Logo
×

Follow Us

লাইফস্টাইল

রাজশাহীর তামান্না আর সাতটি মহাদেশ

Icon

রাজশাহী প্রতিনিধি

প্রকাশ: ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২২:৪৯

রাজশাহীর তামান্না আর সাতটি মহাদেশ

রাজশাহীর মেয়ে তামান্না। ছবি: রাজশাহী প্রতিনিধি

বাংলাদেশের রাজশাহীর মেয়ে তামান্না, যাত্রা শুরু করেছেন তার শিকড় থেকে বেরিয়ে আন্তর্জাতিক স্তরে নিজের একটা উল্লেখযোগ্য জায়গা করে নেওয়ার। এইচএসসি পাশ করার পর, তামান্না পড়াশোনার জন্য আমেরিকায় পাড়ি জমান, এবং সেখানে ইন্ডিয়ানার পার্ডু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ব্যাচেলর এবং মাস্টার ডিগ্রি অর্জন করেন । 

পার্ডু বিশ্ববিদ্যালয় ইঞ্জিনিয়ারিং পড়াশোনার জন্য বিখ্যাত। হয়তো, বিশ্ব তখনো তামান্নার জন্য আরো অপেক্ষায় ছিল!

স্বীকৃতিতে অনন্য একটি কর্মজীবন

পড়াশোনা শেষ করে তামান্না তার পেশাগত জীবন শুরু করেন ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে, অটোমোটিভ শিল্পে। তার প্রফেশনাল জীবনের পাশাপাশি তিনি আলোচনায় আসেন, তার সামাজিক কাজে অবদানের জন্য। সমাজসেবায় সংশ্লিষ্ট থাকার জন্য, ইউনাইটেড ওয়ে নামের একটা সংস্থা তাকে এবং তার টিমকে সম্মান জানিয়ে স্থানীয় একটি বিলবোর্ডে তার ছবি প্রকাশ করে। বলে রাখা ভালো যে, ইউনাইটেড ওয়ে বিশ্বব্যাপী তাদের সমাজসেবামূলক কাজের জন্য পরিচিত এবং প্রশংসিত।

এখান থেকে তামান্না চলে যান বায়োটেক ইন্ডাস্ট্রিতে, একজন 'কন্টিনিয়াস্‌ ইম্প্রুভমেন্ট স্পেসালিস্ট' হিসাবে, যেখানে তার দায়িত্ব ছিল কাজের মান ও দক্ষতা বাড়ানো, এবং এই খাতে নতুন উদ্ভাবন আনা। এরপর পৃথিবীর সবচাইতে বড় অনলাইন বিক্রেতা অ্যামাজন তামান্না কে তাদের অংশ করে নেয় ২০২১ সালে।  কোভিড-১৯ এর সময় অন্য অনেকের মতই তখন তার কাজ ছিল অনলাইনে, যদিও তামান্না তখন থাকতো মিশিগান অঙ্গরাজ্যে।  তার কর্মদক্ষতার কারণে ২০২৩ সালে তাকে টেনেসির পরিবর্তে সিয়াটল, ওয়াশিংটনে - অ্যামাজনের গ্লোবাল হেডকোয়ার্টারে - স্থানান্তর করা হয়, কাস্টমার সার্ভিস অপারেশন্‌স্‌ টিমে। সেখানে তিনি নেতৃত্ব দেন ৮০,০০০ কাস্টমার সার্ভিস এজেন্টদের জন্য একটা বিশ্বব্যাপী মেন্টাল হেলথ এন্ড ওয়েল বিয়িং প্রোগ্রাম চালু করতে, যাতে তাঁদের কাজের পরিবেশ আরও ভালো করা যায়। এখানে সফলতার জন্য তার এই কাজ গ্লোবালি রেকগনিশন পান এবং তামান্না কে মেন্টাল হেলথ নিয়ে কাজ করার অনুপ্রেরণা জোগায়।

আমাজন এ যারা কাজ করে তাদের আমাজোনিয়ান বলা হয়, একজন আমাজোনিয়ান হিসাবে তামান্না আমাজন এ কর্মরত থাকা অবস্থাতেই আমাজন রেইন্‌ফরেস্ট ঘুরে আসেন।এখানেও উল্লেখযোগ্য যে অ্যামাজনে থাকা অবস্থাতে খুব কম মানুষই আমাজন রেনফরেস্ট যান আমাজোনিয়ান হিসাবে। বাংলাদেশী এবং একজন নারী হিসাবে, এটা আমদের সবার জন্যই একটি গর্বের বিষয়।

এ বছর তামান্না যোগ দিয়েছেন পৃথিবীর একটা বৃহত্তম বাণিজ্যিক উড়োজাহাজ প্রস্তুতকারক কোম্পানিতে - যেখানে  বিমানের উইং তৈরির কাজে সাহায্য করছেন, এবং এয়ারোস্পেস খাতে দক্ষতা অর্জন করছেন।  

ব্যক্তিগত অর্জন ও আগ্রহ

তামান্নার ব্যক্তিগত অর্জনগুলোও তার পেশাগত সাফল্যের মতোই উল্লেখযোগ্য। পার্ডু বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়, তামান্নার প্রফেসর তামান্নাকে তাঁর লেখা একটা বইয়ের প্রচ্ছদে থাকার অনুরোধ করেছিলেন। শুধু তাই নয়, সেই প্রফেসর পরে তামান্নাকে তাঁর ক্লাসের টিচিং অ্যাসিস্টান্ট্‌ হিসাবে নিয়েছিলেন সেই কোর্স এ তার সাফল্যের জন্য। 

বাবার কাছ থেকে অনুপ্রাণিত তামান্না, বেশিরভাগ সময় ঘোরাঘুরিতে মত্ত থাকেন। বয়স ৩০ হবার আগেই তার একটা ইচ্ছা ছিল পৃথিবীর সাতটা মহাদেশ ঘুরে দেখার। ঠিক সেটিই তামান্না করে ফেলেছেন ২০১৯ এর মধ্যে। বাংলাদেশী শাড়ির প্রতি তার ভালোবাসা তাকে অ্যান্টার্কটিকা অঞ্চলে শাড়ি পরে ছবি তুলতে উদ্বুদ্ধ করে, এবং তামান্না ঠিক সেই কাজটাই করেন সুদূর অ্যান্টার্কটিকায়, যা আজ পর্যন্ত আর কোন বাংলাদেশী মেয়ে করতে পেরেছে বলে আমাদের জানা নেই। তার বন্ধুদের মতে তামান্না এরকম সৃষ্টিশীল এবং সৃজনশীল কাজে সবসময়ই চটপটে থাকেন।

চাকরি আর ঘোরাঘুরি ছাড়াও তামান্না সমাজসেবায় খুব সক্রিয়। বিগ ব্রাদার্স বিগ সিস্টার্স প্রোগ্রামে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করেছেন তামান্না, যেখানে তিনি সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের মেন্টর করেছেন। এছাড়াও ওয়াইডব্লিউসিএ (YWCA)- তে যৌন নিপীড়নে নির্যাতিতদের সহায়তা প্রদানকারী হিসেবেও কাজ করেছেন। 

সোসাইটি অফ উইমেন ইঞ্জিনিয়ার্স (SWE) নামের সংগঠন কে বলা হয় মেয়েদের ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া এবং এই ক্ষেত্রে তাদের কাজকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য পৃথিবীর সব চাইতে বড় সংগঠন। মিশিগানে থাকার সময় তামান্না ওখানকার SWE এর প্রেসিডেন্ট হিসাবে দুই বছর দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলেন। সেখানে তিনি মিডল স্কুল পড়ুয়া মেয়েদের STEM (Science, Technology, Engineering, Mathematics) পড়তে উৎসাহিত করতেন, এবং এখনও তিনি সিয়াটলের এসডব্লিউই চ্যাপ্টারে সদস্য হিসাবে কাজ করে যাচ্ছেন। 

এছাড়া তামান্না বই পড়তে ভীষণ ভালোবাসেন। গল্পের বই এর পাশাপাশি, মেন্টাল ওয়েলবিয়িং, ডাইভারসিটি, ইকুইটি এবং ইনক্লুশন এর মতো বিষয়গুলো নিয়ে তামান্না পড়াশুনা করেন। শুধু পড়াশোনাই নয়, এসব বিষয় নিয়ে তিনি তার কর্মজীবনে এবং সামাজিকজীবনে সোচ্চার এবং কাজ করেন। তার কথা হল, "ইন্‌ক্লুসিভিটি এন্ড ডাইভারসিটি আর কিয্‌ টু ওয়ার্ক প্লেস্‌ হ্যাপিনেস।" 

তামান্নার একটা বৈচিত্র্যময় প্রতিভা হচ্ছে তিনি আমেরিকান 'স্মুথ এন্ড রিদম' নাচেও পারদর্শী, যেখানে তিনি অ্যাডভান্স্‌ড্‌ ব্রোঞ্জ লেভেল পর্যায়ে পারফর্ম করেন ।

সেবা, পরিশ্রম, ও সফলতার মিশেল

তামান্নার গল্প আমাদের দেখিয়ে দেয় যে, কঠোর পরিশ্রম আর সমাজের জন্য কিছু করার ইচ্ছা থাকলে, যে কেউ ভালো কিছু করতে পারে। চেষ্টা করতে পারে। বাকিটুকু উপরওয়ালার হাতে । তামান্নার এই গল্প হয়ত সেই ছোট্ট মেয়েটা কে সাহস এবং অনুপ্রেরণা দেবে, যে কি না সিলেটের বা পার্বত্য চট্টগ্রামের কোন দুর্গম জায়গায় থাকে। স্বপ্ন দেখে নিজেকে নিয়ে, এবং দেশ কে নিয়ে। তামান্নাদের গল্প হয়তো তাদের মনেও সাহস দেবে যে একদিন আমিও পারব। একদিন আমিও হব আরেকটি ছোট্ট শিশুর স্বপ্নের রং। 

এই লেখার শেষে তামান্নার কাছে একটা মন্তব্য চেয়েছিলাম। তিনি বলেছিলেন, একটা পুরুষতান্ত্রিক সমাজে বড় হয়ে, এবং সারা জীবন কাছের মানুষের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে যুদ্ধ করে, আমি সবসময় চেয়েছি এবং চাই, যেন অন্য মেয়েরা নিজেদের সব শৃঙ্খল ভেঙ্গে ফেলতে পারে। আমি তো শুধু মাত্র একজন মানুষ এবং আমার এই ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা। সারা দুনিয়াতে আরো কত মেয়েরা কত রকম যুদ্ধ করে বিজয়ী হচ্ছেন। অনেক ক্ষেত্রে আমাদের শৃঙ্খলগুলো হয় আমাদের মনের। এটা বুঝতে পারাটাও একটা বড় বিজয়। নিজের প্রতি সৎ থাকতে হবে।  সত্য থাকতে হবে নিজের অনন্যতায়।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫