
প্রতীকী ছবি।
বাঙালির অহঙ্কার ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’। ১৯৫২ সালের সেদিনে বুকের তাজা রক্তে রঞ্জিত করে মাতৃভাষা বাংলাকে আমাদের মুখে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন বাংলার সূর্যসন্তানরা। তাদের দেখানো পথে উজ্জীবিত হয়েই ১৯৭১ সালে আমরা অর্জন করেছি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র-বাংলাদেশ। এই আত্মত্যাগের কারণে বাঙালিরা বিশ্বে আজ অনুকরণীয় ও সমাদৃত। এজন্য আমরা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণের সঙ্গে পালন করে থাকি ২১ ফেব্রুয়ারি তথা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ও শহীদ দিবস।
মহান ভাষা শহীদদের ত্যাগের ও মহিমার স্মৃতি স্মরণ করে আমরা প্রতি বছর ২১ ফেব্রুয়ারি শহীদ মিনারে পুষ্পাঞ্জলি দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করি। ‘অমর একুশে’ বৃদ্ধ-মধ্যবয়স্ক, যুবক-যুবতী, তরুণ-তরুণী, কিশোর-কিশোরীদেরকে বেদনাপ্লুত করতে পারলেও শিশুদের কৌতুহল ও ভাবনায় মাতৃভাষা কতটুকু রয়েছে তা চিন্তার বিষয়।’
রাজধানীর সেন্ট জোসেফ স্কুলের চতুর্থ শ্রেণীর শিক্ষার্থী সামী ইউসুফ জানায়, ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। এইদিনে পুলিশ অনেক মানুষকে গুলি করে মেরে ফেলছিল। পরে সরকার এই দিনটিকে শহীদ দিবস ও ইউনেস্কো আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণা করে।
বরিশালের ভাটিখানা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দ্বিতীয় শ্রেণীর শিক্ষার্থী নোমান আল মুক্তাদির জানায়, ২১ ফেব্রুয়ারি আমরা আব্বু সঙ্গে শহীদ মিনারে গিয়ে ফুল দিয়ে আসি।
তবে এমন অনেক শিশু আছে যারা ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ সম্পর্কে খুব বেশি জানে না। এর দায় এড়াতে পারেন না অভিভাবকেরা। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, শিশুদের ভাবনায় ভাষার মমতাবোধকে জাগ্রত করতে অভিভাবকসহ সংশ্লিষ্টদের দায়িত্ব রয়েছে। স্কুলে যেটুকু শেখানো হয় এর বাহিরে শিশু শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্র অত্যন্ত কম বলেই শিশুদের ভাবনায় এখনও ভাষা গুরুত্ব স্থান পায়নি।
এদিকে, বেসরকারি রেডিও, টিভি চ্যানেল ও সোশ্যাল মিডিয়ায় বাংলা-ইংরেজি বা বাংলা-হিন্দি-ইংরেজি মিশ্রিত বিকৃত শব্দ উচ্চারণ করছেন অনেক তরুণ-তরুণী। অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদেরও এমন জগাখিচুড়ি ভাষায় কথা বলতে শোনা যায়।
ভাষা বিশ্নেষকরা বলছেন, এসব ‘বাংলিশ’ বা অর্ধভাষী শব্দ প্রয়োগের প্রভাব পড়ছে শিশুদের ওপর। এভাবে চলতে থাকলে নিকট ভবিষ্যতে বাংলা ভাষার মৌলিকতা ও অস্তিত্ব সংকটে পড়তে পারে বলে মনে করছেন তারা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশে অনেক অভিভাবক জোর করে তাদের সন্তানদের ইংরেজি শেখাচ্ছেন। এর ফলে বর্তমান প্রজন্ম বাংলাও শিখছে না, ইংরেজিও শিখছে না। দ্বিভাষী না হয়ে তারা 'অর্ধভাষী' হয়ে উঠছে।
ইন্টারনেটের বদৌলতে ভিন্ন ভাষায় তৈরি কার্টুন, নাচ ও গান দেখে বড় হচ্ছে এ প্রজন্মের শিশুরা। দেখা যাচ্ছে বাংলার পরিবর্তে তারা ভিন্ন ভাষা যেমন, হিন্দি বা কোরিয়ান ভাষায় গান গাইতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছে। এমনকী ভাঙাচোরা কোরিয়ান ও হিন্দি ভাষায় কথাও বলতে দেখা যাচ্ছে তাদের।
শিশু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বর্তমান সময়ে পাঁচ বছরের শিশু থেকে ১২ থেকে ১৩ বছরের শিশুরা অস্বাভাবিকভাবে ঝুঁকে পড়ছে হিন্দির দিকে। ভিন্ন ভাষা জানা বা শেখা দোষের কিছু না হলেও জীবনের পরতে পরতে হিন্দি, কোরিয়া, ইংলিশ ভাষার ভাঙাচোরা ব্যবহার ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে শিশুদের ওপর।
অনেকে বলছেন, ‘টম অ্যান্ড জেরি’, ‘ওগি এন্ড ককরোচ’, ‘পাপাই দ্য সেইলর’, ‘ডোরেমন’ কার্টুনগুলো শিশুদের নির্মল আনন্দ দিলেও তাদের মস্তিস্কে ঢুকিয়ে দিচ্ছে এই ভাঙাচোরা ভাষা।
পটুয়াখালীর বাউফল সরকারি কলেজের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের প্রভাষক মাহাবুবা আখতার বলেন, রক্ত দিয়ে মায়ের ভাষাকে রক্ষা করেছে যে জাতি, সে জাতির নতুন প্রজন্মের মুখে এমন ভাষার বিকৃতি বড় বেদনার। তিনি বলেন, বাংলা ভাষার প্রচলিত ধারাকে যেন বিকৃত করা না হয়, সেদিকে সকলের দৃষ্টি দেওয়া উচিত।
দেশের সর্বস্তরে বাংলা ভাষার যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করা প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ আজিজুল হক গণমাধ্যমে বলেন, ‘ভাষা মিশ্রভাবে ব্যবহার করা ভালো নয়। স্বাস্থ্যকর নয়। কেউ ইংরেজি ভাষায় কথা বলা প্রয়োজন মনে করলে ইংরেজিতেই বলুক। কিন্তু মাতৃভাষা বাংলা হওয়ায় আমাদের বাংলা ভাষাতেই কথা বলতে হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘প্রমিত বাংলা শব্দের বানান এবং উচ্চারণ সুনির্দিষ্ট। বাংলা ভাষাকে মিশ্রিত বা বিকৃত করে বলার অভ্যাস ত্যাগ করতে হবে। পরিবার থেকে শুরু করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন এবং সর্বোপরি সরকারকে বাংলা ভাষার সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।’