Logo
×

Follow Us

লাইফস্টাইল

হিপনোফোবিয়ায় রাতে ঘুম আসে না

Icon

রাইয়্যিদাল কবির

প্রকাশ: ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১২:৪৯

হিপনোফোবিয়ায় রাতে ঘুম আসে না

প্রতীকী ছবি

রাতে ভয়ে ঘুমাতে না পারাটা অনেকের মধ্যে একটা সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। চিকিৎসকদের ভাষায়- এটা হিপনোফোবিয়া। না ঘুমিয়ে কাটালে ভুক্তভোগী নানা ধরনের মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত হয়ে থাকেন; যা নিজের কাজে অসফলতা নিয়ে আসে এবং শেষ পর্যন্ত পারিবারিক অশান্তি কারণ হয়ে থাকে। 

কিন্তু ভয়ে না ঘুমাতে পারাটা একটা মানসিক রোগ। মনোরোগ চিকিৎসকরা বলছেন, সঠিক সময়ে সঠিক চিকিৎসা পেলে হিপনোফোবিয়া রোগী সুস্থ হয়ে যায়। এ জন্য এ রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিকে চিকিৎসকের উপদেশ পুরোপুরি মেনে চলতে হবে এবং ওষুধ নিয়মিত সেবন করতে হবে। বয়সভেদে বিশ্বের প্রায় ৩০ শতাংশ মানুষই নিদ্রাহীনতা সমস্যায় ভুগছেন। এর মধ্যে কেবল ভয়ে না ঘুমাতে পারার অংশ একেবারেই কম নয়। কোভিড মহামারির পর এ রোগটি আরও বেড়েছে বলে চিকিৎসকরা বলছেন। বিশেষ করে বয়স্ক ব্যক্তি এবং অন্তঃসত্ত্বা নারী বা নতুন মায়েদের ৫০ শতাংশ পর্যাপ্ত ঘুম থেকে বঞ্চিত।

কী কারণে হয় হিপনোফোবিয়া?

আত্মরক্ষার প্রস্তুতি থেকেই অবচেতন মনে ধীরে ধীরে বাসা বাঁধে হিপনোফোবিয়া। অতীত জীবনে ঘুম বা সম্মোহন সংক্রান্ত কোনো সমস্যা ঘটে থাকলে এক সময় ভুক্তভোগীর মনে এর প্রভাব পড়ে। এছাড়া ঘনিষ্ঠজনের কোনো কষ্টকর ঘটনার প্রত্যক্ষ অথবা নীরব সাক্ষী বা সিনেমা ও টিভিতে দেখানো ভয়ঙ্কর কোনো দৃশ্য দেখলে হিপনোফোবিয়ায় আক্রান্ত হতে পারে মানুষ। এসব স্মৃতি অবচেতনে মানসিক বিকার তৈরি করে। এসবের কারণেই সৃষ্টি হয়ে থাকে ভয়ে না ঘুমানোর রোগ বা হিপনোফোবিয়া। চিকিৎসকরা বলছেন, ঘুমে ভয় যে কোনো বয়সে ঘটতে পারে। যেমন কারও মনে হতে পারে, ‘সে রাতে মারা যেতে পারে, ঘুমালেই তার বুকে কেউ চেপে বসতে পারে অথবা কেউ হয়তো ওঁৎ পেতে আছে তার ক্ষতি করার জন্য’-এসব কারণে কারও ঘুম নাও আসতে পারে। এ ধরনের চরম উদ্বেগ ব্যক্তির মধ্যে আতঙ্ক তৈরি হয় এবং তিনি সারারাত না ঘুমিয়ে কাটিয়ে দিতে পারেন। 

না ঘুমানোর কারণে ধীরে ধীরে স্বাস্থ্যের অবনতি তো ঘটেই, একই সঙ্গে ব্যক্তি মানসিক রোগে আক্রান্ত হয়ে যেতে থাকে। হিপনোফোবিয়ার সঠিক সময়ে চিকিৎসা না হলে ব্যক্তি দীর্ঘ মেয়াদে জটিলতায় ভুগতে পারে। চিকিৎসকরা বলছেন, এ জন্য শুধু মনস্তাত্ত্বিক চিকিৎসা যথেষ্ট নয়, কিছু ক্ষেত্রে ওষুধেরও প্রয়োজন হয়। 

হিপনোফোবিয়ার লক্ষণ

হিপনোফোবিয়ায় আক্রান্ত রোগীদের সর্বদা অত্যধিক ভয় ও দুশ্চিন্তা কাজ করে। এ ধরনের রোগী ইনসোমনিয়া বা অনিদ্রায় ভুগে থাকে, ঘুমানোর সময় তাদের শ্বাসের স্বল্পতা বা শ্বাস নিতে কষ্ট হয়ে থাকতে পারে, দ্রুত শ্বাস নিতে হতে পারে, হৃদযন্ত্রের স্পন্দন একটু বেশি থাকে। মাত্রাতিরিক্ত ঘাম হয়ে থাকে, সব সময় কেমন যেন বিতৃষ্ণাবোধ বা সবকিছুতে বিরক্তিবোধ কাজ করে এবং সর্বদা আতঙ্কগ্রস্ত থাকে, মুখ শুকিয়ে যাওয়ার মতো ঘটনা ঘটে থাকে, মনোযোগের অভাব ঘটে, বাকযন্ত্রের আড়ষ্টতা থাকে। ফলে কথা স্পষ্ট হয় না, এ ধরনের রোগী মানসিক অস্থিরতায় ভোগেন, খিঁচুনি হয়ে থাকে, শরীরে শক্তিশূন্যতা দেখা দিতে পারে, অনুভূতির নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে, সব সময় না হলেও সময়ে সময়ে মাথাব্যথা হয়ে থাকে, ঘুমের মাঝে অনেক সময় হেঁটে বাইরে চলে যায়, অবচেতন মনে বিছানা ভিজিয়ে ফেলে। চিকিৎসকরা বলছেন, উপরিউক্ত লক্ষণগুলো সবার মধ্যে একত্রে নাও থাকতে পারে, ব্যক্তিবিশেষে রোগের লক্ষণ পাল্টে যেতে পারে। যেহেতু এই রোগের নির্দিষ্ট কোনো কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না। 

হিপনোফোবিয়ায় আক্রান্ত হলে শরীরে যা ঘটে

হিপনোফোবিয়া একটি মানসিক সমস্যা। সাধারণত উঠতি বয়সী তরুণ-তরুণীদের বেলায় এটা বেশি ঘটে। নারীদের মধ্যে এ রোগটি পুরুষের চেয়ে দ্বিগুণ। মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ হলো- সময়মতো এই রোগের চিকিৎসা না করালে আতঙ্কের মধ্য দিয়েই আক্রান্ত ব্যক্তিকে জীবন কাটিয়ে দিতে হবে। তবে চিকিৎসকরা বলছেন, সঠিক সময়ে চিকিৎসা করালে ৭০ থেকে ৯০ ভাগ রোগী পুরোপুরিভাবেই সুস্থ হয়ে যায়। 

ভয়ে রোগে আক্রান্ত অনেকেই তাদের রোগের উপসর্গ নিয়ে খুব চিন্তায় থাকেন। এমনকি ডাক্তার যদি আশ্বস্ত করেন যে, এসব উপসর্গ মারাত্মক কিছু নয় তবুও তারা দুশ্চিন্তায় দিন কাটান। চিকিৎসকরা বলছেন, উপসর্গগুলো ধীরে ধীরে বিলীন হওয়ার জন্য ঘণ্টাখানেক বা বছরের পর বছর সময়ও লাগতে পারে। অনেক সময় তারা পাগলাটে ধরনের আচরণ করে থাকেন। অনেক ক্ষেত্রে অকারণে নিজেদের হার্টের রোগী, নিউরোলজিক্যাল রোগী বা কোনো মারাত্মক খারাপ অসুখের রোগী মনে করে ভয় পায় এবং প্রায়ই ডাক্তারের কাছে চিকিৎসার জন্য ছুটে যান। অনেকে আবার বারবার ডাক্তার পাল্টে যাচাই করার মানসিকতা দেখিয়ে থাকেন এবং রোগ নির্ণয়ের জন্য কতকগুলো অপ্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা বারবার করাতেই থাকেন। মনোবিদরা বলছেন, ‘এগুলোর যদিও কোনো প্রয়োজন নেই, তবে এতে করে রোগী সাময়িকভাবে মানসিক সান্ত্বনা খুঁজে পেতেও পারেন।’ অতিরিক্ত চা-কফি পান অথবা কোনো উত্তেজক ওষুধ অতিমাত্রায় ব্যবহারের ফলেও ভয়ের সৃষ্টি হতে পারে। 

হিপনোফোবিয়া নিয়ে বেঁচে থাকা কি ক্ষতিকর?

হিপনোফোবিয়া নিয়ে বেঁচে থাকাটা ক্ষতিকর। মনোবিদরা বলছেন, সময়মতো ঘুমে ভয় বা হিপনোফোবিয়ার চিকিৎসা না করালে সারা জীবন ভয়াবহ আতঙ্কের মধ্যেই থাকতে হবে রোগটিতে আক্রান্ত ব্যক্তি। পারিবারিক অশান্তি তো ঘটেই থাকে আবার কোনো কোনো সময় স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে এমনকি পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের মধ্যে সম্পর্ক ছেদ পর্যন্ত ঘটতে পারে। সময়মতো সিদ্ধান্ত নিতে না পারায় জীবনের বহু গুরুত্বপূর্ণ কাজ করা হয় না এবং সাফল্য আসে না। সব মিলিয়ে অসুখী জীবন যেন নিয়তি হয়ে ওঠে। 

নির্ঘুম রাত মানুষকে স্বার্থপর করে

নির্ঘুম রাত মানুষকে স্বার্থপর ও অসামাজিক করে তোলে। যুক্তরাষ্ট্রের গবেষকরা দেখেছেন, মাত্র এক ঘণ্টার বিশ্রামের অভাবে স্বজন বা কাছের বন্ধুদের সাহায্য করার আগ্রহ কমে যায়। তারা বলছেন, মস্তিষ্কের যে অংশ সামাজিক আচরণের জন্য দায়ী সে অংশটির কার্যকারিতা কমিয়ে দেয় নির্ঘুম রাত। ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক অধ্যাপক ম্যাথু ওয়াকার বলেন, ঘুম বঞ্চিত হওয়া অসামাজিক আচরণের মাত্রা বাড়ায়। মানুষের ভেতর পারস্পরিক সাহায্যের মনোভাবকে কমিয়ে আনে। যত কম ঘুম হবে, তত কম সামাজিক এবং তত বেশি স্বার্থপর হয়ে ওঠার প্রবণতা লক্ষ্য করেছেন গবেষক অধ্যাপক ম্যাথু ওয়াকার। গবেষক দলটি ১৬০ জন অংশগ্রহণকারীর মধ্যে অন্যদের সহযোগিতা করার মানসিকতা পরীক্ষা করেন। এক রাত ঘুমানোর পর অংশগ্রহণকারীরা প্রশ্নের উত্তর দেন। গবেষক দল ২৪ জন অংশগ্রহণকারীর উত্তরে খেয়াল করেন যে, ক্লান্ত অবস্থায় নিজ থেকে অন্যকে সাহায্য করার উৎসাহ ৭৮ ভাগ কমে আসে। দলটি সেই অংশগ্রহণকারীদের মস্তিষ্ক স্ক্যান করে দেখেন নির্ঘুম রাত ‘সোশ্যাল কগনিটিভ ব্রেন নেটওয়ার্ক’-এর কার্যকারিতা কমিয়ে দেয়। এই অংশটি সামাজিক আচরণের সঙ্গে যুক্ত। অংশগ্রহণকারীরা বন্ধু ও পরিবারকে সাহায্য করার ক্ষেত্রে এমন উদাসীন ছিলেন, যেন তারা একেবারে অচেনা। 

বিশেষজ্ঞ পরামর্শ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ইশরাত শাহনাজ নিদ্রাহীনতা সম্পর্কে বলেন, ‘যদি কোনো ব্যক্তি কোনো কারণে মাসে একদিন নিদ্রাহীন রাত কাটান সে ক্ষেত্রে কোনো চিকিৎসার প্রয়োজন হয় না। যদি কেউ প্রতি সপ্তাহে দুই থেকে তিন দিন অনিদ্রায় ভোগেন সেক্ষেত্রে কিছু স্বাস্থ্যবিধি মেনে চললে সেটা ঠিক হয়ে যেতে পারে। আর যাদের ক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদি অনিদ্রা, তিন মাসের বেশি সময় ধরে চলমান তাদের ক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী চিকিৎসা এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে।’

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫