Logo
×

Follow Us

চিঠি

চিঠি দিও পত্র দিও, জানাইও ঠিকানা রে...

Icon

এহসান হায়দার

প্রকাশ: ০১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১৬:৩৬

চিঠি দিও পত্র দিও, জানাইও ঠিকানা রে...

প্রতীকী ছবি

‘আজ বিকেলের ডাকে তোমার চিঠি পেলাম
রঙিন খামে যত্নে লেখা আমারই নাম।’

আমাদের ছিল স্বর্ণালি এক চিঠিযুগ, যে সময়টা আর এখন নেই, চিঠিযুগ এখন অতীত এবং বিলীন। বাংলা চলচ্চিত্রের স্বর্ণযুগে একটা জনপ্রিয় গান ছিল, ‘বিদেশ গিয়া বন্ধু/তুমি আমায় ভুইলো না/চিঠি দিও পত্র দিও/জানাইও ঠিকানা রে...’ একালে কেউ আর এই গানের মতো করে প্রিয়জনের নিকট থেকে চিঠি প্রত্যাশা করে না, চিঠি নামের একটি বিষয় যে একদা ছিল তাও ভুলতে বসেছে মানুষ। অথচ চিঠি নিয়ে কী হয়নি? রবি ঠাকুরের পত্রোপন্যাস যেমন পাঠকের হৃদয় জয় করে রয়েছে, ঠিক তেমনি সকলের প্রিয় নজরুল ইসলামের প্রণয় বিষয়ক পত্র সম্পর্কেও আমরা জানি। প্রিয়তমা নার্গিসকে চিঠিতে লিখেছিলেন নজরুল, ‘...হঠাৎ মনে পড়ে গেল পনেরো বছর আগেকার কথা।‌ তোমার জ্বর হয়েছিল।‌ বহু সাধনার পর আমার তৃষিত দুটি কর তোমার শুভ্র সুন্দর ললাট স্পর্শ করতে পেরেছিল...‌’ 

চিঠি এককালে ছিল ভাষাচর্চার একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। চিঠি ছিল প্রেমের, বন্ধুত্বের, বিপ্লবীদের, যুদ্ধের, টাকা চেয়ে পিতার কাছে পুত্রের, আবার পরীক্ষার খাতায়ও। চিঠির যেমন বহুরূপতা, তেমনি এ নিয়ে হই-হুল্লোড়ও কম হয়নি। পারমাণবিক বোমা তৈরির অনুমতি চেয়ে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টকে লেখা যে চিঠিতে আইনস্টাইন স্বাক্ষর করেছিলেন, সেই চিঠির কথাও আমরা জানি। আগের দিনে রাজ-রাজড়াদের গল্পও তো কারও অজানা নয় যে, সন্দেশ বহনকারীকে হত্যা করা হতো। একদা পূর্ববাংলা কমিউনিস্ট পার্টি কিংবা সর্বহারাদের মতো গোপন সংগঠনগুলোর ছিল চিঠি আদান-প্রদানের মাধ্যমে সংবাদ প্রেরণের রীতি। তা ছাড়া বিখ্যাত লোকেদের চিঠিপত্র পাঠ করা মানে তাকে পাঠ করা, তার আদর্শ, তার চিন্তা-চেতনা সবকিছুরই প্রকাশ পেয়ে থাকে তার লেখা পত্রে। বহুদিন পত্রমিতালি ছিল এ দেশে বন্ধুত্ব প্রসারের এক রোমাঞ্চকর মাধ্যম। গত শতকের সত্তরের দশকে চিত্রালী পত্রিকায় চিঠি লেখার জন্য ঠিকানা ছাপানোর সুযোগ ছিল তা সে কালের কারও ভুলে থাকার  কথা নয়। সেটা ছিল এক মধুর ব্যাপার। গত নব্বইয়ের দশকে বাংলাদেশ বেতারেও পাঠ করা হতো অসামান্য সব চিঠি, সেখানে শোনানো হতো লেখকের পূর্ণাঙ্গ ঠিকানাও। সেই ঠিকানাতে আবার চিঠিও লিখত বন্ধুরা-এ ছিল অপূর্ব প্রাপ্তি।  

আমাদের দেশে রানার বা ডাকপিয়নদের আবির্ভাব সম্পর্কে জানা যায়, ১২০৬ থেকে ১২১০ সালের মধ্যে এদের কর্ম শুরু। 

সময়টা ছিল দিল্লির সুলতান কুতুবউদ্দিন আইবেকের, এ সময়ে তিনি আরবীয়দের অনুকরণে দিল্লি থেকে আজকের বাংলাদেশ অব্দি ডাক ব্যবস্থা চালু করেন। রানারদেরকে  তখন ‘ধাওয়া’ বলা হতো। এরপর ১২৯৬ সালে সুলতান আলাউদ্দিন খিলজী পথচারী মানুষের সাহায্যে ডাক সার্ভিস চালু করেন। আর মোহাম্মদ বিন তুঘলকের শাসনামলে (১৩২৫-১৩৫১) ঘোড়ার মাধ্যমে এবং পায়ে হেঁটে ডাকের ব্যবস্থা ছিল। মুঘল শাসনামলে এসে রানার পরিচিতি পায় ‘ডাক হরকরা’ নামে। ডাক ব্যবস্থার সর্বনিম্নস্তরটির কর্মী এরা। এদের নিয়ে সুকান্ত ভট্টাচার্য ‘রানার’ নামে সেই বিখ্যাত কবিতাটি লিখেছিলেন, ‘রানার ছুটেছে তাই ঝুম্ ঝুম্ ঘণ্টা বাজছে রাতে...!’ ১৭৭৪ সালে ব্রিটিশ শাসনের সময়ে কলকাতায় জিপিও স্থাপন করা হয়েছিল। 

এ সময় বাংলাদেশের ভেতরে ডাক আনা-নেওয়ার জন্য ৪১৭ জন রানার নিয়োগ পান। স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল কুষ্টিয়া জেলার মুজিবনগরে বাংলাদেশের প্রবাসী সরকার গঠনের সঙ্গে সঙ্গে সীমান্ত এলাকায় ৫০টি মাঠ পর্যায়ের ডাকঘর চালুর মাধ্যমে যাত্রা শুরু করেছিল ডাক বিভাগ। আর ১৯৭১ সালের ২৯ জুলাই একই সঙ্গে মুজিবনগর সচিবালয়, বাংলাদেশের বিভিন্ন কূটনৈতিক মিশন এবং লন্ডনের হাউস অব কমন্সে বিশেষ ধরনের আটটি স্ট্যাম্প চালু করা হয়।

এখন দেশে ডাকঘরের সংখ্যা প্রায় ৯ হাজার ৪০১টি। তবে বেশিরভাগ ডাকঘরই চিঠিশূন্য। কেননা চিঠির যুগ এখন নেই। সরকারি ডাকের বাইরে হাতে লেখা সেই চিঠি হারিয়ে গেছে। আমাদের গ্রামের ডাকপিয়ন ছিলেন সাধন কাকা, একটা সময় ডাকঘর ছিল আমার প্রিয় ঠিকানা, সেখানে আমার পত্রিকা আর চিঠির জন্য আলাদা করেই একটা বাক্স রেখে এসেছিলাম সাধন কাকার কাছে-যাতে আমার নামে আসা চিঠিগুলো না হারায়। সেপ্টেম্বর মাসের ১ তারিখ আন্তর্জাতিকভাবে চিঠি দিবস পালন করা হয়, কারণ সকলেই চাইছেন হয়তো চিঠির পুনরুজ্জীবন।

চিঠি একটা ইতিহাস বহন করার মতোই ব্যাপার। ডাকটিকিট সংগ্রহ করা মানে ইতিহাস বহন করারই শামিল। ফলে চিঠিচর্চা কেবল চিঠি নয়, এতে যেমন আবেগ থাকে, থাকে ভালোবাসার লাল গোলাপ যা এ প্রজন্ম হয়তো বুঝতে পারে না, কারণ তাদের নিকট ই-মেইল এবং মোবাইলে সাধারণ মেসেজ পাঠানোর (ক্ষণিক) মুহূর্ত সুযোগ রয়েছে। বিখ্যাত আমেরিকান গল্পকার সমারসেট মম তার ‘দ্য লেটার’ গল্পে লিখেছেন, ‘লেটার রাইটিং ইজ অ্যা লস্ট আর্ট।’ এটি একটি রূঢ় সত্য কথা, এই সত্যকে আমরা যেমন অস্বীকার করতে পারি না, ঠিক তেমন চিঠি লেখার রঙিন খামের কথা, ডাকপিয়নের বাড়ির গেটে এসে চিৎকার করে ডাকা ‘চিঠি আছে...’ বাক্যও ভুলতে পারি না।   

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫