
ডেঙ্গু মশা। ছবি: সংগৃহীত
বর্ষা না আসতেই শুরু হয়েছে ডেঙ্গুর প্রকোপ। ডেঙ্গু এখন আর শহরাঞ্চলের রোগ নয়, এটা এখন সারাদেশের এবং গত ৪/৫ বছর থেকে সারা বছরই ডেঙ্গুর রোগী পাওয়া যাচ্ছে। গত ২০১৯ সালটি ছিল ডেঙ্গু রোগের রেকর্ডের বছর। ২০১৯ সালের ৭ আগস্ট একদিনেই ২ হাজার ৪২৮ জন ডেঙ্গু আক্রান্তের ঘটনা ঘটে। চলতি বছর জানুয়ারি থেকেই মানুষ ডেঙ্গু আক্রান্ত হচ্ছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে গত ১৫ মে পর্যন্ত দেশে এক হাজার ২৬১ জন মানুষ ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছে। ১৭ কোটি মানুষের দেশে গত সাড়ে ৪ মাসে ডেঙ্গু আক্রান্তের এই সংখ্যা খুব নগণ্য হলেও এর একটি নেতিবাচক ইঙ্গিত রয়েছে। তা হলো, সামনের দিনগুলোতে বাড়বে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা। ইতোমধ্যে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক ডেঙ্গুর ব্যাপারে সতর্ক করেছেন।
ডেঙ্গু থেকে বাঁচতে মশা মুক্ত থাকার উপর তিনি গুরুত্বারোপ করেছেন। এজন্য আশপাশের পরিবেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা, বাসাবাড়ির ছাদ, আঙিনায় পানি জমে না থাকে, সেদিকে খেয়াল রাখার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।
বাংলাদেশে ডেঙ্গুর শঙ্কা বাড়ছে
আশঙ্কা করা হচ্ছে, এবার ডেঙ্গু গত বছরের চেয়েও প্রকট হবে। মৌসুমের শুরুতেই হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগী আসতে শুরু করেছে। আগামী জুন থেকে মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে বাংলাদেশে বৃষ্টি শুরু হবে, এটা চলবে আগামী অক্টোবর পর্যন্ত। আবহাওয়ার পূর্বাভাস অনুযায়ী, চলতি বছর মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে প্রবল বর্ষণের সম্ভাবনা কম। বৃষ্টি স্বাভাবিকের চেয়ে কিছুটা কম হওয়ার আশঙ্কা। কিছুদিন বিরতি দিয়ে থেমে থেমে বৃষ্টি ডেঙ্গু জীবাণুবাহিত এডিস মশার উৎপাদনের জন্য আদর্শ পরিবেশ।
ফলে চলতি বছর ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব বেশি থাকার আশঙ্কা করা হচ্ছে। সাধারণত এপ্রিল থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ডেঙ্গু রোগের সিজন। কিন্তু এ বছর এটা শেষ পর্যন্তই থাকতে পারে। বিগত বছরগুলোর অভিজ্ঞতা থেকে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিগত বছরগুলোর মতো এবারও ডেঙ্গু রোগের প্রাদুর্ভাব বেশ ভালোই থাকবে।
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ প্রাণিবিজ্ঞান সমিতির সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ড. মঞ্জুর আহমেদ চৌধুরী বলেন, গত মার্চ থেকেই থেমে থেমে বৃষ্টি হতে শুরু করেছে। এপ্রিলেও এরকমই হয়েছে, চলতি মে মাসেও এমনই হচ্ছে। সামান্য বৃষ্টি হয়ে থেমে যাচ্ছে। সামান্য বৃষ্টি হয়ে গেলে এটা কোনো কোনো স্থানে পানিটা জমে থাকে। আর সেই পানিতে এডিস মশা ডিম ছেড়ে দিচ্ছে এবং এতে কয়েক দিনের মধ্যেই এডিস মশা কামড়াতে শুরু করবে।
চলতি বছর ডেঙ্গুর সংক্রমণ
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার অ্যান্ড কনট্রোল রুমের তথ্য অনুযায়ী চলতি বছরে এর মধ্যে এই রোগে ১২ জনের মৃত্যু হয়েছে। এটা ইঙ্গিত করছে, সামনের বর্ষায় ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব কেমন হবে। তবে সবচেয়ে বেশি খারাপ পরিস্থিতি হতে পারে আগামী জুন থেকে অক্টোবর পর্যন্ত। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, বাংলাদেশে এখন ১২ মাসই ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী পাওয়া যাচ্ছে। কারণ বৃষ্টির বাইরে উন্নয়নমূলক নানা ধরনের কাজের কারণে এডিস মশা জন্ম নিচ্ছে।
এর মধ্যে নির্মাণ শিল্প অন্যতম। একটি ভবন তৈরি করতে এক থেকে দুই বছর লেগে যায়। এই সময়ের মধ্যে ভবনের কাঠামোই নির্মাণ করতে থাকে ডেভেলপাররা। ফলে নির্মাণাধীন ভবনের প্রতিটি তলায় দীর্ঘদিনের জমে থাকা পানিতে এডিস মশা নিয়মিতই ডিম ছেড়ে লার্ভা ফুটাতে পারে। এটা চলতেই থাকে। কারণ ভবনের কাঠামো নির্মাণ শেষ না হলে ডেভেলপাররা ফ্লোরগুলোতে কাজ ধরতে আসে না। এভাবে নির্মাণ শিল্পই এডিস মশা বিস্তারে বিরাট ভূমিকা রাখে।
বাংলাদেশের জন্য ২০২২ সালটা ভয়াবহ বিপদের মধ্যে গিয়েছে। একদিকে কোভিড, অন্যদিকে ডেঙ্গু সংক্রমণ। ২০২২ সালে সারাদেশে ৬২ হাজার ৩৮২ জন মানুষ ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন, এর বাইরে আরও অনেক ডেঙ্গু আক্রান্ত চিকিৎসা ছাড়াই সুস্থ হয়ে গেছেন এবং অনেকেই চিকিৎসকের প্রাইভেট চেম্বারে গেছেন। এদের হিসাব সরকারি খাতায় উঠানোর সুযোগ নেই। ২০২১ সালে ডেঙ্গু সংক্রমিতদের হাসপাতালে মোট ভর্তি হয়েছিলেন ২৮ হাজার ৪২৯ জন, মারা যান ১০৫ জন।
এডিস মশার জরিপ
এডিস মশা বিষয়ক জরিপ অনুযায়ী, ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের কয়েকটি ওয়ার্ড আছে যেখানে সারা বছরই মশা জন্মে। আবার এডিস মশার ব্রিডিং প্লেসও এসব এলাকা। কারণ কয়েকটি ওয়ার্ড খুবই ঘিঞ্জি এবং সারাবছরই পানি থাকে। এসব স্থানগুলো কখনোই সেরকম পরিষ্কার করা হয় না। জরিপে দেখা যায়, এডিস মশার প্রায় ৪০ শতাংশের ব্রিডিং প্লেস বসবাসযোগ্য বহুতল ভবন এবং ৩২ শতাংশ নির্মাণাধীন ভবন।
আবার ঢাকার কিছু কিছু এলাকার বাড়িতেই এডিস মশা সারা বছরই জন্মে থাকে। চলতি বছরের ২৬ জানুয়ারি থেকে ৪ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন এলাকার ১০৮টি ওয়ার্ডে জরিপ চালানো হয়। এর মধ্যে উত্তর সিটির ৪০টি এবং দক্ষিণ সিটির ৫০টি ওয়ার্ডের তিন হাজার ১৫০টি বাড়িকে জরিপের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এই জরিপের সঙ্গে যুক্ত কীটতত্ত্ববিদ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক কবিরুল বাশার।
তিনি জরিপের ফল প্রকাশের পর বলেন, গতবারের চেয়ে এবার এডিস মশার ঘনত্বটাও একটু বেশি। তা সত্ত্বেও এই জরিপে আসল চিত্র পাওয়া যায়নি। কারণ জরিপ করার সময়ে সংশ্লিষ্ট স্থানে বৃষ্টি ছিল না। আমরা এ মাসের (চলতি মে) শেষ দিকে আরেকটা জরিপ করব, তাতে হয়তো প্রকৃত চিত্র পাওয়া যাবে। এডিস মশার বংশ বৃদ্ধির বিষয়ে তিনি বলেন, মশার বংশ বৃদ্ধির জন্য এখন আর বৃষ্টির প্রয়োজন হয় না। নির্মাণাধীন ভবনে কিংবা বসবাসরত ভবনে সারা বছরই নানা কাজে পানি জমিয়ে রাখা হয়। এ কারণে মৌসুম ছাড়াও এডিস মশা পাওয়া যাচ্ছে। তাই ডেঙ্গু এখন সারা বছরের রোগে পরিণত হয়েছে।
মশা মারার ভুল পদ্ধতি
প্রতিবছর ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের বাজেটে মশা নিয়ন্ত্রণে অর্থের পরিমাণ বাড়ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তবু ঢাকা থেকে মশা নির্মূল করা সম্ভব হচ্ছে না। গত ৬ অর্থবছরে মশা নিয়ন্ত্রণে দুই সিটি করপোরেশন ব্যয় করেছে প্রায় ৩৮৭ কোটি টাকা। কিন্তু দুই সিটি করপোরেশনই ভুল পদ্ধতিতে মশা নির্মূলের চেষ্টা করছে।
এটা ঢাকার উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম সংবাদ মাধ্যমের কাছে স্বীকারও করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের মিয়ামি সফর করে এসে তিনি সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, ‘রাজধানীর মশা নিধনে এতদিন যে পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়েছে, সেটি ভুল ছিল। এতে মশা ধ্বংস হয়নি বরং অর্থের অপচয় হয়েছে। মিয়ামিতে যে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি, তা ঢাকায় মশা নির্মূলে কাজে লাগাতে চাই।’
২০২২-২৩ অর্থবছরে দুই সিটি করপোরেশন মশা নিয়ন্ত্রণে বরাদ্দ রেখেছে ১৪৭ কোটি টাকা। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের বরাদ্দ ১০১ কোটি টাকা এবং ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন রেখেছে ৪৫.৭৫ কোটি টাকা। তবে উত্তর সিটি করপোরেশনে এরপর থেকে লার্ভিসাইডিংয়ের সময় সকাল ৮টার পরিবর্তে ভোর ৬টা থেকে শুরু করা হয়েছে।
এর কারণ হিসেবে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোঃ জোবায়দুর রহমান বলেন, আমরা কীটবিদদের পরামর্শে লার্ভিসাইডিংয়ের সময় পরিবর্তন করেছি। কারণ সকাল ৮টায় সূর্যের তাপ বাড়তে থাকে এবং লার্ভাগুলো পানির নিচে চলে যায়। এতে পানির ওপরে লার্ভিসাইডিং করলে খুব কমই ফল পাওয়া যায়। ভোর ৬টা থেকে করতে শুরু করলে পানিতে ভাসমান সবগুলো লার্ভাকেই মেরে ফেলা যায়। তিনি বলেন, এটা ছাড়াও বায়োলজিক্যালি মশা নিয়ন্ত্রণের ওপর গুরুত্ব দিচ্ছি, এতে পরিবেশেরও কোনো ক্ষতি হয় না।