লেখকের আদর্শ পাঠক মননের পাশাপাশি সমাজকেও প্রভাবিত করে

আল মামুন রিটন
প্রকাশ: ০৭ অক্টোবর ২০২৪, ১৫:৫৩

লেখক যেমন প্রেম ও প্রকৃতি নিয়ে লিখতে পারেন, তেমনই তিনি রাজনৈতিক অন্যায় বা সমাজের বৈষম্য নিয়েও লিখতে পারেন। প্রতীকী ছবি
সাহিত্য মানব জীবনের নানা দিকের প্রতিফলন এবং গভীরতম অনুভূতির প্রকাশ। সময়ের বিবর্তনের সাথে সাথে সাহিত্যের ধারা ও দৃষ্টিভঙ্গি বদলেছে, কিন্তু এক বিষয় সবসময় অপরিবর্তিত থেকেছে—সাহিত্যিকের নিজস্ব আদর্শ ও দৃষ্টিভঙ্গি তার সৃষ্টিকর্মকে প্রভাবিত করে। আধুনিক যুগে, যখন সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবর্তনগুলি প্রতিনিয়ত ঘটছে, একজন লেখকের ব্যক্তিগত আদর্শ তার সাহিত্যকর্মে আরও বেশি স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
একজন লেখকের আদর্শ বলতে বোঝায় তার জীবনদর্শন, নৈতিক মূল্যবোধ, রাজনৈতিক ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং তার ব্যক্তিগত বিশ্বাস। এই আদর্শ কেবল লেখকের ব্যক্তিগত জীবনেই নয়, বরং তার সৃষ্ট সাহিত্যেও গভীরভাবে প্রভাব বিস্তার করে। কবিতা, উপন্যাস, প্রবন্ধ—সব ক্ষেত্রেই লেখকের ভাবনা, মতামত এবং অনুভূতির প্রতিফলন ঘটে।
আধুনিক যুগে বিশ্বজুড়ে নানা রকম সামাজিক, অর্থনৈতিক, এবং প্রযুক্তিগত পরিবর্তন ঘটছে। বিশ্বায়ন, রাজনৈতিক উত্থান-পতন, পরিবেশগত সংকট, এবং প্রযুক্তির অগ্রগতির ফলে মানুষের জীবনধারা পরিবর্তিত হচ্ছে। এই পরিবর্তনের মাঝে দাঁড়িয়ে একজন কবি বা সাহিত্যিক তার নিজের জীবন ও সমাজের দিকে কীভাবে তাকায়, তা তার আদর্শ দ্বারা নির্ধারিত হয়।
কবি যেমন প্রেম, প্রকৃতি, বা মানবিক সম্পর্কের কথা লিখতে পারেন, তেমনই তিনি রাজনৈতিক অন্যায়, সমাজের বৈষম্য বা বৈশ্বিক সমস্যাগুলো নিয়ে রচনাও করতে পারেন। এই সিদ্ধান্তগুলি তার ব্যক্তিগত আদর্শের উপর নির্ভর করে। উদাহরণস্বরূপ, সমাজতান্ত্রিক আদর্শের একজন লেখক তার রচনায় বৈষম্য ও সামাজিক অসাম্য নিয়ে কথা বলবেন, যেখানে একজন মানবতাবাদী লেখক মানবতার প্রতি ভালোবাসা ও সমবেদনার উপর জোর দেবেন।
কবিতায় ব্যক্তিগত আদর্শের প্রভাব বিশেষভাবে দৃশ্যমান। কবিতা হচ্ছে একটি সংক্ষিপ্ত, গভীর ও বিমূর্ত সাহিত্য রূপ, যা ব্যক্তিগত অনুভূতি ও চিন্তার প্রকাশে অত্যন্ত কার্যকর। একজন কবি যদি উদার মানবতাবাদে বিশ্বাস করেন, তবে তার কবিতায় মানবজাতির কল্যাণ, মানবিক সম্পর্ক, এবং সহমর্মিতার বিষয়গুলো প্রাধান্য পাবে। অন্যদিকে, যদি কোনো কবির রাজনীতি, সমাজের বৈষম্য বা যেকোনো প্রকারের বিরোধিতার প্রতি সচেতনতা থাকে, তাহলে তার কবিতায় সেই বিষয়গুলিও প্রতিফলিত হবে।
একজন লেখকের আদর্শ স্থির থাকে না; সময়ের সাথে তা পরিবর্তিত বা পরিণত হতে পারে। জীবনের নানা অভিজ্ঞতা, পড়াশোনা, এবং সমাজের পরিবর্তনের সাথে সাথে একজন লেখক তার পূর্ববর্তী আদর্শ থেকে সরে এসে নতুন আদর্শকে গ্রহণ করতে পারেন। এই পরিবর্তনও তার সাহিত্যকর্মে প্রভাব ফেলে। উদাহরণস্বরূপ, একজন লেখক যে প্রথম জীবনে নিছক প্রেম ও প্রকৃতির কবি ছিলেন, পরবর্তীতে সামাজিক বা রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট নিয়ে বেশি লিখতে পারেন, যদি তার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা সেই দিকেই তাকে ধাবিত করে।
একজন লেখকের জন্য তার আদর্শগত দিকটিও যত্ন নেওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কেননা, সাহিত্যিক বা কবি হিসেবে সমাজে তার একটি দায়িত্বও রয়েছে। পাঠকরা তার রচনার মাধ্যমে সমাজ ও জীবনের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করে, এবং এই প্রক্রিয়ায় লেখকের আদর্শ বড় ভূমিকা পালন করে। একটি মিথ্যা বা নেতিবাচক আদর্শের প্রচার একজন লেখকের জন্য যেমন ক্ষতিকর, তেমনই তা পাঠকের মন ও সমাজের উপরও প্রভাব ফেলতে পারে। ঠিক তেমনই তার ত্রুটি পূর্ণ আচরণের প্রভাবেও পাঠকের মন এবং সমাজের উপর খারাপভাবে প্রভাব ফেলতে পারে।
এজন্যই একজন লেখকের উচিত তার নিজস্ব আদর্শ সম্পর্কে সতর্ক থাকা এবং তা যথাযথভাবে সাহিত্যে প্রতিফলিত করা।
আধুনিক যুগের সাহিত্যিকদের জন্য তাদের ব্যক্তিগত আদর্শ একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। এই আদর্শ তাদের সৃষ্টিকর্মের গতি ও দৃষ্টিভঙ্গি নির্ধারণ করে। কবি-সাহিত্যিকদের জন্য তাদের আদর্শকে যত্ন সহকারে লালন করা উচিত, ঠিক যেমনভাবে তারা তাদের সাহিত্যকে গুরুত্ব দিয়ে গড়ে তোলেন। কেননা, আদর্শের মাধ্যমেই তাদের সাহিত্য কেবলমাত্র পাঠকের মননকেই নয়, বরং বৃহত্তর সমাজকেও প্রভাবিত করে।
আল মামুন রিটন
নাটোর, রাজশাহী