Logo
×

Follow Us

চিঠি

সাধারণ মানুষ জটিল রাজনীতি বোঝে না, খাবারের নিশ্চয়তা চায়

Icon

সুরাইয়া আফরিন হিয়া

প্রকাশ: ০৭ জানুয়ারি ২০২৫, ১১:৩৪

সাধারণ মানুষ জটিল রাজনীতি বোঝে না, খাবারের নিশ্চয়তা চায়

প্রতীকী ছবি

বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৭০ শতাংশ মানুষ মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত শ্রেণির। তারা তিন বেলা খাবার কিনতে পারাকেই স্বাধীনতা ও সংস্কার মনে করে। খুব সহজেই শুধু চাল–ডালসহ খাদ্যদ্রব্য ও নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বা বাজারের অবস্থা দেখেই উন্নয়ন ও অনগ্রসরতা বিচার করে।

এই বিরাট জনগোষ্ঠী সত্যিকার অর্থে স্বাধীনতা ও বিজয়ের স্বাদ তখনই ভোগ করবে, যখন তাদের খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত হবে। তারা জটিল রাজনীতি বোঝে না, তারা রাষ্ট্র বা শাসকের কাছে তিন বেলা খাবারের নিশ্চয়তা চায়। লাগামহীন খাদ্যদ্রব্য ও নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রীর মূল্য অসহনীয় হয়ে উঠেছে সাধারণ মধ্যবিত্ত ও স্বল্প আয়ের মানুষের কাছে, জীবন বাঁচানোই যেন কঠিন হয়ে পড়েছে।

খাদ্যনিরাপত্তা বলতে বোঝায় খাদ্যের সহজলভ্যতা বা খাদ্যদ্রব্যের মূল্য জনসাধারণের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে থাকা। বর্তমানে নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রীর অস্বাভাবিক ঊর্ধ্বগতির প্রভাব ভয়াবহভাবে দেশের ৭০ শতাংশ জনগণের ওপরে পড়েছে। প্রতিদিন বাজারে গিয়ে সবচেয়ে কম মূল্যের সবজি ও চাল কিনতেও হিমশিম খেতে হচ্ছে।

২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে খাদ্যে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৩ দশমিক ৭৭ শতাংশ, যা ২০২৪ সালের নভেম্বরে এসে দাঁড়িয়েছে ১৩ দশমিক ৮০ শতাংশে। সাধারণ মানুষের আয় বাড়লেও ক্রয়ক্ষমতা কমেছে। কারণ, বেতন দুই টাকা বাড়লে জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে ছয় টাকা। এর ফলাফল হিসেবে ক্ষুধা ও অপুষ্টি গ্রাস করেছে এই বৃহৎ জনগোষ্ঠীকে।

সর্বশেষ বৈশিক ক্ষুধা সূচক (২০২৪) অনুযায়ী, বাংলাদেশের ১১ দশমিক ৯ শতাংশ মানুষ অপুষ্টিতে ভুগছে। প্রায় ২৯ শতাংশ মানুষ দৈনিক তিন বেলা খাবার পাচ্ছে না। শিশুদের ক্ষেত্রে এই অবস্থা আরো মারাত্মক। চমকে ওঠার মতো তথ্য হচ্ছে, ইউনিসেফের সর্বশেষ তথ্য (২৬ জুন ২০২৪) অনুযায়ী, দেশের প্রতি তিনটি শিশুর মধ্যে দুটিই পর্যাপ্ত সুষম খাবারের অভাবে ভুগছে। প্রায় ২৮ শতাংশ শিশু অপুষ্টির শিকার।

জন্মের সময় স্বাভাবিকের চেয়ে কম ওজন নিয়ে জন্মায় প্রায় ছয় লাখ শিশু। বৈশিক ক্ষুধা সূচক ২০২৪–এর তথ্যমতে, পাঁচ বছরের কম ২৩ দশমিক ৬ শতাংশ শিশু খর্বকায় বা স্বাভাবিকের তুলনায় কম উচ্চতাসম্পন্ন। কম ওজন ২২ দশমিক ৬ শতাংশ শিশুর। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, বিশ্বব্যাপী সুষম খাদ্যসংকটের শিকার শিশুদের মোট সংখ্যার প্রায় দুই–তৃতীয়াংশের বাস যে ২০টি দেশে, বাংলাদেশ তার মধ্যে একটি। পুষ্টিহীনতায় ভুগে নানাবিধ রোগে আক্রান্ত এসব শিশু আগামী দিনে কীভাবে দেশের ভবিষ্যৎ হিসেবে তৈরি হবে?

অসহনীয় মূল্যবৃদ্ধির ফলে স্বল্প আয়ের মানুষ তো ভুগছেই, মধ্যবিত্তদেরও নাগালের বাইরে চলে গেছে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র। সবচেয়ে কম দামি মোটা চালের দামও প্রতি কেজির দাম ৫২ থেকে ৫৬ টাকা। ফলে আয়ের মধ্যে ব্যয়ের হিসাব মেলানো কঠিন হয়ে উঠেছে সাধারণ মানুষের পক্ষে।

নির্ধারিত মূল্য বলে বাজারে কিছু নেই। সেই সঙ্গে গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানির মূল্যবৃদ্ধি তো আছেই। জীবন বাঁচাতেই নাভিশ্বাস উঠছে, পুষ্টির হিসাব করার সুযোগ কোথায়! কিন্তু এর সমাধান কী?

দ্রব্যমূল্যের এই হুটহাট বৃদ্ধির জন্য অন্যতম কারণ হিসেবে রাক্ষুসে ব্যবসায়ীদের তৈরি সিন্ডিকেটকে দায়ী করব। কৃত্রিম সংকট তৈরি করে পণ্য মজুদ করে নিজেরাই বাড়িয়ে মূল্য নির্ধারণ করে তারপর পণ্য বাজারে নিয়ে আসে। নীতিহীন এই ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সরকার–প্রশাসন কবে পেরে উঠবে?

আইন যেন এই অসাধু ব্যবসায়ীদের কিছুতেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। আইন, ভোক্তা অধিদপ্তরের তৎপরতা, মনিটরিং কি আসলেই কাজে দিচ্ছে? দুই–চারজন চুনোপুঁটি দোকানদারকে জরিমানা, কারাদণ্ডে শুধু থেমে না থেকে এর পেছনের বৃহৎ সিন্ডিকেটের কারসাজি খুঁজে বের করতে হবে। প্রশাসনকে বাজার নিয়ন্ত্রণকারী রাঘববোয়াল পর্যন্ত পৌঁছাতে হবে। আইনের যথাযথ প্রয়োগের অভাব রয়েছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এই রাঘববোয়ালেরা রাজনৈতিক প্রভাবশালী হয়। ফলে ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকেই কার্যক্রম চালিয়ে যায় তারা।

যেদিন রাজনৈতিক আশ্রয় থেকে অপরাধীদের বের করে শুধুই ‘অপরাধী’ হিসেবে গণ্য করা হবে, সেদিন থেকে এই দেশ এবং দেশের মানুষ মুক্তিলাভ করবে। পণ্যের উৎপাদন, আমদানি ও মজুদের তথ্য প্রকাশ এবং যুক্ত করা বাধ্যতামূলক করতে হবে। দ্রব্যমূল্য মানুষের হাতের নাগালে নিয়ে আসতে নিয়মিত বাজার অভিযানে আরও সক্রিয় ও কার্যকর হতে হবে।

বাংলাদেশে চাহিদার তুলনায় কিছু পণ্যের কম উৎপাদন এবং বিভিন্ন সময় নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে আশানুরূপ উৎপাদন ব্যাহত হয়। এসব পরিস্থিতিতে যথাসময়ে আমদানি নিশ্চিত করতে হবে। আমদানি শুল্ক কমানো, টিসিবির কার্যক্রম আরো বাড়ানো উচিত। দেশে উৎপাদন বাড়াতে কৃষকদের পাশে দাঁড়ানো উচিত। সরাসরি কৃষকদের কাছ থেকে ফসল ক্রয় করে মধ্যস্বত্বভোগীদের প্রভাব কমাতে হবে। কৃষকদের ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে হবে। তবেই কৃষকেরা কাজে উৎসাহিত হবেন।

কৃষক লাভবান হলে কৃষিকাজে বাংলাদেশেও শিক্ষিতরা আগ্রহী হবেন। কৃষি খাতে ভর্তুকির পরিমাণ বাড়িয়ে কৃষকদের বিনা সুদে ঋণদান, আধুনিক যন্ত্রপাতি সরবরাহ এবং কৃষকদের প্রশিক্ষণ প্রদান করতে হবে। তবেই এই লাগামহীন বাজার নিয়ন্ত্রণ করে সাধারণ মানুষের খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করা যাবে; তখন সত্যিকারের স্বাধীনতার স্বাদ পাবে সবাই।

সুরাইয়া আফরিন হিয়া
শিক্ষার্থী, সরকারি আজিজুল হক কলেজ, বগুড়া।


Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫