহেলিত হতো আজ তারা বিশ্ব জয় করছে। আজ নারীরা পাইলট হচ্ছে, ইঞ্জিনিয়ার হচ্ছে, বিজ্ঞানী হচ্ছে, ডাক্তার হচ্ছে, মন্ত্রী হচ্ছে, প্রধানমন্ত্রী হচ্ছে। আজ নারীদের অংশগ্রহণ সকল ক্ষেত্রেই রয়েছে যদিও সেটা পুরুষের তুলনায় কম। স্বাধীনতার ৫২ বছরে ৩০ বছরই দেশ পরিচালনা করছেন নারীরা। বিশ্বের ১০০ শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানীদের মধ্যে বাংলার ছেলেদের নাম না থাকলেও মেয়েদের নাম থাকে। বিশ্বের ১০০ প্রভাবশালী নারীর তালিকায় আজ বাংলার মেয়েরা স্থান পাচ্ছে। আজ নাসার বিজ্ঞানী হচ্ছে বাংলার মেয়েরা। মাউন্ট এভারেস্ট জয় করেছে মেয়েরা, অলিম্পিকে অংশগ্রহণ করছে মেয়েরা। আমাদের জাতীয় সংসদে ৭২ জন এমপি রয়েছে এবং মন্ত্রী পরিষদের চারজন সদস্য নারী রয়েছেন। তারপরেও আজ নারীরা বিভিন্ন ধরনের বৈষম্যের শিকার হচ্ছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন এন্ড স্টাডিজ বিভাগের প্রফেসর ড. তানিয়া হক মেয়েদের উদ্দেশ্য বলেন, পূর্বে মেয়েরা অনেক বঞ্চিত, অবহেলিত এবং নির্যাতিত হত। তারা আজ সেই অবস্থা থেকে বেরিয়ে এসেছে। এখনো মেয়েরা কিছুটা বঞ্চিত, নির্যাতিত। এজন্য মেয়েদের সর্বপ্রথম নিজেদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হতে হবে। প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকেই সচেতন হতে হবে এক্ষেত্রে আমাদের শিক্ষকরা একটি বড় ভূমিকা রাখতে পারে। এছাড়াও প্রত্যেকটা ঘরে ঘরে মায়েদের একটা বড় দায়িত্ব নিতে হবে তা হচ্ছে ছেলেদেরকে ছোট থেকেই এমন ভাবে তৈরি করতে হবে যেন ছোট থেকেই মেয়েদের সম্মান করে। মেয়েদের নিচু পর্যায়ের যেন মনে না করে। তবেই আমাদের সমাজ একদিন নারীদের জন্য নিরাপদ হবে।

মানবাধিকারের চোখে নারী, পুরুষ বা তৃতীয় লিঙ্গ সকলেই সমান। সকল ধরনের নির্যাতন ও বৈষম্যের বিরোধিতা করে মানবাধিকার। এগুলো দূর করার জন্য সর্বপ্রথম নিজেকে এবং পরিবারকে এসব পরিহার করতে হবে তবেই সমাজ থেকে দেশ থেকে সকল ধরনের অত্যাচার, নির্যাতন, বৈষম্য চলে যাবে। আর মেয়েদেরকে যথেষ্ট পরিমাণে সাহসী হতে হবে, প্রতিবাদী হতে হবে যেন তার দেখা দেখি আরো ১০ জন মেয়ে প্রতিবাদ করার সাহস পায় এটাই আমার প্রত্যাশা। মেয়েরা অনেক এগিয়ে এসেছে, এগিয়ে যাচ্ছে এবং ভবিষ্যতে আরো অনেক দূর এগিয়ে যাবে। কোনো বাধায় বাংলার অদম্য মেয়েদের আটকাতে পারবেনা। তারা ভবিষ্যতের পথে অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়ে যাবে ইনশাল্লাহ।

লেখক: প্রিয়া, শেরপুর সরকারি কলেজ, শেরপুর

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫