‘বাইচান্স শিক্ষক নয়, আমাদের দরকার মনেপ্রাণে শিক্ষক। তাঁদের মাধ্যমেই আমরা দক্ষ, যোগ্য ও মানবিক মানুষ গড়ে তুলেতে চাই। এজন্য শিক্ষাই প্রধান হাতিয়ার। শিক্ষাই হবে মেগা প্রকল্প। তাই আমাদের শিক্ষকদের পেশাগত মর্যাদা ও আর্থিক অবস্থার উন্নয়ন ঘটাতে হবে। সময়ের প্রয়োজনেই তাঁকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে এগিয়ে রাখতে হবে।’
শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি গত ৩০ জুলাই ‘বাংলাদেশ স্টার্টআপ’ সম্মেলনে এমন আরও অনেক মূল্যবান কথা বলেছেন। আমি যদি ভুল না বুঝে থাকি, তাহলে বাইচান্স শিক্ষক, মানে ঘটনাচক্রে শিক্ষক, দৈবক্রমে শিক্ষক, ভাগ্যক্রমে শিক্ষক, হঠাৎ শিক্ষক। অর্থাৎ, যিনি শিক্ষক হতে চান না, তিনি অন্য কিছু হতে ব্যর্থ হয়ে কোনো না কোনো উপায়ে শেষমেশ শিক্ষক। কথাটি বলতে ও শুনতে খুবই খারাপ লাগছে! যদিও সবার ক্ষেত্রে তা প্রযোজ্য নয়। তবে যাঁদের জন্য প্রযোজ্য, দায়টা কি তাদের? বাস্তব অবস্থাটি এমন হলো কেন, হচ্ছে কেন, হবে কেন?
অন্য আরেকটি কথা, আমি যদি ভুল না বুঝে থাকি তাহলে ‘মনেপ্রাণে শিক্ষক’ মানে চিন্তায়, চেতনায়, ধ্যানে-জ্ঞানে-মননে শিক্ষক। ছোটবেলা থেকে শিক্ষক হওয়ার ইচ্ছায় শিক্ষক। নিজের ও মা-বাবার স্বপ্নপূরণে শিক্ষক। শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন দেখতে দেখতে শিক্ষক। শিক্ষক হওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিয়ে শিক্ষক।
শুধু শিক্ষকতার জন্য শিক্ষক। অথচ অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হচ্ছে, কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া এমন শিক্ষক আমরা পাচ্ছি না! বেসরকারি তো দূরের কথা সরকারি চাকরিতেও পছন্দক্রমের তলানিতে থাকে শিক্ষকতা!
সরকারি শিক্ষক হয়েও অনেকেই চলে যেতে চান, চলে যান অন্য পেশায়, অন্য ক্যাডারে। বাস্তব অবস্থাটি এমন হলো কেন, হচ্ছে কেন, হবে কেন?
সত্যি করে বলছি, আমিও আমার সন্তানের জন্য ‘ঘটনাচক্রে শিক্ষক’ চাই না, ‘বাইচান্স শিক্ষক’ চাই না; ‘মনেপ্রাণে শিক্ষক’ চাই, সর্বাধিক যোগ্য ও দক্ষ শিক্ষক চাই। আমি নিজেকে অযোগ্য শিক্ষক মনে করি না।
তথাপি আমি আমার চেয়ে অধিক যোগ্য শিক্ষক চাই। আমার এ চাওয়া আজকের নয়, দীর্ঘদিনের।
যখনশিক্ষার মূল ভিত্তি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এসএসসি পাস শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, তখনো আমি আপত্তি করেছি, লিখেছি। যখন ব্যাপক হারে কোটা সংরক্ষণ করে তুলনামূলক বেশি যোগ্য ছেলেদের বাদ দিয়ে কম যোগ্য মেয়েদের শিক্ষকতায় প্রবেশ করানো হয়েছে, তখনো আমি আপত্তি করেছি, লিখেছি। যখন বেসরকারি শিক্ষকদের সুযোগ-সুবিধা না বাড়িয়ে যোগ্যতা কমিয়ে একাধিক তৃতীয় বিভাগ বা শ্রেণিধারী প্রার্থীকে শিক্ষকতায় প্রবেশ করানো হয়েছে, তখনো আমি আপত্তি করেছি, লিখেছি।
এখনো বেসরকারি শিক্ষকদের সুযোগ-সুবিধা না বাড়িয়ে যোগ্যতা কমিয়ে একটি তৃতীয় বিভাগ বা শ্রেণিধারীকে শিক্ষক হওয়ার সুযোগ দেওয়ার ব্যাপারে আমি তীব্র আপত্তি করছি। সরকারি শিক্ষক হওয়ার জন্য যদি তৃতীয় বিভাগ বা শ্রেণিধারীকে গ্রহণ করা না হয়, তাহলে বেসরকারি শিক্ষক হওয়ার ক্ষেত্রে কেন গ্রহণ করা হবে? বেসরকারি শিক্ষকেরা তো এ দেশের শতকরা ৯৫ ভাগের বেশি সন্তানদের লেখাপড়া করাচ্ছেন।
আমার মতো আরও অনেকেই ‘বাইচান্স শিক্ষক’ চান না, ‘মনেপ্রাণে শিক্ষক’ চান। অর্থাৎ, সর্বাধিক যোগ্য ও দক্ষ শিক্ষক চান। যাঁরা সন্তানকে ভালোবেসে ভালো ভালো স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ও মাদ্রাসায় ভর্তি করাতে চান, তাঁরা সর্বাধিক যোগ্য ও দক্ষ শিক্ষক চান। যাঁরা শিক্ষক হয়েও সন্তানকে নিজের প্রতিষ্ঠানে না পড়িয়ে আরও ভালো প্রতিষ্ঠানে পড়াতে চান, তাঁরাও অধিক যোগ্য ও দক্ষ শিক্ষক চান। যাঁরা সন্তানকে ভালোভাবে নাচ, গান, অভিনয়, আবৃত্তি, তিলাওয়াত, খেলা, সাঁতার, শিকার, ড্রাইভিং, পাইলটিং ইত্যাদি শেখাতে চান, তাঁরাও সেই লাইনের সর্বাধিক যোগ্য ও দক্ষ শিক্ষক চান। যাঁরা সব শিক্ষার্থীর অধিক কল্যাণ চান, আরও উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ চান, প্রতিটি ক্ষেত্রে অধিক যোগ্য কর্মী চান, দেশ ও জাতির প্রকৃত উন্নয়ন চান, তাঁরা সবাই সর্বাধিক যোগ্য শিক্ষক চান। অর্থাৎ, সব বিবেকবান মানুষ তাঁর সন্তানকে দক্ষ, যোগ্য ও মানবিক মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য সর্বাধিক দক্ষ, যোগ্য ও মানবিক শিক্ষক চান। শিক্ষকের কাছ থেকে আরও বেশি জ্ঞান চান, দক্ষতা চান, ত্যাগ চান।
এমতাবস্থায় ‘বাইচান্স শিক্ষক নয়, আমাদের দরকার মনেপ্রাণে শিক্ষক’—এই বক্তব্য দ্বারা শিক্ষামন্ত্রী মহোদয় যদি এমন বুঝিয়ে থাকেন যে নতুন যাঁরা শিক্ষকতায় আসবেন, তাঁরা যেন ‘বাইচান্স শিক্ষক’ না হয়ে ‘মনেপ্রাণে শিক্ষক’ হন, যোগ্যতাভিত্তিক শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নে সর্বাধিক সফল শিক্ষক হন, তাহলে নিশ্চয়ই শিক্ষক পদের জন্য এখনই নির্ধারণ করতে হবে সর্বোচ্চ যোগ্যতা ও সুযোগ-সুবিধা; যাতে সর্বোচ্চ মেধাবীদের পেশা পছন্দের তালিকায় প্রথমে থাকে শিক্ষকতা। সেই সঙ্গে আমরা যাঁরা বর্তমানে শিক্ষকতায় নিয়োজিত; কিন্তু ‘মনেপ্রাণে শিক্ষক’ হতে পারছি না, ‘বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে এগিয়ে’ থাকতে পারছি না, ডিজিটাল তথা স্মার্ট হয়ে উঠতে পারছি না, কাঙ্ক্ষিত দক্ষতা প্রদর্শন করতে পারছি না, তাঁদের জন্য থাকা উচিত হ্যান্ডসাম অ্যামাউন্ট নিয়ে অগ্রিম অবসরে যাওয়ার ব্যবস্থা, যাতে দ্রুত উন্মোচিত হয় অধিক যোগ্যদের শিক্ষকতায় আগমনের অধিক দ্বার।
শিক্ষক পদের জন্য সর্বাধিক যোগ্যতা ও সুযোগ-সুবিধা নির্ধারণে বিলম্ব করা মানেই দেশ ও জাতির দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি করা। কেননা, এখন যিনি শিক্ষক, তথা মানুষ গড়ার কারিগর হবেন, তিনি তুলনামূলক কম যোগ্য হলে কমপক্ষে ৩০ বছর তৈরি করবেন অগণিত অযোগ্য বা কম যোগ্য মানুষ। অর্থাৎ, অযোগ্যতা ছড়িয়ে দেবেন সব ক্ষেত্রে, সব পেশায়! অপর দিকে এখন যিনি শিক্ষক, তথা মানুষ গড়ার কারিগর হবেন, তিনি সর্বাধিক যোগ্য হলে কমপক্ষে ৩০ বছর তৈরি করবেন অগণিত অধিক যোগ্য মানুষ।
দ্রুত বাস্তবায়িত হবে প্রকৃত স্মার্ট বাংলাদেশ। মনে রাখতে হবে, তুলনামূলক কম যোগ্য শিক্ষক দিয়ে অধিক যোগ্য চিকিৎসক, প্রকৌশলী, আইনজীবী, আমলা, কর্মী তথা সব পেশাজীবী ও জনপ্রতিনিধি তৈরির প্রত্যাশা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক, অবাস্তব, অসম্ভব। আশা করি, বিষয়টি এখনই অনুধাবন করবে বর্তমান সরকার, দ্রুত বাস্তবায়ন করবেন শিক্ষামন্ত্রী মহোদয়ের সেই মূল্যবান বক্তব্য, ‘শিক্ষাই হবে মেগা প্রকল্প। শিক্ষকদের পেশাগত মর্যাদা ও আর্থিক অবস্থার উন্নয়ন ঘটাতে হবে।’
লেখক: শিক্ষাবিদ এবং অধ্যক্ষ,
কিশলয় বালিকা বিদ্যালয় ও কলেজ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা।
সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
বিষয় : শিক্ষক বেসরকারি শিক্ষক মো. রহমত উল্লাহ
© 2023 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh