উপযুক্ত সম্মান ও সম্মানী শিক্ষকদের অধিকার

কাজী আবু মোহাম্মদ খালেদ নিজাম
প্রকাশ: ০৫ অক্টোবর ২০২২, ১৪:৪৬

শিক্ষকের হাতেই গড়ে উঠে সন্তান। ছবি: সংগৃহীত
শিক্ষকদের নিয়ে আমরা অনেকেই সুন্দর সুন্দর কথা বলি। কিন্তু দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতির এই সময়ে তারা স্বল্প বেতন দিয়ে কীভাবে সংসার চালাচ্ছেন তা কেউ ভাবছিনা। অথচ মানুষ গড়ার নিপুণ কারিগর শিক্ষক। মা-বাবা জন্ম দেওয়ার পর মূলত শিক্ষকের হাতেই গড়ে উঠে সন্তান।
ছাত্রকে মানুষ করার জন্য শিক্ষকের চেষ্টার অন্ত থাকে না। আমি মনে করি, উপযুক্ত সম্মান ও সম্মানী পাওয়া শিক্ষকদের অধিকার। মহামারি করোনাতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধের সময়ে শত সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও শিক্ষকরা অনলাইন মাধ্যম ব্যবহার করে শিক্ষার্থীদের কাছে পাঠ পৌঁছে দিয়েছেন।
প্রাথমিকসহ মাধ্যমিক ও অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকগণ কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা মোতাবেক মোবাইলে কিংবা প্রয়োজনে বাড়ি বাড়ি গমন করে শিক্ষার্থীদের পড়ালেখার খোঁজ খবর রেখেছিলেন। দিয়েছেন নানা পরামর্শ। একজন শিক্ষক কখনো ইচ্ছাকৃতভাবে তার দায়িত্বে অবহেলা করেন না বলেই বিশ্বাস করি। যদিও গুটিকয়েক শিক্ষকের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠে নানা সময়। কিন্তু তারা বিশাল শিক্ষক সমাজের প্রতিনিধিত্ব করেন না অবশ্যই।
প্রতি বছর ৫ অক্টোবর সারাবিশ্বে ‘বিশ্ব শিক্ষক দিবস’ পালন করা হয়। এদিন শিক্ষকদের অবদানের কথা তুলে ধরা হয় বিভিন্ন সেমিনার, সেম্পুজিয়ামে। পৃথিবীর প্রায় প্রত্যেক দেশেই শিক্ষকের সম্মান রয়েছে। রয়েছে তাদের জন্য পর্যাপ্ত সম্মানী, নিরাপত্তা ও আবাসনের সুব্যবস্থা। আমাদের দেশে নানা সুবিধা বাড়লেও এখনো পর্যন্ত শিক্ষকগণ সেভাবে কাংখিত সম্মানী এবং অন্যান্য সুবিধাদি পান না। যদিও লোডশেডিং কর্মসূচি বাস্তবায়নে বর্তমানে সপ্তাহে একদিন ছুটির পরিবর্তে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দুদিন করা হয়েছে এবং আগামী বছর থেকে নতুন শিক্ষাক্রম ও শিক্ষানীতি বাস্তবায়নের কথা রয়েছে।
এক্ষেত্রে বৈষম্য থেকে যাচ্ছে। বিভিন্ন সময় এই বৈষম্যসহ নানা দাবি-দাওয়া নিয়ে শিক্ষকগণ রাস্তায়ও নামেন। সরব থাকেন প্রতিবাদ, বিক্ষোভ করেন। সরকারকে শিক্ষকদের যৌক্তিক দাবিগুলো নিয়ে ভাবার অনুরোধ জানাই। শিক্ষকদের যৌক্তিক দাবি কর্তৃপক্ষ ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাগণ কখনো অস্বীকার করেন না ঠিকই কিন্তু কার্যকর কোনো পদক্ষেপও তেমন নিতে দেখা যায়না।
দেশের প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত যত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে তাতে লাখ লাখ শিক্ষক শিক্ষকতা করে যাচ্ছেন, শিক্ষার্থীদের শিক্ষাদান করে যাচ্ছেন। আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছেন তাদের মানুষ করার জন্য। এরপরও নানা সময় শিক্ষকরা বিব্রতকর অবস্থার মুখোমুখি হন। সম্মুখীন হন নানা প্রতিকূলতার। শিক্ষকদের বিরুদ্ধে বিষোদগার করেন সমাজের কিছু দুষ্ট লোক। তবে তারা সংখ্যায় অতি নগণ্য।
মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেবের সেই ‘শিক্ষকের মর্যাদা’ দেওয়ার ঘটনাটি আমরা সবাই জানি। এই সম্পর্কিত একটি কবিতা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বাংলা পাঠ্যপুস্তকে রয়েছে। সম্রাট তার পুত্রের শিক্ষককে যেভাবে মর্যাদা দিয়েছিলেন সে ধরনের মর্যাদা কি এখন আছে? বাদশাহ পুত্র পায়ে পানি ঢালছেন আর এটিকে অপরাধ মনে করেছিলেন শিক্ষক।
কিন্তু সম্রাট অবাক করে দিয়ে শিক্ষককে দিলেন সম্মান। বললেন, পুত্র কেন শিক্ষকের পায়ে শুধু পানি ঢালবে। পুত্রের উচিৎ পানি ঢালার পাশাপাশি হাত দিয়ে ধুয়ে দেওয়া। শ্রদ্ধাবোধ কমে আসলেও সমাজে শিক্ষকদের একটি সম্মানজনক স্থান রয়েছে। আগের দিনে মানুষ শিক্ষকদের যথোপযুক্ত সম্মান করতেন। নিজের সন্তানকে মানুষ করতে শিক্ষকের হাতে তাকে তুলে দিতেন।
এখনো প্রত্যন্ত অঞ্চলে সাধারণ খেটে-খাওয়া মানুষ শিক্ষকদের সম্মানের আসনে বসান, ছুটে যান তাদের যেকোনো সমস্যায়। সমাজে আলো ছড়াচ্ছেন শিক্ষকরাই। পর্যাপ্ত সুবিধাদি না পেলেও তারা তাদের দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। থেমে নেই তাদের কর্মতৎপরতা।
দেশে প্রতিবছর পাবলিক পরীক্ষাসমূহের যে আশা জাগানিয়া ফলাফল তার কারিগর কিন্তু এই শিক্ষক সমাজ। তাদের প্রচেষ্টায়ই এই সফলতা। কিন্তু অপর্যাপ্ত স্যালারিতে কীভাবে তাদের সংসার কাটছে তা বলা মুশকিল। তাই শিক্ষকদের জন্য নতুন পে স্কেল বা মহার্ঘভাতার ব্যবস্থা করার দাবি জানাচ্ছি। দেশের সব স্তরে যারা দায়িত্ব পালন করে চলেছেন তারা সবাই কোনো না কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষকের ছাত্র। সে হিসেবে দেশের উন্নয়নের পেছনেও রয়েছে শিক্ষকদের অবদান।
শিক্ষকগণ বছর বছর দেশের জন্য তৈরি করছেন মেধাসম্পদ। যে সম্পদ দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতিতে সহায়ক। শিক্ষকদের প্রতি সবার উপযুক্ত শ্রদ্ধাবোধ থাকা উচিত। এই শ্রদ্ধাবোধের মাত্রা আমাদের সমাজ থেকে দিন দিন উবে যাচ্ছে। প্রাথমিকের গণ্ডি পেরোলেই দেখা যায় অনেক ছাত্র তার শিক্ষককে যথাযথ সম্মান দেয়না। এমনকি সালামটুকুও দিতে চায়না। যা আমাদের জন্য অবশ্যই চিন্তার বিষয়।
হ্যাঁ, দেখা যায় বেশ কিছু শিক্ষক তাদের দায়িত্ব পালনে কম তৎপর থাকেন। এ ধরনের মন-মানসিকতা অবশ্যই পরিহার করা উচিত। এরপরও আমি বলব দেশের শিক্ষকদের বেশিরভাগই তাদের দায়িত্ব পালনে অটল থাকেন। অব্যাহত রাখেন মানুষ গড়ার প্রচেষ্টা। শিক্ষকদের জন্য আলাদা বেতন কমিশন গঠনপূর্বক উপযুক্ত সম্মানীর ব্যবস্থা করা, নানা সুবিধাদি বৃদ্ধি ও যোগ্যতাসম্পন্ন শিক্ষক নিয়োগ করা দরকার।
যথাযথ প্রশিক্ষণ, আবাসন ব্যবস্থাসহ অন্যান্য সুবিধা বাড়ানো উচিত। শিক্ষকদের সম্মান ও সম্মানীর যেন কোনো ঘাটতি না থাকে। কারণ, উপযুক্ত সম্মান ও সম্মানী শিক্ষকদের অধিকার। সুনিশ্চিত হোক তাদের অধিকার। এ বিষয়ে সবার সচেতনতা কাম্য।