গাছের ‘আদিবাসী’ পাতাটি ছিঁড়ে ফেলা হলো

‘আদিবাসী’ জনগোষ্ঠীরা বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি অবহেলিত জীবন অতিবাহিত করছে। গত পনেরো-ষোল বছরের স্বৈরাচার শেখ হাসিনার শাসনামলে ‘আদিবাসী’ জনগোষ্ঠীর উপর সমতলের জনগোষ্ঠীর চেয়েও তিনগুণ নিপীড়ন, নির্যাতনের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। ‘আদিবাসী’ জনগোষ্ঠীর বসবাসের অঞ্চলগুলোতে সেটেলার জনগোষ্ঠীদের মাত্রাতিরিক্ত অবৈধ বাসস্থান গড়ে তোলার রাষ্ট্রীয় আয়োজন এসব জনগোষ্ঠীকে দিন দিন বিপজ্জনক পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দিচ্ছে।

‘আদিবাসী’ জনগোষ্ঠীর প্রাত্যহিক জীবন যদি বর্ণনা করা হয়, তাহলে মনে হবে এটি এক নব্য প্যালেস্টাইন, যা স্বাধীনতার পূর্ব থেকে বাংলাদেশে গড়ে উঠেছে। স্বাধীনতার পর বাঙালি মুসলিম জনগোষ্ঠীর মাঝে এখানকার ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বিএনপির যৌথ ভোট রাজনীতির অংশ হিসেবে মৌন বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি উৎপাদন করা হয়। যার ফলে এখানকার মুসলিম জনগোষ্ঠীর একটি অপশক্তি ‘আদিবাসী’ জনগোষ্ঠী সম্পর্কে বিষোদ্‌গার ও কুৎসা রচনা করে। শুরু হয় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, সাম্প্রদায়িক অপতৎপরতা, আদিবাসী জনগোষ্ঠীর সাথে বর্ণবাদী আচরণসহ নানাভাবে মতপ্রকাশের অধিকার থেকেও বঞ্চিত রাখার প্রচেষ্টা।

জুলাই গণঅভ্যুত্থানে ‘আদিবাসী’ জনগোষ্ঠীর ব্যাপক অংশগ্রহণ ছিল। ‘আদিবাসী’ শিক্ষার্থীরা ঢাকা শহরের আনাচে-কানাচে অবিশ্বাস্য রকমের গ্রাফিতি আঁকে, যখন চারদিকে আন্দোলন থমকে গেছে। অনেকে গ্রাফিতি আঁকতে গিয়ে ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীদের দ্বারা নির্যাতনের শিকারও হয়েছেন। শুধু কি জুলাই গণঅভ্যুত্থান? এর পূর্বেও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে গত পনেরো বছর যাবৎ স্বৈরাচার শেখ হাসিনা বিরোধী আন্দোলনে স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ করেছে ‘আদিবাসী’ জনগোষ্ঠী।

‘আদিবাসী’ জনগোষ্ঠীরা এদেশে ব্রিটিশ শাসন আমল থেকে বসবাস করছে। ওই সময় থেকে তারা শোষিত। ‘আদিবাসী’ স্বীকৃতি পাওয়ার লড়াই ব্রিটিশ শাসন আমল থেকে শুরু হয়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে সে স্বীকৃতি নিশ্চিত হবে ভেবেছিল তারা। কিন্তু এখানকার ক্ষমতার একচেটিয়া চেষ্টায় মুজিব থেকে জিয়া, জিয়া থেকে এরশাদ, খালেদা থেকে হাসিনা—বারবার, বারংবার অদৃশ্য শক্তি দ্বারা ‘আদিবাসী’ জনগোষ্ঠীকে স্বীকৃতি তো দূরে থাক, চূড়ান্ত নিপীড়ন, নির্যাতন ও অধিকারহীন জীবনযাপনে বাধ্য করা হয়েছে।

জুলাই গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে অধিকার সচেতন বাঙালি ও ‘আদিবাসী’ জনগোষ্ঠীর একটি ব্যাপক অংশ মানুষ এই দুরবস্থা ভাঙতে চেয়েছে। দেশের সমস্ত শহরে গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে দেয়ালগুলোতে ‘আদিবাসী’-দের স্বীকৃতি দিয়ে গ্রাফিতি আঁকা হয়েছে। কোথাও কোথাও এই দেয়ালিকা পরিকল্পিতভাবে মুছে দেয়া হয়।

পুরো বিশ্ব তাকিয়ে দেখেছে বাংলাদেশে শিক্ষার্থীদের এই গ্রাফিতি। কিন্তু দেশে থাকা বর্ণবাদী ও সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর চরমপন্থি অহংবোধ তা মেনে নিতে পারেনি। যদিও এই অহংবোধ সৃষ্টি করা হয়েছে পরিকল্পিত ভাবে, জমি চাষ করা হয়েছে মানুষের মননে। যাতে মানুষের মননে ‘আদিবাসী’ জনগোষ্ঠী নিয়ে বর্ণবাদী আচরণ আরও তীব্রভাবে রূপান্তরিত হতে পারে।

গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের নতুন পাঠ্যবইয়ে গল্প-কবিতা, সংকলন এবং ছবি ও গ্রাফিতির মাধ্যমে নানাভাবে উঠে এসেছে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের কথা। এর মধ্যে নবম ও দশম শ্রেণির বাংলা ভাষার ব্যাকরণ ও নির্মিতি বইয়ের পেছনের প্রচ্ছদে ‘আদিবাসী’ শব্দ থাকা একটি গ্রাফিতি যুক্ত করা হয়েছিল। কিন্তু এর প্রতিবাদ জানিয়ে তা বাতিলের দাবিতে আন্দোলন শুরু করে ‘স্টুডেন্ট ফর সভারেন্টি’ নামে একটি সংগঠন। আদিবাসী শব্দটি বাতিলসহ কয়েকটি দাবিতে এই সংগঠনের ব্যানারে গত রবিবার (১২ জানুয়ারি) মতিঝিলে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) ঘেরাও করে বিক্ষোভ করে।

বিক্ষোভটি অনেকটা চমকপ্রদ ও সন্ত্রাসী কায়দায় পরিচালিত হয় প্রশাসনের নাকের গড়া দিয়ে, তবুও এই বিক্ষোভটি পরিচালিত হয়। বিক্ষোভটি করার তিন দিন পূর্ব থেকেই এনসিটিবি ঘেরাও কর্মসূচি বলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভীষণভাবে প্রচারণা করা হয়। বিভিন্ন বিতর্কিত, বর্ণবাদী ভাষায় ‘আদিবাসী’ শব্দ বা শিক্ষার্থীদের ‘আদিবাসী’ স্বীকৃত গ্রাফিতি বই থেকে সরিয়ে নেওয়ার যে প্রপাগান্ডা সেটি পরিচালনা করে। এবং গত রবিবার এনসিটিবি ঘেরাও করে এনসিটিবিতে প্রবেশ করে। বলে রাখা ভালো এনসিটিবিতে পুরো দলবল নিয়ে ‘স্টুডেন্ট ফর সভারেন্টি’ সংগঠনটির নেতারা প্রবেশ করে। পুরো বিক্ষোভ জুড়েই বর্ণবাদী, বিদ্বেষ ও অকথ্য শব্দ ব্যবহার করে ‘আদিবাসী’ জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে স্লোগান দিতে থাকে।

‘স্টুডেন্ট ফর সভারেন্টির’ এনসিটিবির চেয়ারম্যানের প্রতিনিধিরা তাদের সঙ্গে বৈঠক করেছে। সেখানে তারা জানিয়েছেন ভুল থেকে এটি হয়েছিল। এটি তারা ১২ জানুয়ারির (রবিবার) মধ্যেই সংশোধন করবেন। পরে রাতে এনসিটিবির ওয়েবসাইটে ঢুকে দেখা যায় ওই বইয়ে ‘আদিবাসী’ যুক্ত থাকা গ্রাফিতি পরিবর্তন করে ‘বল বীর/ চির উন্নত/ মম শির’ লেখা নতুন গ্রাফিতি যুক্ত করা হয়েছে।

একটি মব সংগঠন যে সংগঠনটি দীর্ঘদিন যাবৎ স্বৈরাচার শেখ হাসিনা থাকাকালীন সময়ে এবং পরবর্তী সময়েও ‘আদিবাসী’ জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে একটি মিথ্যা বয়ানের প্রপাগান্ডা তৈরি করেছিল। পাশাপাশি বর্ণবাদী দৃষ্টিতে ‘আদিবাসী’ জনগোষ্ঠীকে হয়রানি, অপদস্থ ও বিষোদ্‌গার করে চলেছিল। সে সংগঠনটিকে সংজ্ঞায়িত করা যায় একটি বর্ণবাদী কিংবা চরমপন্থি সংগঠন হিসেবে। সে সংগঠনের অপব্যাখ্যা ও বর্ণবাদী দৃষ্টিকোণকে প্রাধান্য দিয়ে এনসিটিবির তাৎক্ষণিক ‘আদিবাসী’ যুক্ত গ্রাফিতি সরিয়ে নেওয়া গণঅভ্যুত্থানের চেতনা বৈষম্যহীন বাংলাদেশের স্বপ্নের সাথে প্রতারণা বটেই, পাশাপাশি বর্ণবাদী আচরণকে বর্ণবাদী দৃষ্টিকোণ সরাসরি উসকে দেয়। পাহাড় থেকে সমতল, ‘আদিবাসী’ থেকে বাঙালি শিক্ষার্থীরা যে লড়াই লড়েছে জুলাই গণঅভ্যুত্থানে যে ঐক্যবদ্ধতা তৈরি করেছিল, যার প্রকাশ গ্রাফিতিতে তারা ফুটিয়ে তুলে, চিন্তায়, চেতনা ও মননে ধারণ করেছিল। সে লড়াইকে ধ্বংস ও সে একাত্মতাকে ধ্বংসের একটা যাত্রা এনসিটিবির মধ্যস্থতায় তথাকথিত ‘স্টুডেন্ট ফর সভারেন্টি’ সংগঠনটি করেছে। এতে ‘আদিবাসী’-দের প্রতি যে অদৃশ্য নিপীড়ন বাংলাদেশে চলছে, তাকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে।

সুতরাং অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতি আহ্বান থাকবে হঠকারী এই সিদ্ধান্ত বাতিলের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা ও অনতিবিলম্বে সংবিধান সংস্কার প্রস্তাবনায় ‘আদিবাসী’ জনগোষ্ঠীকে স্বীকৃতির প্রস্তাব ও সকল সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ‘আদিবাসী’ জনগোষ্ঠীকে ‘আদিবাসী’ হিসেবে রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেওয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করুন। পাশাপাশি যে সকল বর্ণবাদী, চরমপন্থি সংগঠন ‘আদিবাসী’ জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে মিথ্যা বানোয়াট ব্যাখ্যা বিশৃঙ্খলভাবে তৈরি করছে এবং ছড়াচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা ও কাউন্সেলিং-এর ব্যবস্থা নিন।

মারুফ হাসান ভূঞা
অ্যাকটিভিস্ট ও লেখক
ধানমন্ডি, ঢাকা

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2025 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh