আন্তর্জাতিক অভিবাসী দিবস
হয়রানি মুক্ত অভিবাসন নিশ্চিত করতে হবে

ডা.মুহাম্মদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ
প্রকাশ: ১৮ ডিসেম্বর ২০২৩, ১৭:১৫

আন্তর্জাতিক অভিবাসী দিবস। ছবি: সংগৃহীত
আন্তর্জাতিক অভিবাসী দিবস আজ সোমবার (১৮ ডিসেম্বর)। ‘প্রবাসী কর্মীরা উন্নয়নের অংশীদার সমুন্নত রাখবো তাদের অধিকার’-এ প্রতিপাদ্যে আজ সারাদেশে পালিত হচ্ছে অভিবাসী দিবস।
২০০০ সালের ৪ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ সিদ্ধান্ত নেয় ১৮ ডিসেম্বর বিশ্বব্যাপী আন্তর্জাতিক অভিবাসী দিবস উদযাপন করা হবে।
এক দেশ থেকে আরেক দেশে পাড়ি জমানো মানুষদের আমরা বিভিন্ন নাম দিয়ে থাকি। এসব নাম প্রায়ই শুনে থাকি: প্রবাসী, অভিবাসী, শরণার্থী বা আশ্রয় প্রার্থী। আন্তর্জাতিক অভিবাসন হলো যখন মানুষ নিজ রাষ্ট্রের সীমানা অতিক্রম করে এবং গন্তব্য দেশে ন্যূনতম সময়ের জন্য অবস্থান করে। অভিবাসন অনেক কারণেই ঘটে। অন্য দেশে অর্থনৈতিক সুযোগের সন্ধানের জন্য অনেকে নিজের দেশে ছেড়ে চলে যায়। অভিবাসন করেছেন এমন পরিবারের সদস্যদের সাথে থাকতে অনেকে স্থানান্তরিত হয়। তাদের দেশে রাজনৈতিক অবস্থার কারণেও অভিবাসন হয়ে থাকে। যেহেতু শিক্ষার্থীরা বিদেশে পড়াশোনা করতে যায় তাই আন্তর্জাতিক অভিবাসনের আরেকটি কারণ শিক্ষা।
আন্তর্জাতিক অভিবাসীদের শ্রেণিবদ্ধ করার জন্য বিভিন্ন সম্ভাব্য ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও একটি ব্যবস্থা তাদের নয়টি দলে সংগঠিত করে: অস্থায়ী শ্রম অভিবাসী; অনিয়মিত অভিবাসী, অবৈধ বা অনিবন্ধিত অভিবাসী; অত্যন্ত দক্ষ এবং ব্যবসায়ী অভিবাসী; শরণার্থী; আশ্রয়প্রার্থী; জোরপূর্বক অভিবাসী; পরিবারের সদস্য; প্রত্যাবৃত্ত অভিবাসী এবং দীর্ঘমেয়াদী স্বল্প দক্ষ অভিবাসী। এই অভিবাসীদের স্থায়ী এবং অস্থায়ী দুটি বৃহৎ দলে ভাগ করা যায়। স্থায়ী অভিবাসীরা নতুন দেশে তাদের স্থায়ী বাসস্থান প্রতিষ্ঠা এবং সম্ভবত সেই দেশের নাগরিকত্ব অর্জনের উদ্দেশ্যে আসেন। অস্থায়ী অভিবাসীরা কেবলমাত্র সীমিত সময়ের জন্য থাকার উদ্দেশ্যে আসেন। তারা অধ্যয়নের কোনও নির্দিষ্ট প্রোগ্রাম, তাদের কাজের চুক্তি বা নির্দিষ্ট কাজের জন্য আসেন। উভয় ধরনের অভিবাসী বিদেশ এবং স্বদেশের অর্থনীতি এবং সমাজে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলে।
একইভাবে, যেসব দেশ এই অভিবাসীদের গ্রহণ করে তাদের চারটি বিভাগে বিভক্ত করা হয়: ঐতিহ্যবাহী বসতি দেশ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে শ্রম অভিবাসনকে উৎসাহিত করেছে এমন ইউরোপীয় দেশ, ইউরোপীয় দেশ যারা তাদের পূর্ববর্তী উপনিবেশগুলো থেকে অভিবাসী জনগোষ্ঠীর একটি উল্লেখযোগ্য অংশ গ্রহণ করে এবং যে দেশগুলো থেকে পূর্বে অনেকে অন্য দেশে যেত তবে সম্প্রতি অভিবাসীরা সেই দেশে আসে। এই দেশগুলো দুইভাবে গোষ্ঠীভুক্ত করা হয়। যথা, প্রবাসী-প্রেরণকারী ও অভিবাসী-গ্রহণকারী দেশ যাদের প্রশাসনের সমস্যা রয়েছে। তবে এইভাবে শ্রেণিবদ্ধ করাটি কৃত্রিম এবং এটি দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিষয়গুলোকে অস্পষ্ট করে তোলে।
প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বিশ্বের ১৬০টি দেশে প্রায় ৯০ লাখ বাংলাদেশি নাগরিক বিভিন্ন পেশায় কাজ করছেন। ২০০৯ থেকে ২০১৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ২৪ লাখ ৫১ হাজার ৯৩ জন বাংলাদেশি কর্মী চাকরি নিয়ে বিদেশে গেছেন। এর মধ্যে ১ লাখ ৭৪ হাজার ২১৩ জন নারী কর্মী। বর্তমানে বছরে প্রবাসী কর্মীদের পাঠানো রেমিট্যান্স প্রবাহের হার ৬১ দশমিক ৯০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, অর্থাৎ প্রায় ৬ হাজার ২০০ কোটি ডলার। যা বিগত সময়ের চেয়ে প্রায় সাড়ে তিন গুণ বেশি। যাদের অর্থে সচল আমারেদর অর্থনীতির চাকা তাদের সার্বিক কল্যাণ নিশ্চিত করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে মানবপাচার বিরোধী আইন কঠোরভাবে বাস্তবায়নের পাশাপাশি অভিবাসন ব্যয় সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনতে বিশ্বের সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে। বিদেশে যেতে আগ্রহী অভিবাসীদের কর্মের সুযোগ সৃষ্টিতে নতুন নতুন শ্রমবাজার অনুসন্ধানসহ অভিবাসনের ক্ষেত্রে প্রতারণারোধ, অভিবাসন ব্যয়হ্রাস, প্রশিক্ষণ, ঋণপ্রাপ্তিতে সহজকরণের মাধ্যমে অভিবাসীর অধিকার নিশ্চিত করা অত্যাবশ্যক। এছাড়াও বৈদেশিক কর্মসংস্থান ব্যবস্থাপনায় উন্নয়ন সাধন এবং নিরাপদ অভিবাসন প্রক্রিয়া সম্পর্কে জনসচেতনতা প্রবাসে কর্মরত বাংলাদেশি অভিবাসীদের সততা ও নিষ্ঠার মাধ্যমে অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রার সর্বোত্তম ব্যবহার বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি আরো উজ্জ্বল করতে পারে। তাই অভিবাসী নারী-পুরুষ ও তাদের পরিবারের সদস্যদের সার্বিক কল্যাণ নিশ্চিত করতে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।
পরিশেষে বলতে চাই, প্রাচীনকাল থেকেই জীবিকার সন্ধান, আর্থ-সামাজিক, জলবায়ু পরিবর্তনসহ নানা কারণে মানুষ পাড়ি জমাচ্ছে দেশ থেকে দেশান্তরে। তাই মানব সভ্যতার বিকাশে অভিবাসনের গুরুত্ব অপরিসীম। তাছাড়া বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের নানা ধর্ম-বর্ণের মানুষের মধ্যে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন সৃষ্টির মাধ্যমে পৃথিবীকে আরও বৈচিত্র্যময় ও বাসযোগ্য করে তোলার ক্ষেত্রেও অভিবাসী জনগোষ্ঠীর ইতিবাচক ভূমিকা রয়েছে। কিন্তু যুদ্ধ-বিগ্রহ ও ভূ-রাজনৈতিক নানা কারণে অভিবাসন আজ কঠিন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। অভিবাসীদের অধিকার ও স্বার্থ রক্ষায় বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক আইন, কনভেনশন ও সনদসমূহে বর্ণিত বিধানাবলীর যথাযথ প্রতিপালন অত্যন্ত জরুরি। হয়রানি মুক্ত অভিবাসন নিশ্চিত করতে সংশ্লিষ্ট সবার আন্তরিকতা একান্ত প্রয়োজন।
লেখক, কলাম লেখক ও গবেষক
প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি