
ঘুমের ফাইল ছবি
চোখে ঘুম না থাকাটা নিশ্চিতভাবেই চিন্তার বিষয়। তাতে যে শুধু শরীরে প্রভাব পড়ে- এমন নয়, মনেও সৃষ্টি হয় গভীর চাপ। শুধু মানবজীবনের জন্য না, গোটা প্রাণিকূলের জন্যই ঘুম অপরিহার্য।
মানবজীবনের আগেও ছিল ঘুম। যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়ার উপকূলের সামুদ্রিক শ্যাওলা কেলপ বনে খুঁজে পাওয়া যায় প্রাচীন প্রাণী কমলা রঙা ‘পাফবল স্পঞ্জ’। ২০১৭ সালে ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নায়ুবিজ্ঞানী উইলিয়াম জয়নার স্পঞ্জগুলো ঘুমায় কিনা, তা নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। এর আগে এ নিয়ে তেমন কোনো গবেষণা হয়নি। ঘুমের প্রাথমিক গবেষণাগুলোতে বলা হয়, এটি কীভাবে মানুষের আচরণ পরিবর্তন করে। ১৯৫০ ও ৬০-এর দশকে গবেষকরা মস্তিষ্কের ক্রিয়াকলাপ, চোখের নড়াচড়া এবং পেশির দৃঢ়তার ওপর সম্মিলিত পরিমাপ প্রকাশ করেন। পরে ঘুমের বিভিন্ন স্তর নিয়েও গবেষণা হয়। তখনও গবেষকদের ধারণা ছিল- যে প্রাণীদের মস্তিষ্ক আছে, শুধু তারাই ঘুমায়। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কৃমি, জেলিফিশ ও হাইড্রার ওপর চালানো গবেষণা পূর্ববর্তী ধারণা বদলে দিচ্ছে।
পেনসিলভ্যানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নায়ুবিদ ডেভিড রাইজেন বলেন, ‘সবচেয়ে বড় আবিষ্কার হবে এমন একটি প্রাণীর সন্ধান পাওয়া, যেটি ঘুমায় অথচ তার কোনো স্নায়ু নেই।’
বিজ্ঞানীরা প্রায়ই ঘুমকে সংজ্ঞায়িত করেছেন অস্থায়ী অচেতন অবস্থা, যা মস্তিষ্কের সঙ্গে সম্পর্কিত। নতুন গবেষণা ঘুমের বিষয়ে এক ভিন্ন দৃষ্টিকোণ উপস্থাপন করেছে, ঘুম আধুনিক মেরুদণ্ডী প্রাণীদের কেন্দ্র করে বিকশিত হয়নি, যেমনটি আগে অনুমান করা হয়েছিল; বরং প্রায় দেড় বিলিয়ন বছর আগে যখন প্রথম প্রাণীরা আবির্ভূত হয়েছিল, সম্ভবত তখনই ঘুমের জন্ম। ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নায়ুবিজ্ঞানী পল শাও বলেন, ‘আমি মনে করি, যদি কোনো প্রাণী বেঁচে থকে, তবে সে ঘুমায়।’ তার মতে, প্রাথমিক পর্বে জীবন প্রতিক্রিয়াহীন ছিল। ধীরে ধীরে পারিপার্শ্বিক অবস্থার সঙ্গে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার ভিত্তিতে জীবন বিকশ হয়েছে। ঘুম হলো সেই প্রাথমিক ধাপে ফিরে যাওয়া। পল বলেন, ‘আমি মনে করি আমরা ঘুমের বিকাশ ঘটাইনি; বরং আমরা জেগে থাকাকে বিকশিত করছি।’
প্রাণ থাকলেই যে তার বিশ্রামের দরকার, তা আধুনিক গবেষণাগুলো তুলে ধরেছে। তবে অনেক গবেষকের মতে, রাতে গাছেরা ঠিক ঘুমায় না, ঝিমায়। অনেকটা তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থা! আবার অন্য গবেষকরা বলছেন, প্রত্যেক জীবন্ত বস্তুর ঘুম, খাওয়া ও টিকে থাকার বিশেষ পন্থা রয়েছে।
গাছেদের ঘুমও তাই আমাদের মতো হওয়ার কথা নয়। ২০১৮ সালের জুনে আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে পাঠানো হয়েছিল ইকোসিস্টেম স্পেসবোর্ন থার্মাল রেডিওমিটার অন স্পেস স্টেশন (ইকোস্ট্রেস)। মহাকাশ থেকে ইকোস্ট্রেস নজর রাখে আমেরিকা ও কানাডার সীমান্তে একটি সুবিশাল হ্রদ ‘লেক সুপিরিয়র’ ও সংলগ্ন এলাকায়। ইকোস্ট্রেসে ধরা পড়ে- গাছগুলো সারারাত ঘুমায়। সকাল ৭টায় সেখানকার গাছেদের ঘুম ভাঙে। শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা- সব ঋতুতেই এক নিয়ম। লেক সুপিরিয়র থেকে একটু দূরে থাকা গাছেরা ঘুম থেকে ওঠে ৮টায়। তার চেয়েও দূরে থাকা গাছেদের ঘুম ভাঙে সকাল ৯টায়। আশপাশে হ্রদ বা জলাশয় থাকলে সকালে তাড়াতাড়ি ঘুম ভেঙে জেগে উঠতে চায় গাছ। নেমে পড়ে খাবার তৈরির মহাযজ্ঞে। জলাশয় যত দূরে থাকে, গাছেদের জেগে উঠতেও তত অনাগ্রহ দেখা যায়। কারণ এতে তাদের বেশি শক্তি ব্যয় হয়।
প্রাণীদের বহুরূপী ঘুম
প্রাণিজগতে ঘুম যে কত বৈচিত্র্যময় হতে পারে, তা প্রকাশ করেছে বিভিন্ন পরীক্ষা ও গবেষণা। বনের তৃণভোজী প্রাণী, যারা মাংসাশী প্রাণীদের শিকার, তারা কম ঘুমায়। আবার কিছু প্রাণীকে জীবন বাঁচাতে ঘুমাতে হয়। যেমন- সাপ এবং ব্যাঙ শীতনিদ্রা দিয়ে থাকে। আবার মাংসাশী শিকারি প্রাণীরা ভরা পেটে বেশি সময় ঘুমায়। গরু, ঘোড়া, জিরাফসহ অনেক বড় স্তন্যপায়ী প্রাণী দাঁড়িয়ে ঘুমায়। কিছু সামুদ্রিক স্তন্যপায়ী প্রাণী সাঁতার কাটার সময় ঘুমায় এবং কিছু সামুদ্রিক পাখি যেমন- আমাদের দেশে আসা অতিথি পাখিরা উড়তে উড়তেই কিছুটা সময় ঘুমিয়ে নেয়। মস্তিষ্কের একাংশ ঘুমিয়ে যায়, অন্য অংশে কাজ চলতে থাকে।
আবার প্রাণীর আকার অনেক বড় হলেই যে সে অনেক বেশি সময় ঘুমাবে, বিষয়টা এ রকম নয়। উদাহরণস্বরূপ হাতি এবং জিরাফের কথা বলা যেতে পারে। এই দুটি প্রাণী বেশ বড় আকারের; কিন্তু তারা খুব কম পরিমাণে ঘুমায়। তাদের ঘুমানোর সময় ৩০ মিনিট থেকে কয়েক ঘণ্টা। বাদুড় দিনে প্রায় ২০ ঘণ্টা ঘুমায়। আবার ঘুমানোর সঙ্গে সঙ্গে অক্টোপাসের রং পরিবর্তন হয়, তাদের ঘুমেরও বেশ কয়েকটি পর্যায় রয়েছে। আর তাতেও রং বদলায়।
ডলফিন অনেক সময় একটি গোলাকার অক্ষে সাঁতার কাটতে কাটতে ঘুমাতে পারে। নবজাতক তিমিরা না ঘুমিয়েই অনেকদিন পার করে দিতে পারে। তাদের মায়েরাও বাচ্চার নিরাপত্তার স্বার্থে এই সময়টা মোটামুটি না ঘুমিয়ে কাটায়। অন্য স্তন্যপায়ী প্রাণীরা যেভাবে ঘুমায়, মাছেরা ঠিক সেভাবে ঘুমায় না। মাছ ঠিক যে কাজটা করে, সেটা অনেকটা বিশ্রাম নেওয়ার মতো। গবেষণা বলছে- বিশ্রামের সময় মাছ সম্ভবত তাদের বাহ্যিক কার্যক্রম ও মেটাবলিজম (বিপাক) কমিয়ে দেয়। কিছু মাছ নির্দিষ্ট জায়গায় ভেসে থাকে, কিছু আবার একসঙ্গে নিরাপদ জায়গায় জড়ো হয়, মাটিতে অথবা কোরালে। কিছু কিছু মাছ নিজস্ব বাসস্থানের মতো থাকার জায়গা নির্ধারণ করে নেয়। মাছের এই বিশ্রামের সময়কে ‘সাসপেন্ডেড অ্যানিমেশন’ বলা হয়।
কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় দেখা গেছে, মশাও ঘুমায়। তারা প্রায়ই কোনো জায়গায় দীর্ঘ সময় ধরে ঝুলে থাকে স্থির হয়ে। তখন যদি তাদের এভাবে ঘুমাতে না দেওয়া হয় তা হলে পরবর্তী সময়ে এই ঘুমটা পুষিয়ে নেয়। এদের খাবারে ক্যাফেইন মেশালে কম সময় ঘুমায় আবার স্লিপিং পিলের উপাদান দিলে দীর্ঘ সময় ধরে ঘুমায়। একেক প্রজাতির মশার ঘুমের সময়ও ভিন্ন, এডিস মশা রাতে ঘুমায় এবং দিনে কার্যকর থাকে। আবার কিউলেক্স মশা রাতে কার্যকর থাকে।