
বাকরখানি। ছবি: সংগৃহীত
‘আলু বেচো, ছোলা বেচো, বেচো বাকরখানি
বেচো না, বেচো না বন্ধু, তোমার চোখের মণি।’
কবি সমীর রায়ের লেখনীতে প্রতুল বন্দ্যোপাধ্যায়ের গাওয়া বিখ্যাত এই গানে বাংলাদেশের পুরান ঢাকার নামকরা একটি খাবার ‘বাকরখানি’র নাম উঠে এসেছে। বাকরখানি দেখতে গোলগাল, খেতে মুড়মুড়ে-মচমচে। মিষ্টি-নোনতা, নানা স্বাদ ও পদের হয়ে থাকে এই শতাব্দী-প্রাচীন খাবারটি। স্বাদের কথা বিচার করলে এর প্রতিদ্বন্দ্বী খুঁজে পাওয়া কঠিন।
ঢাকার আদি নিবাসীদের কাছে বাকরখানি ভীষণ প্রিয়। বিশেষ করে সকালের নাশতা হিসেবেই এর কদর বেশি। জনশ্রুতি অনুযায়ী, জমিদার আগা বাকের খাঁ ও তার প্রেমিকা খনি বেগমের নামানুসারেই মচমচে এ রুটির নাম রাখা হয় ‘বাকেরখনি’, যা থেকে পরে লোকমুখে এর প্রচলিত নাম হয়ে যায় বাকরখানি। নবাব পরিবারের বাবুর্চিরাই এ বাকরখানির আবিষ্কারক।
বাকরখানি কয়েক প্রকারের হয়ে থাকে। যেমন-‘নিমশুখা’ বাকরখানি, ‘রুটিভাজা’ বাকরখানি। ‘কাইচারুটি’ এবং ‘মুলাম’ বাকরখানির অন্য প্রকারভেদ। পনির বাকরখানি হলো আরেকটি সুস্বাদু খাবার। ঝাল বাকরখানিকে আবার ঝুড়া বা ঝুরা বাকরখানিও বলা হয়। তবে পুরান ঢাকায় নোনতা বাকরখানি বেশি জনপ্রিয়। আগেরকার দিনে দুই ঈদ উৎসবে বাকরখানির চাহিদা খুব বেশি ছিল। ‘চিনশুখা’ রুটিও একপ্রকার বাকরখানি, যা বিশেষত চিনি দ্বারা তৈরি করা হয়। বিবাহ-সংক্রান্ত উৎসবে প্রথার অংশ হিসেবে কনের বাড়ি থেকে বরের বাড়ি কিশমিশ, কাঠবাদামের সঙ্গে ননিযুক্ত ঘন দুধ দিয়ে তৈরি বাখরখানি ডালায় করে পাঠানো হয়, যা ‘ভিগারুটি’ নামেও পরিচিত। বিভিন্ন আকার ও প্রকারের এসব খাস্তা মচমচে রুটি মুখে দেওয়ার পর মাখনের মতো গলে যায় নিমেষেই।
ঢাকাবাসীর অতি প্রিয় এ বাকরখানি ময়দার খামির থেকে তৈরি হয়। খামির করতে পানির বদলে পরিমাণ মতো সয়াবিন-ডালডা ব্যবহার করা হয়। খামি থেকে কেটে ছোট ছোট কোয়া তৈরি করা হয়। এই কোয়াগুলোকে বেলুনে বেলে গোলাকার আকৃতি দেওয়া হয়। মাঝখানে ছুরি দিয়ে লম্বা করে তিনটি দাগ কেটে দেওয়া হয়। এরপর এর একপাশে পানির সামান্য প্রলেপ দিয়ে ভাজা হয় মাটির ‘মটকি’ তন্দুরের দেয়ালে আটকে দেওয়া হয়। ৫ থেকে ৭ মিনিটে তৈরি হয়ে যায় বাকরখানি। তবে শতাব্দী-প্রাচীন এই খাবারের তৈরি পদ্ধতিতেও লেগেছে আধুনিকতার ছোঁয়া।
বর্তমানে অনেক বেকারিতে বৈদ্যুতিক ওভেনে বানানো হচ্ছে বাকরখানি। নতুন তন্দুরের বদলে দোকানগুলোতে বসছে বাকরখানি তৈরির ওভেন। তন্দুরের মতো ওভেনেও নোনতা ও মিষ্টি স্বাদের বাকরখানির সঙ্গে ঘি, চর্বি, পনির ও ঝুরি মাংসের বাকরখানিও তৈরি হচ্ছে। ওভেনে সহজে, দ্রুত ও সংখ্যায় বেশি বাকরখানি তৈরি করা যায়। পুরান ঢাকার সুরিটোলা এলাকায় ওভেনে বাকরখানি তৈরির এমন বেশ কয়েকটি দোকান গড়ে উঠেছে। এমন এক দোকানের দোকানি একে ‘পরিবেশবান্ধব’ বলে উল্লেখ করেছেন। কারণ এতে লাকড়ি-কয়লা জোগাড়ের ঝামেলা নেই। ফলে খরচ ও পরিশ্রম কম এবং বাকরখানি ভেঙে যাওয়ার ঝুঁকি নেই। ওভেন ব্যবহারের আরও সুবিধা হলো, তন্দুর চুল্লিতে কালো ধোঁয়া হয়, এ কারণে বাড়িওয়ালারা দোকান ভাড়া দিতে চায় না। এখন আর সে ঝামেলা নেই।
ওভেনের বাকরখানির স্বাদ নিয়েও পাওয়া গেছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। কেউ ওভেনে তৈরি বাকরখানিকে স্বাদের দিক থেকে বেশি এগিয়ে রাখছেন। আবার অনেকে বলছেন, আগে পোড়া পোড়া যে স্বাদ ছিল, এখন সেটা নেই।
অনেক কিছুই আজ হারিয়ে গেছে। তবুও ফাস্টফুডের এই যুগে বাকরখানি এখনো রয়েছে চাহিদার শীর্ষে। ঐতিহ্য হয়ে ঢাকার বুকে টিকে আছে নবাবী এ খাবারটি। মাটির তন্দুর থেকে বৈদ্যুতিক ওভেন-বদলে যাচ্ছে তৈরির প্রক্রিয়া।