
দেশে ষাটোর্ধ্ব মানুষের সংখ্যা মোট জনসংখ্যার ৭.৯ শতাংশ। ছবি: সংগৃহীত
দেশে প্রবীণদের সংখ্যা বাড়ছে। কিন্তু সে তুলনায় তাদের জন্য পরিকল্পিতভাবে কিছু করা হচ্ছে না। এই মানুষগুলোর প্রয়োজন কীভাবে পূরণ করা হবে, সে ধরনের সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নেই। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (২০১৮) তথ্য অনুসারে, দেশে ষাটোর্ধ্ব মানুষের সংখ্যা মোট জনসংখ্যার ৭.৯ শতাংশ।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) বলছে, ২০২০ সালেই প্রবীণদের সংখ্যা ৫ বছরের শিশুদের সংখ্যার চেয়ে বেড়ে গেছে। অপরদিকে ২০৫০ সালের মধ্যে ৮০ শতাংশ প্রবীণ বাস করবে নিম্ন ও মধ্য আয়ের দেশগুলোতে।
অতীতের চেয়ে বর্তমানে অনেক দ্রুতগতিতে প্রবীণদের সংখ্যা বাড়ছে। ২০১৫ থেকে ২০৫০ সালের মধ্যে প্রবীণ জনগোষ্ঠীর সংখ্যা এখনকার চেয়ে দ্বিগুণ অর্থাৎ ১২ শতাংশ থেকে ২২ শতাংশে উন্নীত হবে এবং ২০৩০ সালের মধ্যে প্রতি ৬ জন মানুষের মধ্যে একজন থাকবেন প্রবীণ, যাদের বয়স ৬০ বছরের বেশি। ২০৫০-এর মধ্যে সারা পৃথিবীতে মোট প্রবীণের সংখ্যা হবে ২১০ কোটি। এদিকে বাংলাদেশে ২০৩০ সালের আগেই প্রবীণ জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ২ কোটি ছাড়িয়ে যাবে। এতে আর্থ-সামাজিকভাবে কিছু সমস্যা দেখা দিতে পারে। এসব সমস্যা দূর করতে রাষ্ট্র থেকেই উদ্যোগ নেওয়া উচিত। কিন্তু প্রবীণদের জন্য কোনো টেকসই পরিকল্পনা নেই। বয়স্ক মানুষদের সমাজের বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মধ্যে সমন্বিত করতে না পারলে তারা একসময় বোঝা হয়ে দাঁড়াবে।
প্রবীণদের অন্যতম প্রধান সমস্যা চিকিৎসা সেবা পাওয়া। ৫০ বছর বয়স হলেই নানা ধরনের রোগের লক্ষণ দেখা দিতে শুরু করে। তাদের জন্য হাসপাতালে আলাদা চিকিৎসা ব্যবস্থা থাকলে তারা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সেখানে চিকিৎসা করাতে পারতেন। কিন্তু দেশে সে ব্যবস্থা নেই। তাই তাদের জন্য হাসপাতালে বিশেষ চিকিৎসা ব্যবস্থা রাখা প্রয়োজন।
আবার প্রবীণদের আয়-রোজগার কমে যায় বলে তারা নির্ভরশীল হয়ে পড়েন। এ বিষয়ে ডব্লিউএইচএ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া বিষয়ক সাবেক উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. মোজাহেরুল হক বলেন, ‘তাদের জন্য পর্যাপ্ত বয়স্কভাতা অথবা কর্মক্ষম থাকার সময় থেকেই রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে সঞ্চয়ের ব্যবস্থা করা উচিত। যেন পরে এই সঞ্চয় থেকেই স্থায়ী পেনশনের ব্যবস্থা করা যায়। দেশে যে বয়স্ক ভাতা চালু আছে সবাই তা পায় না। তাদের যে টাকা দেওয়া হয় তা পর্যাপ্তও নয়। বয়স্ক ভাতা ও তাদের জন্য বিশেষায়িত হাসপাতাল করে দিতে পারলে প্রবীণরা আর বোঝা হয়ে থাকবেন না।’
ষাটোর্ধ্বদের প্রধান সমস্যা রোগ
বয়স বাড়লে শরীরে কিছু রোগ বাসা বাঁধে, আর কিছু রোগ স্থায়ী হয়ে যায়। ষাটোর্ধ্বদের বেশিরভাগেরই ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, কিডনি, থাইরয়েড সমস্যায় আক্রান্ত হয়ে থাকেন। প্রকৃতপক্ষে এসব সমস্যা আরও ১০ থেকে ১৫ বছর আগে থেকেই শুরু হয়; কিন্তু সচেতনতার অভাবে অনেকের কাছে সমস্যাগুলো গুরুত্ব পায় না।
বয়স বাড়লে ধীরে ধীরে দেহের বিভিন্ন গ্রন্থি, কলা বা টিস্যুর কার্যকারিতা হ্রাস পায়। ফলে বিপাকক্রিয়া ও শক্তি হ্রাস পায়। এ সময় ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন ডির অভাব দেখা দেয়। ফলে হাড় নরম, পাতলা ও ভঙ্গুর হয়ে থাকে। এজন্য বয়স বাড়লে শরীরের কাঠামো দুর্বল ও সামনের দিকে ঝুঁকে যায় এবং অস্টিওপোরোসিস রোগে আক্রান্ত হয়ে সামান্য আঘাতেই অথবা হোঁচট খেলেই হাড় ভেঙে যায়। ষাটোর্ধ্ব হলে লালারসের ক্ষরণ কমে গিয়ে মুখের শুষ্কতার কারণে দাঁত ক্ষয় হয় এবং তারা স্বাভাবিক চিবানোর ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। এ সময় পরিপাকতন্ত্রের কার্যক্ষমতা কমে যায়।
স্মরণশক্তি লোপ
ষাটোর্ধ্ব হলে স্মরণশক্তি লোপ পেতে থাকে। শুরু হয় ডিমেনশিয়া ও আলঝেইমারের মতো রোগ। বার্ধক্যজনিত বিভিন্ন শরীরিক সমস্যার সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন মানসিক সমস্যাও দেখা যায়। গবেষণায় দেখা গেছে, ৬০ বছর বয়সের বেশি ১৫ শতাংশ মানুষ কোনো না কোনো ধরনের মানসিক রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকেন। বার্ধক্যজনিত মানসিক সমস্যা থেকে আসে বিষণœতা, উদ্বেগ, ডিমেনশিয়া বা স্মৃতিভ্রম রোগ, সিজোফ্রেনিয়া, বাইপোলার মুড ডিসঅর্ডার বা দ্বি-প্রান্তিক আবেগীয় রোগ, প্রলাপ বকা, ঘুমের সমস্যা। বয়সকালে এ জাতীয় শরীরিক ও মানসিক সমস্যা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে দেহের পুষ্টি চাহিদাকে প্রভাবিত করে এবং রোগগ্রস্ত হওয়ার সঙ্গে দুর্বলও হয়ে পড়েন তারা।
পুষ্টি চাহিদা
৪০ বছর বয়স থেকেই শারীরিক কর্মক্ষমতা হ্রাসসহ দেহে নানা পরিবর্তন আসতে শুরু করে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ৪০ থেকে ৫৯ বছর বয়স পর্যন্ত প্রতি ১০ বছরের জন্য প্রয়োজনীয় ক্যালরির ৫ শতাংশ কম গ্রহণ করার সুপারিশ করেছে। ৬০ থেকে ৬৯ বছর বয়সে ১০ শতাংশ এবং ৭০ বছর বয়সের পর আরও ১০ শতাংশ ক্যালরি কম গ্রহণ করার পরামর্শ দিয়েছে। বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে মানুষের ক্যালরি চাহিদাও কমতে থাকে। যদিও এটা অনেকটাই নির্ভর করে প্রবীণদের কাজের ধরন ও শরীরের পুষ্টির অবস্থার ওপর। একজন বয়স্ক নারীর প্রতিদিন প্রায় এক হাজার ৩০০ কিলোক্যালরি এবং পুরুষের এক হাজার ৮০০ কিলোক্যালরি গ্রহণ করতে হয়।
বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দেহকোষের ক্ষয় বেশি হয় বলে ক্ষয়পূরণকারী খাদ্য আমিষ প্রয়োজন অনুযায়ী খেতে হয়। মাছ, গোশত, দুধ, ডিম, ডাল ইত্যাদি থাকতে হবে খাদ্য তালিকায়। ডবিøউএইচওর সুপারিশ অনুযায়ী, ব্যক্তির প্রতি কেজি ওজনের জন্য প্রায় এক গ্রাম আমিষ গ্রহণ করতে হবে। মোট শক্তি চাহিদার ১১ থেকে ১২ শতাংশ আমিষ থেকে আসতে হবে। এই আমিষের অন্তত এক-তৃতীয়াংশ প্রাণিজ আমিষ থেকে গ্রহণ করা ভালো। এছাড়াও বাদাম, শস্য ও ডাল জাতীয় খাদ্য, যাতে আমিষের পরিমাণ বেশি তা খেতে হবে। পর্যাপ্ত আমিষ না খেলে প্রবীণদের শরীরে বিশেষ করে পায়ে পানি জমতে (এডেমা রোগ) পারে।
ডা. মোজাহেরুল বলেন, ষাটোর্ধ্ব হয়ে গেলে সহজেই বিভিন্ন রোগ-ব্যাধি আক্রমণ করে। এ সময় রোগ প্রতিরোধকারী পুষ্টি উপাদান যেমন-খনিজ পদার্থ ও ভিটামিন সমৃদ্ধ খাবার খেতে হবে। সবুজ শাক, সবজি ও তাজা ফলমূল বিভিন্ন ধরনের ভিটামিন ও খনিজ উপাদানের ভাণ্ডার হিসেবে পরিচিত। অধিকাংশ সময়ে দেখা যায় এ বয়সে অনেকের কোষ্ঠকাঠিন্য হয়ে থাকে। কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করার জন্য আঁশ জাতীয় খাদ্য যেমন শাকসবজি ও ফলমূল খেতে হবে। শাকসবজি খেতে কারও অসুবিধা হলে দিনে অন্তত দুই বার ফল খেতে হবে। তবে ডায়াবেটিস রোগীদের ফল খাওয়ার ক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। প্রতিদিন পরিমিত পরিমাণ বিশুদ্ধ পানি পান করতে হবে।
বার্ধক্যে রক্তস্বল্পতা
অধ্যাপক মোজাহেরুল বলেন, বার্ধক্যে পার্নিসিয়াস অ্যানিমিয়া নামে বিশেষ ধরনের রক্তস্বল্পতা দেখা যায়। প্রধানত ভিটামিন বি১২-এর অভাবে এ রক্তস্বল্পতা দেখা দেয়। ফলে অবসন্নতা, বিষণ্নতা, দুর্বলতা, মাথাব্যথা হয় এবং ওজন কমে যায়। ভিটামিন বি১২ সাধারণত কলিজা, মাছ, মাংস, ডিম, দুধ থেকে পাওয়া যায়। এছাড়া লৌহের অভাবেও রক্তস্বল্পতা দেখা দেয়। তাই এ সময় লৌহসমৃদ্ধ খাবার খেতে হবে। ভিটামিন সি শরীরে লৌহের শোষণ বৃদ্ধি করে।
খাবারে লবণ কম খেতে হবে। পাঁচ বছর বয়সের পর লবণ শরীরে কোনো কাজে লাগে না। লবণ খেতে হবে পরিমিত এবং আলাদাভাবে লবণ খাওয়া হতে বিরত থাকতে হবে। অতিরিক্ত লবণ শরীরে সোডিয়ামের পরিমাণ বাড়িয়ে দেয় এবং অতিরিক্ত ক্যালসিয়ামের নিঃসরণ ঘটায়। যার ফলে হাড়ের ঘনত্ব কমে যায়। এছাড়াও রক্তনালিতে লবণের পরিমাণ বেড়ে গেলে রক্তের ঘনত্ব বৃদ্ধি পায় এবং অভিস্রবণ প্রক্রিয়ায় রক্তনালিতে পানির পরিমাণ বেড়ে যায়। ক্ষুধামন্দা ও মুখের অরুচি বয়স্কদের একটি সাধারণ সমস্যা। বি গ্রুপের ভিটামিনগুলো ক্ষুধামন্দা দূর করে মুখের রুচি বৃদ্ধি করে এবং হজম, পরিপাক ও বিপাকে সহায়তা করে থাকে। তাই বি গ্রুপের ভিটামিন সমৃদ্ধ খাবার তাদের বেশি করে খেতে হবে।
নিয়মিত শরীরচর্চা
হালকা ব্যায়াম স্বাস্থ্য সম্পর্কিত জটিলতা হ্রাস করে এবং শরীর সুস্থ, সবল ও কর্মক্ষম রাখে। ব্যায়ামের ফলে বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ--পেশি, হৃৎপিণ্ড, পাকস্থলী, ফুসফুস, মস্তিষ্ক, অস্থি ভালো রাখে ও রক্ত চলাচল সচল করে। নিয়মিত ব্যায়াম অকাল বৃদ্ধ রোধ করে, ডায়াবেটিস, রক্তচাপ, ওজন ও কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণ, হৃদরোগ ও স্ট্রোকের ঝুঁকি কমায়। তাছাড়া ব্যায়ামের ফলে মানসিক প্রফুল্লতা আসে, ঘুম ভালো হয়, কাজ-কর্মে সতেজতা আসে, মস্তিষ্কের কার্যকারিতা ও হজম শক্তি বৃদ্ধি করে।